কিডনি সুস্থ রাখতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ

বিডিমেট্রোনিউজ ডেস্ক ॥ সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রতিবছরের মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের বৃহস্পতিবার বিশ্ব কিডনি দিবস পালিত হয়। ২০১৯ সালে এবারের কিডনি দিবসের প্রতিপাদ্য হলো “সুস্থ কিডনি, সবার জন্য সর্বত্র”।

সুন্দর, সুস্থ, সবল ও নীরোগ থাকতে কে না চায়? শরীরের বাইরের পরিচ্ছন্নতা আপনার হাতে, কিন্তু শরীরের ভিতরের পরিচ্ছন্নতার দায়িত্ব কিডনির (বৃক্ক) এবং লিভারের (যকৃৎ)। যকৃৎ শরীর থেকে বিভিন্ন দূষিত পদার্থ যৌগ সহকারে পিত্ত মারফত নির্গত করে। কিডনি অনাবশ্যক ক্ষতিকারক পদার্থসমূহ শরীর থেকে দূর করার গুরুত্বপূর্ণ কার্য করে।

বিশিষ্ট কিডনি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা: এম এ সামাদ বলেন, যাদের ডায়াবেটিস আছে, যারা অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ থাকলেও নিয়ন্ত্রণ করেন না, বংশগত কিডনি রোগ রয়েছে, ধূমপান ও মাদক সেবন করেন, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ব্যথার ওষুধ ও অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করেন তাদের কিডনি জটিলতা হতে পারে।

আসলে কিডনি বিকল হয়ে যাওয়ার লক্ষণ ৭০ থেকে ৮০ ভাগ বিকল হওয়ার আগে কোনভাবেই প্রকাশ পায় না। এ অবস্থায় দেখা যায় খাওয়ায় অরুচী, বমি বমি ভাব, মাঝে মাঝে ঘুম থেকে উঠলে চোখ-মুখ ফোলা দেখানো অর্থাৎ চোখের নিচের অংশ বেশি ভারি ভারি হয়ে থাকে। এছাড়া আস্তে আস্তে রক্ত শূণ্যতা দেখা দেয়। চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে আসে। আরও যদি বেশি ঝুঁকিতে থাকে তবে বিনা কারণে শরীর চুলকাবে, গায়ের রঙ পরিবর্তন হয়ে যাবে। রাতে অনেকবার প্রস্রাব করতে হয়। কারও কারও উচ্চ রক্তচাপ দেখা দিতে পারে।

মোট কথা দেহ তো একটাই। যখন এটি খুব বেশি আক্রান্ত হয় তখন সবগুলো অঙ্গই ধীরে ধীরে জড়িত হয়ে যায়। এ জন্য এই রোগটিকে নিরব ঘাতক বা সাইলেন্ট কিলার বলা হয়।

কখনওই শুধু শুধু কিডনি বিকল হবে না। অনেকগুলো রোগের শেষ পরিনতি এটি। সেই রোগগুলো প্রাথমিক অবস্থায় সনাক্ত করা সম্ভব। যেমন ধরুন- প্রস্রাব যদি কখনও কমে যায়। অথবা কারও দেখা যাচ্ছে রাতে প্রস্রাব হতো না এখন হচ্ছে। প্রস্রাব করার সময় জালাপোড়া হয়। প্রস্রাব করার পরেও কিছু প্রস্রাব থেকে যায়। এর সঙ্গে কোমড়ের দুই পাশে ব্যথা এবং কাপুনি থাকে। আবার দেখা যাচ্ছে প্রস্রাবে প্রচুর ফেনা থাকে। মুখ ফুলে যায় তবে মনে করতে হবে কিডনির প্রদাহ বোঝায়।

আবার দেখা যায় যে প্রস্রাব লাল হচ্ছে অর্থাৎ প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত যাচ্ছে। তবে এই রক্ত যাওয়া অনেক কারণে হতে পারে যেমন কিডনিতে পাথর থাকলে। টিউমার থাকলে হতে পারে। অনেক কারণেই প্রস্রাবে রক্ত যেতে পারে। অনেক সময় ভিটামিন খেলেও প্রস্রাব হলুদ হতে পারে। আবার পানি কম খেলেও হলুদ হয়। সকালে ঘুম থেকে উঠলেও প্রস্রাব হলুদ হয়। এটা আসলে কোন রোগ না।

কিছু বিষয় মনে রাখতে হবে যা গুরুত্বপূর্ণ।

  • শরীর যদি ফুলে যায়, আর সেই ফোলাটা যদি শুরু হয় মুখমন্ডল থেকে।
  • প্রস্রাবের পরিমাণ স্বাভাবিকের তুলোনায় কমে গেলে।
  • প্রস্রাব যদি লাল হয় বা রক্ত যায়।
  • কোমড়ের দুই পাশে যদি ব্যথা হয়। এই ব্যথা তলপেটেও হতে পারে।
  • উচ্চ রক্তচাপ দেখা দিলে।

তাছাড়া কিছু রোগ আছে যা থাকলে তাদের অবশ্যই কিডনি পরীক্ষা করে নিতে হবে। যেমন ধরুন : কারও যদি ডায়াবেটিক থাকে, উচ্চ রক্তচাপ থাকে, কখন যদি কারও মুখমন্ড ফুলে গিয়ে থাকে, যদি কারও ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকে, এমন কোন মানুষ যদি থাকে যে খুব বেশি হাটাচলা করেন না-বসে বসে কাজ করেন, কোন করণে যার দীর্ঘদিন ব্যথার ঔষুধ খেতে হয়েছে এবং যারা পানি কম পানে অভ্যস্থ, বংশে যদি কারও কিডনি রোগ থাকে এসব ইতিহাস থাকলে বছরে অন্তত দুইবার কিডনি পরীক্ষা করা উচিৎ।

বিশিষ্ট শিশু নেফ্রলজিস্ট ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু নেফ্রলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা: গোলাম মাঈনউদ্দিন জানিয়েছেন, শিশুদের গলা ব্যথা, জ্বর ও ত্বকে খোস-পাঁচড়ার দ্রুত চিকিৎসা করা উচিত। এসব রোগ থেকে কিডনি প্রদাহ ও নেফ্রাইটিস হতে পারে। শিশুদেরও কিডনি রোগ হয়। শিশুদের কিডনি রোগ সারিয়ে তোলা সম্ভব যদি সঠিক সময়ে চিকিৎসা করা যায়।

এ ব্যাপারে বিশিষ্ট ইউরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা: ফখরুল ইসলাম জানান, কিডনি একটি প্রতিরোধযোগ্য রোগ। শুরুতে শনাক্ত হলে সুস্থ হওয়া সম্ভব। কিডনি নষ্ট হওয়ার পেছনে ৯০ শতাংশ দায়ী জীবনধারা সম্পর্কিত কারণ। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে, অতিরিক্ত ওজন কমাতে পারলে, অলস জীবনযাপন ত্যাগ করলে, কায়িক পরিশ্রম করলে, অস্বাস্থ্যকর খাবার ত্যাগ করলে কিডনি রোগ প্রতিরোধ করা যায়। একটু সচেতন হলে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ কিডনি বিকল প্রতিরোধ করা যায়। ভেজাল খাদ্য, প্রিজারভেটিভ (খাবার নষ্ট না হওয়ার জন্য ব্যবহৃত রাসায়নিক উপাদান) যোগ করা খাবার খাওয়ার কারণেও কিডনি বিকল হচ্ছে।

কিডনি সুস্থ রাখতে বেশি করে শাক-সবজি খাওয়া (বেশি করে ধুয়ে নেয়া রান্নার আগে), বেশি করে ফল খাওয়া, খাবারে কাঁচা লবণ না খাওয়া ও লবণের পরিমাণ কমিয়ে দেয়া, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ সেবন না করলে কিডনি জটিলতা ও রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।

কিডনি শরীরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ। আমাদের কিডনিতে মোট ২০ থেকে ২৫ লাখ ছাকনি রয়েছে, যা শরীরের রক্তকে পরিশোধন করে। কিডনির প্রধান কাজ হলো শরীর থেকে সব বর্জ্য বের করে দেওয়া, শরীরে পানি ও মৌলিক পদার্থের ভারসাম্য রক্ষা, ভিটামিন ডি ও আমিষের বিপাক ঘটানো। তবে সঠিক নিয়ম মেনে না চললে ও খাদ্যাভ্যাস যথাযথ না হলে, এমনকি ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের প্রভাবেও কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। খাবারের নিয়ন্ত্রণের ওপর অনেকটাই নির্ভর করে কিডনির সুস্থতা।

অ্যাপোলো হাসপাতালের পুষ্টিবিদ তামান্না চৌধুরীর বলেন, ‘ভেজাল খাদ্য, অনিয়ন্ত্রিত রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস, অতিরিক্ত প্রোটিন গ্রহণ, ঘন ঘন ইউরিন ইনফেকশন ছাড়াও আরও নানা কারণে আমাদের ঘরে ঘরে এখন কিডনি রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। কিডনি রোগের চিকিৎসায় ডায়েটের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা’।

Print Friendly

Related Posts