ভাষা আন্দোলন ও জাতীয় শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠার প্রাণপুরুষ ডা. গোলাম মাওলা

ইসমাইল হোসেন স্বপন 

কোন দেশেই মায়ের ভাষা বা মানুষের মুখের ভাষায় কথা বলার জন্য সংগ্রাম করতে হয়েছে এমন তথ্য জানা যায়না, জীবন দিতে হয়েছে এমন প্রমাণও পাওয়া যাবেনা। বাঙালী জন্ম থেকেই সংগ্রামী-ত্যাগী জাতি হিসেবে পরিচিত। এ জাতি যখনই যা কিছু অর্জন করেছে তার পেছনে বিসর্জন দিতে হয়েছে অজস্র প্রাণ। তেমনি তার মুখের ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করতেও মুখোমুখি হতে হয়েছিল রক্ত ঝরানো সংগ্রামের। বাঙ্গালীর মায়ের ভাষা, রাষ্ট্র ভাষা ‌বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করতে যে সুদীর্ঘ আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল সে ইতিহাস সকলের জানা। কিন্তু একটি পরাক্রমশালী দানবচক্রের হাত থেকে আমার জন্মগত অধিকার মুখের ভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিতে যারা প্রাণ দিয়েছেন তারা অবিনশ্বর। আর যারা ধারাবাহিক এ সংগ্রামকে অধিকার আদায়ের শেষ স্তম্ভে পৌঁছে দিয়েছিলেন তাদের অনেককেই আমরা মনে রাখিনি। ইতিহাস দেয়নি তাদের সঠিক মর্যাদা। আজ আমি এমন একজন ইস্পাত কঠিন দৃঢ় মানসিকতার পরিচায়ক, অকালে ঝরে যাওয়া একজন মহান পুরুষের কথা বলবো- যিনি একাধারে ভাষা সংগ্রামী, প্রখ্যাত চিকিৎসক, সফল রাজনীতিক, সমাজসেবক ও বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের অগ্নিপুরুষ ছিলেন। তিনি ভাষা আন্দোলন ও জাতীয় শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠার প্রাণপুরুষ ডাক্তার গোলাম মাওলা।

মহান ভাষা আন্দোলন ও আমাদের বাঙ্গালীর ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রথম প্রতীক জাতীয় শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রাণপুরুষ ভাষা সৈনিক ডাক্তার গোলাম মাওলা ছিলেন শরীয়তপুরের সুর্যসন্তান। রাষ্ট্রভাষা বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বাঙালীর চির ঐতিহ্যের ঠিকানা জাতীয় শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ডাঃ গোলাম মাওলার নেতৃত্ব প্রদান, ভূমিকা ও ত্যাগের তথ্য মাতৃভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে কতটুকুন ঠাঁই পেয়েছে তা আমার জানা নেই। নতুন প্রজন্ম এই ক্ষণজন্মা মানুষটির কীর্তির কথা খুব একটা জানে বলেও আমার মনে হয়না। জাতির সামনে প্রয়াত এই মহান পুরুষের গৌরবান্বিত ঐতিহাসিক অর্জনের সুবিস্তার স্থান পায়নি কোথাও । দীর্ঘ দিন ভাষা সংগ্রামের এই প্রাণপুরুষটি রাষ্ট্র থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক বলয় সর্বত্রই উপেক্ষিত ছিলেন।

১৯২০ সালের ২০ অক্টোবর শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া থানার মোক্তারেরচর ইউনিয়নের পোড়াগাছা গ্রামে ঐতিহ্যবাহী একটি মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন গোলাম মাওলা। তার পিতার নাম আব্দুল গফুর ঢালী এবং মায়ের নাম ছিল জমিলা খাতুন। গোলাম মাওলার পিতা ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। জাজিরা থানার পাঁচুখার কান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ৫ম শ্রেণি পাশ করে গোলাম মাওলা নড়িয়া বিহারী লাল উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন।

১৯৩৯ সালে সেখান থেকে তিনি বিজ্ঞান বিভাগে কৃতিত্বের সাথে মেট্রিক পাশ করেন। ৪১ ও ৪৩ সালে তিনি ঢাকার জগন্নাথ কলেজ থেকে আইএসসি ও বিএসসি পাশ করেন। এরপরে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূতত্ত্ব বিষয়ে এমএসসি পাশ করার পর ১৯৪৫ সালে কলকাতা মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস ডাক্তারী কোর্সে ভর্তি হন। সে বছর মাত্র দুইজন মুসলিম বাঙালী ছাত্র কলকাতায় এমএসসি পাশ করার পর এমবিবিএস কোর্সে ভর্তি হয় । একজন গোলাম মাওলা অপর জন মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ (এ সময় গোলাম মাওলা একটি সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়ে বেশ কিছুদিন অসুস্থ থাকেন)। কলকাতায় ছাত্রাবস্থাতেই মাওলার সাথে সখ্যতা হয় বঙ্গবন্ধুর।

গোলাম মাওলা যখন ঢাকা জগন্নাথ কলেজের ছাত্র তখন বৃটিশ শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্ত হবার জন্য শৃংখলিত মানুষের আর্তনাদ তাকে ব্যথিত করতো। বিপ্লবী চেতনা থেকেই তিনি বৃটিশ বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন। ভারতে লেখা পড়ার সুযোগে তিনি মুকুল ফৌজের অধিনায়ক হিসেবে বৃটিশ তাড়ানোর আন্দোলনে অগ্রনী ভূমিকা পালন করেন। ৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর কলকাতা থেকে মাওলা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে চলে আসেন। ৪৮ সাল থেকেই মাওলাসহ কয়েকজন ছাত্র ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্র ইউনিয়ন (ছাত্র সংসদ) প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালান। ৪৮ সালে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ছাত্রলীগ গঠন করা হলে গোলাম মাওলা ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সহ সভাপতি মনোনীত হন।

১৯৫০ সালে ফেব্রুয়ারী মাসে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে হাতে গোনা কয়েকজন ছাত্রনেতা রাজপথে শান্তি মিছিল বের করেছিল। এদের মধ্যে গোলাম মাওলা অন্যতম ছিলেন বলে ভাষা সৈনিক গাজিউল হক তার একটি স্মৃতিচারণমূলক লেখায় ১৯৮৪ সালে উল্লেখ করেছিলেন। একই বছর ১৯৫০ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদ গঠন হলে প্রথম ভিপি নির্বাচিত হন ডা. নাজির আহমেদ ( তিনি সেনা বাহিনীতে চাকরি নিয়ে পাকিস্তান চলে গেলে আর কখনো ফিরে আসেননি)। ঢাকা মেডিকেলের ২য় ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ৫২’র জানুয়ারীতে ভিপি নির্বাচিত হন গোলাম মাওলা।

১৯৫২ সালের মহান ভাষা অন্দোলনে যে ক’জন তৎকালিন ছাত্রনেতা অসীম সাহসিকতা, সুচিন্তিত পদক্ষেপ, দক্ষতা আর সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে মাতৃভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করার ভূমিকা রেখে ভাষা সৈনিক/ভাষা সংগ্রামীর খেতাব অর্জন করেছিলেন ডাক্তার গোলাম মাওলা ছিলেন তাদের প্রথম কাতারের অন্যতম দিকপাল, সফল অর্জনের পুরোধা এবং ইতিহাস রচনার পথিকৃৎ। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো যে, ক্ষণজন্মা সেই পুরুষ তার কীর্তির দ্বীপ্তি ছড়িয়ে বড় অসময়ে আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। অকৃজ্ঞ জাতি আমরা, যাকে মনে না রেখে অনেক কাল পর্যন্ত উপেক্ষিত করে রেখেছি। ২১ আসে ২১ যায়, কিন্তু এই নির্লোভ, ত্যাগী, পরোপকারী, নীরবে চলে যাওয়া মাওলাকে আমরা সম্মান ও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতে অনেক কুন্ঠাবোধ করেছি। মাত্র ৪৬ বছর বয়সে মৃত্যু বরণের পূর্বে তিনি অসামান্য কীর্তি ও গৌরবগাঁথা রেখে গেছেন বাঙালী জাতির জন্য।

সংক্ষেপে ডা. মাওলা সম্পর্কে কিছু লিখতে গিয়ে আমাকে ইতিহাসের পেছনে অনেক সাতরাতে হয়েছে। মাত্র সেদিন (২০১০ সালে) জাতীয় সংসদের তৎকালিন ডেপুটি স্পিকার ও শরীয়তপুন-২ আসনের সাবেক সাংসদ কর্নেল (অবঃ) শওকত আলীর অক্লান্ত চেষ্টায় ভাষা সৈনিক মরহুম ডা. গোলাম মাওলাকে জাতির জনকের কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মরনোত্তর একুশে পদক প্রদান করেছেন। এছাড়াও জাতীয় বীর কর্নেল (অবঃ) শওকত আলীর কল্যাণে কীর্তিনাশা নদীর উপর নির্মিত সেতু ও নড়িয়ায় একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে গোলাম মাওলার নামে। ঢাকার মেয়র সাদেক হোসেন খোকাকে বিশেষ অনুরোধ করে শওকত আলী সাহেব ২০০৭ সালের ২৫ এপ্রিল ধানমন্ডির ১ নং সড়কটির নামকরণ করিয়ে নেন গোলাম মাওলার নামে।

এ ছাড়াও শওকত আলী সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় শরীয়তপুর সরকারি পাবলিক লাইব্রেরিকে ২০০৯ সালে “ভাষা সৈনিক ডাঃ গোলাম মাওলা পাবলিক লাইব্রেরি” নামে নামকরণ করান।। গোলাম মাওলার নামে কয়েকটি সংঘ, সংসদ বা ক্লাব ধরনের সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা জানা যায়। এর মধ্যে ডা. গোলাম মাওলা তরুণ স্মৃতি সংসদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল অনেক আগে। তার কোন কার্যক্রম আছে বলে আমার জানা নেই। তবে ১৯৯৭ সালের ২ মে শওকত আলী এমপির উদ্দীপনায় ভাষা সৈনিক ডা. গোলাম মাওলা স্মৃতি সংসদ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। যার কিছু কিছু কার্যক্রম এখনো চলমান।

১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট দেশ বিভাগের কিছুদিন পর আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. রিয়াজ উদ্দিন সর্বপ্রথম উচ্চারণ করেন পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হবে উর্দূ। সাথে সাথে এর প্রতিবাদ করেন ড. মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ, ড. কাজী মোতাহার হোসেন ও ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ঘোষনা করেন উর্দূই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। সেদিন সর্ব প্রথম ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের ছাত্ররা এর প্রতিবাদ করে। এর তিন দিন পর ২৫ মার্চ কার্জন হলে ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে জিন্নাহ তার বক্তব্যের পূনরাবৃত্তি করলে ছাত্রসমাজ বিক্ষোভে ফেটে পরে। শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন এর পুরোভাগে এবং যাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন গোলাম মাওলা।

ছাত্রদের বিক্ষোভের ফলে জিন্নাহ মন্তব্য করেন রাষ্ট্রভাষার বিরোধীতা করার পেছনে পঞ্চম শক্তির হাত রযেছে। জিন্নাহর মৃত্যুর পর পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ১৯৪৯ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা পূনরাবৃত্তি করেন। ৫১ সালে লিয়াকত আলী খান আততায়ীর গুলিতে নিহত হলে খাজা নাজিম উদ্দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মনোনীত হন।

১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারী নাজিমউদ্দিন ঢাকার ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে আবার উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করেন। এখানেও ছাত্ররা তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। সে রাতেই ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র ডা. মঞ্জুরের কক্ষে মেডিকেল কলেজের ভিপি হিসেবে একটি বিশেষ জরুরী সভা আহবান করে গোলাম মাওলা সিদ্ধান্ত দেন যে, “নাজিম উদ্দিনের ঘোষনার কড়া জবাব দিতে হবে”। ২৮ জানুয়ারি গোলাম মাওলা ঢাকা মেডিকেল কলেজ কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়ন (ঢামেকসু) এর সভায় আনুষ্ঠানিকভাবে ভিপি হিসেবে এর প্রতিবাদ লিপি পেশ করেন তিনি।

৩১ জানুয়ারি ঢাকা বার লাইব্রেরি মিলনায়তনে এক সম্মেলন হয়। এতে কাজী গোলাম মাহবুবকে আহবায়ক করে কেন্দ্রীয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এখানে ডা. গোলাম মাওলা ঢাকা মেডিকেলের ভিপি হিসেবে অন্যতম সদস্যপদ লাভ করেন। ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক আমতলায় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভায় ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রতিনিধিত্ব করে রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবিতে বক্তব্য রাখেন গোলাম মাওলা।

১৯৫২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি রাত ৮টায় পুনরায় ঢাকা বার এসোসিয়েশন লাইব্রেরিতে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের জরুরী সভা হয়। গোলাম মাওলা অসুস্থ থাকায় তিনি ছাত্র সংসদের জিএস শরফুদ্দিন আহমেকে পাঠান। সেই সভায় সিদ্ধান্ত হয় ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ধর্মঘট, মিছিল, সভা-সমাবেশ ও পিকেটিং করা হবে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে। রাতে ছাত্রাবাসে ফিরে শরফুদ্দিন মাওলাকে সকল সিদ্ধান্তের কথা খুলে বলেন। মাওলা তৎক্ষনাৎ বিষয়টিকে চ্যালেঞ্জিং এবং দুঃসাহসিক ভেবে শরফুদ্দিনকে একটি বিশেষ দায়িত্ব অর্পণ করেন। শরফুদ্দিন ছিলেন পুরান ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দা।

পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই ঢাকার আদিবাসীদের (ঢাকাইয়া কুট্টি) বেশীর ভাগেরই আনুগত্য ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্র এবং উর্দু ভাষার প্রতি। তখন ঢাকা শহর ২২টি পঞ্চায়েতের স্থানীয় সরকার পদ্ধতির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হতো। এই ২২ পঞ্চায়েতের সর্দার ছিলেন পুরান ঢাকার লায়ন সিনেমা হলের মালিক কাদের সর্দার। ১৯ ফেব্রুয়ারি মাওলার পরামর্শে শরফুদ্দিন আহমেদ, ডা. আদুল আলীম চৌধুরী (পরবর্তীতে ৭১ এর ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবি) ও ডা. মঞ্জুরকে নিয়ে কাদের সর্দারের বাড়িতে গিয়ে তাকে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে ভূমিকা নিতে অনুরোধ জানান।

কাদের সর্দার প্রথমে ছাত্রদের কথা ততটা পাত্তা না দিলেও পরে যুক্তি প্রদানের এক পর্যায়ে তিনি রাজি হয়ে যান। এবং ঐ মুহুর্তেই সর্দার তার সচিবের মাধ্যমে চিঠি লিখিয়ে ২২ পঞ্চায়েতকে পাঠিয়ে জানিয়ে দেন রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ছাত্র আন্দোলনকে সহায়তা করতে হবে (ডাক্তার মাওলা সেদিন এই কৌশল অবলম্বন না করলে ২০ তারিখের ধর্মঘট এবং ২১ ফেব্রুয়ারির ১৪৪ ধারা ভঙ্গে স্থানীয় ঢাকাবাসীর সমর্থন পাওয়া যেত না)। ১৯ তারিখ রাত পার হয়েছে অনেক দুশ্চিন্তা ও উত্তেজনায়। ২০ ফেব্রুয়ারি গোলাম মাওলা ছাত্রদের আবেগ বুঝতে পেরে এবং কয়েকজন মেডিকেল ছাত্রের প্রস্তাবে মাইক ভাড়া করে সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত দেন।

মাওলা সাহেব ২ জন ছাত্রকে ডেকে হোষ্টেল ঘুরে ২৫০ টাকা উঠিয়ে আনতে বললে ছাত্ররা মাত্র কিছুক্ষণের মধ্যে ৪৫০ টাকা উঠিয়ে মাওলার হাতে তুলে দেন। তিনজন ছাত্র তিন দিকে চলে গেলেন মাইক ভাড়া করতে। মাওলা সাহেব একজনকে নির্দেশ দিলেন ওয়াইজ ঘাটের ফেক্টর দোকানের ১০০ ওয়াটের সে-ই মাইকটি অবশ্যই আনতে হবে, যে মাইকে জিন্নাহ ঘোষণা দিয়েছিল “উর্দূই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা”। যথারীতি তিন সেট মাইকই পাওয়া গেল। ফেক্টর দোকানের সেই ১০০ ওয়াটের মাইকও আসলো। ডা. আব্দুল আলীম চৌধুরীর কক্ষকে কন্ট্রোল রুম বানিয়ে সেখান থেকে গোলাম মাওলাসহ মেডিক্যাল কলেজের ও সংগ্রাম পরিষদের নেতারা অবিরাম বত্তব্য দিতে শুরু করলেন। ছাত্রদের আন্দোলন তুমুল আকার ধারণ করলো।

মুসলিম লীগ সরকার রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের তীব্রতা আঁচ করতে পেরে ২০ ফেব্রুয়ারি বিকেলে সমগ্র ঢাকা শহরে একমাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে দেয়। এ সংবাদ প্রচারের সাথে সাথে জ্বলন্ত বারুদের মত ক্ষেপে উঠে সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ বিশেষ করে ঢাকা মেডিক্যালের ছাত্ররা (ঐ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়ুয়া ছাত্রদের ভেতর একটা ভীতি কাজ করতো পাক সরকারের আচরনের উপর। পাশাপাশি কিছু এ্যাম্বিশন কাজ করতো সরকারের অনুকুলে থেকে শিক্ষা জীবন শেষে সিএসপি অফিসার/আমলা হওয়ার সুযোগ গ্রহনের জন্য। কিন্তু মেডিকেলের ছাত্ররা ঐ লোভের তোয়াক্কা করতো না, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে তাদের ভূমিকা ছিল নির্লোভ ও সাহসী।

তাদের ধারনা ছিল এমবিবিএস পাশ করে প্রাইভেট প্রাকটিস করেও সম্মানের সাথে বাঁচা যাবে। সে কারণে ভাষা সংগ্রামের চুড়ান্ত পর্বে ঢামেকসুর ভিপি গোলাম মাওলার তাত্বিক যুক্তি ও প্রজ্ঞাময় নেতৃত্বে সবচেয়ে বেশী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল তারা। ১৪৪ ধারা ভাঙ্গতে হবে এই জিঘাংসা তখন বিদ্যুৎ গতিতে কাজ করতে থাকে ছাত্রদের মধ্যে। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১৫ জন পলিট ব্যুরোর নেতাদের মধ্যে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের ব্যাপারে দ্বিধা দ্বন্দ্ব চলতে থাকে। ৪৪ ধারা ওভারলুক করার পক্ষে থাকেন মাত্র চারজন। বাকি ১১ জন সায় দেননি। গোলাম মাওলা, আব্দুল মতিন, অলি আহাদ ও সামসুল আলম শক্ত অবস্থানে থাকেন পুলিশি ব্যারিকেট ভাঙ্গার সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন।

২১ ফেব্রুয়ারি ভোর থেকেই বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শত শত ছাত্রছাত্রী ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে জড়ো হতে থাকেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায়। তাদের সাথে সংহতি প্রকাশ করতে থাকেন আমজনতা। নেতাদের দ্বান্দ্বিক চিন্তা থেকে বেড়িয়ে ছাত্ররা সত্যাগ্রহি পদ্ধতি অবলম্বন করে প্রতি ১০ জনের একেকটি দলে তারা রাস্তায় বেড়াতে থাকে। প্রথম দিকে বেড়নো ৩/৪ টি দলকেই পুলিশ গ্রেফতার করে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। মেয়েদের একটি দলের উপরও পুলিশ বেপরোয়া লাঠিচার্জ করে তাদের লাঞ্ছিত করলো। পুলিশের সাথে আন্দোলনকারীদের তুমুল ইটপাটকেল ছোড়াছুড়ি ও ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া চলতে থাকে দীর্ঘক্ষণ।

পুলিশ এক পর্যায়ে বৃষ্টির মতো টিয়ার সেল নিক্ষেপ ও গুলি করতে শুরু করলে প্রথমেই শহীদ রফিকের মাথায় গুলি লাগে। মাথার খুলি গুলি লেগে ১২/১৩ ফিট দুরে গিয়ে পরে (বর্তমান শহীদ মিনারে কাছে)। পাশাপাশি আরো ২টি লাশ পরে যায় মাটিতে। এরপর ছত্র ভঙ্গ হতে থাকে ছাত্ররা। তারা অভয়াশ্রম হিসেবে জড়ো হতে থাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ এলাকায়। মেডিকেলের সংগ্রামরত ছাত্ররা শত শত আহত আন্দোলনকারীকে চিকিৎসা দিতে থাকে। সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের বিশৃংখল অবস্থায় কান্ডারী হিসেবে আবির্ভূত হন গোলাম মাওলা।

২১ শের হত্যাকান্ডের পর পরই বিকেলে নেতারা জরুরী বৈঠকে মিলিত হন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। সেখানে আন্দোলনের পরবর্তী কৌশল নির্ধারণ করা হয়। এখানে উপস্থিত থাকেন তমুদ্দুন মজলিশের রাজনৈতিক ফ্রন্টের আহবায়ক আবুল হাশিম, সাপ্তাহিক সৈনিক সম্পাদক আব্দুল গফুর, কমরুদ্দিন আহমেদ, শামসুল হক, কাজী গোলাম মাহবুব, অলি আহাদ, মোঃ তোয়াহা, কবীর উদ্দিন আহমেদ, শহিদুল্লাহ কায়সার, কেজি মোস্তফা, মাহবুব জামাল জাহেদী ও গোলাম মাওলা।

এই সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একুশের রাতে অলি আহাদ ও আব্দুল মতিনের উপস্থিতিতে মাওলা সাহেবের কক্ষে আবার সভা বসে। সেখানে গোলাম মাওলাকে নতুন সংগ্রাম কমিটির আহবায়ক করে একটি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়। একুশের উত্তাল আন্দোলনে রক্ত ঝরার পর ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদের কার্যক্রম ঝিমিয়ে পরে। ২২ ফেব্রুয়ারি কর্ম পরিষদের বিলুপ্তি ঘোষণা করেন পরিষদের আহবায়ক আব্দুল মতিন নিজেই। কেন্দ্রীয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ এবং ঢাবি কর্ম পরিষদ ব্যর্থ হয়ে গেলে গোলাম মাওলার নেতৃত্বে নতুন সংগ্রাম কমিটি আন্দোলনে প্রাণ ফিরে পায়।

২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে নিহত শহীদদের লাশ রাখা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে। কাউকে লাশ দেখতে দেয়া হয়নি। পুলিশ সারাক্ষণ পাহারায় রাখে। ২২ ফেব্রুয়ারি সকালে শহীদদের গায়েবানা জানাজা পড়ানো হয় অসংখ্য জনতার উপস্থিতিতে। এরপরে ছাত্ররা রাজপথে আবার মিছিল বের করে। পুলিশ সেখানে গুলি চালালে এদিনও হতাহত হয় আরো কয়েকজন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হয়ে উঠে আন্দোলনের প্রাণ কেন্দ্র। সকল মতাদর্শের উর্ধে উঠে গোলাম মাওলা হয়ে উঠেন একতার প্রতীক। ২৩ ফেব্রুয়ারি সকালে ঢাকা মেডিকেলের ৩ নম্বর সেডের বারান্দায় দাঁড়িয়ে শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে একটি স্মৃতি স্তম্ভ নির্মাণের কথা হচ্ছিল। ছাত্ররা তৎক্ষনাৎ সিদ্ধান্ত নেয় ঐ দিনই স্তম্ভ নির্মাণ করতে হবে। তখন প্রশ্ন উঠলো নকশা তৈরি এবং উপকরণ সংগ্রহের। এমন সময় গোলাম মাওলা বললেন, মেডিকেলের ৩য় বর্ষের (সম্ভবত) ছাত্র বদরুল আলমকে ডেকে পাঠাতে। বদরুলের আঁকা আঁকিতে হাত ভালো। বদরুল এলে মাওলা তাকে শহীদ স্মৃতি স্তম্ভ তৈরীর জন্য একটি নকশা প্রস্তুতের নির্দেশ দিলেন। মাওলার নির্দেশে বদরুল আলম ডা. মির্জা মাজহারুল ইসলামকে সহ ডা. সাইদ হায়দারের সাহায্য নিয়ে তিন জনের মননশীল চিন্তা থেকে একটি নকশা প্রস্তুত করা হয়।

২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে মেডিকেলের ছাত্ররা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন মেডিকেল কলেজের যে স্থানে প্রথম গুলি চালানো হয়েছিল সেখানেই শহীদ মিনার স্থাপন করা হবে। সিদ্ধান্ত মতে নির্মানাধীন নার্সেস কোয়ার্টারের ইট-বালু-সুরকি আর হোসেনী দালান সড়কের পুরান ঢাকাইয়া পিয়ারু সরদারের গুদাম থেকে সিমেন্ট এনে সারা রাত জেগে ১০ ফুট উঁচু ও ৬ ফুট প্রস্থের ঐতিহাসিক প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। ছাত্রদের সাথে রাতভর নিজের কাধে করে ইট সিমেন্ট বহন করেন মাওলা।

২৪ ফেব্রুয়ারি ভোরে মাওলাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে নির্মান কাজ শেষ হলে মিনারের চার দিকে রশি বেধে দেয়া হয়। মিনারের নিচের অংশে লাল শালু কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে তার ওপরের অংশে হাতে লেখা দুটি পোষ্টার সাটানো হয়। এর একটি পোষ্টারে লেখা ছিল “ শহীদ স্মৃতি অমর হোক” অপরটিতে “ রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই”। শহীদ শফিউর রহমানের পিতা মৌলভী মাহাবুবুর রহমান ২৪ তারিখে প্রথমবার উদ্বোধন করেন শহীদ মিনারের। ২য় বার ২৬ ফেব্রুয়ারী উদ্বোধন করেন দৈনিক আজাদ পত্রিকার সম্পাদক আবুল কালাম সামসুদ্দিন।

শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে মিনার নির্মান করা হয়েছে এ খবর পৌছে যায় বিভিন্ন এলাকায়। দলে দলে নারী- পুরুষ- আবাল- বৃদ্ধ- বনিতা এসে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে থাকেন শহীদ বেদীতে। টাকা পয়সা দান করতে থাকেন পূন্যার্থীরা। জানা গেছে অনেক গৃহবধু তাদের স্বর্নালংকারও খুলে দিয়েছেন মিনারের পাদদেশে। এই পরিস্থিতিেিত নতুন করে উত্তেজিত হয় পাক সরকার । ২৬ ফেব্রুয়ারী সেনা ও পুলিশ সদস্যরা ভেঙ্গে ধুলিস্মাৎ করে দেয় শহীদ মিনারটি। সেদিনের “ শহীদ স্মৃতি স্তম্ভ” নামক স্থাপনাটি আজ শুধু ২১ শের স্মৃতি রক্ষার্থে নির্মিত একটি স্থাপত্যই নয়, এটি বাঙ্গালী জাতির গর্বের ইতিহাস, সকল গনতান্ত্রিক আন্দোলনের তীর্থস্থান। বাঙ্গালীর ঐতিহ্য ও চেতনার উৎস স্থল।

শহীদ স্মৃতিস্তম্ভটি গুড়িয়ে দেয়ার পর এতবড় একটা আন্দোলন নতুন করে যখন নেতৃত্ব শুন্য অবস্থায় তখন অত্যন্ত সাহসী কান্ডারীর ভূমিকা পালন করেন গোলাম মাওলা। জাতির চরম দূর্দিনে তার আবির্ভাব ছিল একটি ঐতিহাসিক প্রয়োজনের প্রেক্ষাপট। তিনি হয়ে উঠেন আন্দোলনের জাতীয় ঐক্যের প্রতীক। গোলাম মাওলার বিরামহীন নেতৃত্বে ১৯৫৬ সালের ২৯শে ফেব্রুয়ারী বাংলা রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি লাভ করে।

এমবিবিএস পাশ করার পর গোলাম মাওলা পাকিস্তান মেডিক্যাল এসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি ঢাকা রেডক্রসের সম্পাদক হিসেবে ব্যাপক সুখ্যাতি অর্জন করেন। তিনি মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর ভাইজির সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ৫৪’র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে নড়িয়া থেকে শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টির প্রার্থী হিসেবে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন গিয়াস উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী। কিছুকাল পরে তিনি মারা গেলে ৫৬ সালে ঐ আসনে উপনির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট থেকে মাওলাকে মনোনয়ন দেয়া হয়।

হোসেন শহীদ সরওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নির্বাচনী এলাকার ভোজেশ্বরের একটি জনসভায় এসেছিলেন। গোলাম মাওলার পক্ষে ভোট চাইতে গিয়ে সোহরাওয়ার্দী বলেছিলেন, “ গোলাম মাওলা আমার চেয়েও বেশী শিক্ষিত, তিনি বিএসসি, এমএসসি ও এমবিবিএস, তাকে আপনারা ভোট দিন”। বঙ্গবন্ধু গোলাম মাওলাকে তার একান্ত বন্ধু পরিচয়ে গোলাম মাওলার জন্য ভোট চেয়েছিলেন। এসময় সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান প্রায় তিন সপ্তাহ নড়িয়ার পোড়াগাছায় অবস্থান করে গোলাম মাওলার নির্বাচনী সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ১৯৬২ সালে জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে মাদারীপুরের একটি আসন থেকে গোলাম মাওলা আ’লীগের টিকিটে এমএনএ নির্বাচিত হয়ে পার্লামেন্টে বিরোধী দলের হুইপ নির্বাচিত হয়েছিলেন। তখন পাকিস্তান সরকার গোলাম মাওলাকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী হওয়ার জন্য আহবান করলে তিনি তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।

তৎকালীন বৃহত্তর ফরিদপুর বিশেষকরে মাদারীপুর মহকুমায় আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার জন্য গোলাম মাওলা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন। বর্ষিয়ান আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ডাক্তার মাওলা মাদারীপুর মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন এবং ১৯৫৬ থেকে ৫৭ সাল পর্যন্ত মাওলা ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন তার সাথে সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ভাঙ্গা থানার কাজী রোকোনুজ্জামান এমপি। ডা. গোলাম মাওলা জাতীয় রাজনীতি ছেড়ে মাদারীপুর এসে একজন আদর্শ চিকিৎসক হিসেবে প্রাকটিস শুরু করলেন। ডাক্তার মাওলার চেম্বারটিই ছিল তথন আওয়ামী লীগের একমাত্র ঠিকানা। তিনি গরীব রোগীদের থেকে কখনো পয়সা নিতেন না ।

উপরোন্ত গরীবদের বীনা পয়সায় ঔষধও সরবরাহ করতেন। কলকাতা মেডিকেলে এমবিবিএস পড়া অবস্থায় মাওলার শরীরে একটি সংক্রামক ব্যাধির উপস্থিতি ধরা পরেছিল। চিকিৎসার পর তা নিয়ন্ত্রনে এসছিল কিন্তু পূর্ণাঙ্গ নিরাময় হয়নি। মানুষের চিকিৎসা করতে করতে তিনি নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। ৫২’র একুশে ফেব্রুয়ারির শহীদদের রক্তে ঢাকার পিচঢালা কালো রাজপথে যে আল্পনা আঁকা হয়েছিল তাতে ডা. মাওলা বাঙালী জাতির মুক্তির ছবি দেখতে পেয়েছিলেন। তাই তিনি অনাগত মুক্তি সংগ্রাম ও স্বাধীনতাকে ইঙ্গিত করে তার সহকর্মী ও বন্ধুদের বলতেন “ বাঙালীর সুদিন আসবে, হয়তো আমি সেদিন থাকবোনা বা দেখবোনা, তোমরা তা অবশ্যই ভোগ করবে”। মায়ের ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করে মুক্তিকামী সে গোলাম মাওলা স্বাধীনতা লাভের ৫ বছর পূর্বে মাত্র ৪৬ বছর বয়সে ১৯৬৭ সালের ২৯ মে মৃত্যুবরণ করেন।

মৃত্যুকালে আমরণ এই মহান সংগ্রামী নেতা তার তিন কন্যা ও ১ জন পূত্র সন্তানের জন্য কোন সম্পদ রেখে যেতে পারেননি। শুধু তিনটি জীবন বীমা কোম্পানিতে তার নামে তিনটি পলিসি খোলা ছিল ( সম্ভবত হোমল্যান্ড ইন্স্যুরেন্স, ইস্টার্ন ফেডারেল ইউনিয়ন ইন্স্যুরেন্স ও আলফা লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি)। তার তিনিটি বীমার মৃত্যুদাবীর অর্থ থেকেই পরিবারের সহায়তা হয়েছিল বেশীরভাগ। মাওলা সাহেবের সহধর্মিনী ও তার তিন কন্যাই মৃত্যুবরণ করেছেন। ডা. গোলাম মাওলার একমাত্র জীবীত পূত্র সন্তান ডা. গোলাম ফারুখ নড়িয়া উপজেলা হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন শেষে অবসরে গিয়েছেন কয়েক বছর আগে। তিনিও শারীরিকভাবে অনেক অসুস্থ। ডাক্তার ফারুখ রাষ্ট্রের কাছে দাবি জানিয়েছেন, সকল মহান ভাষা সংগ্রামীদের যথাযথভাবে সম্মানীত করার ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য।

ভাষা সৈনিক ডা. গোলাম মাওলার গৌরবময় ইতিহাসের কথা এ দেশের নতুন প্রজন্মকে জানানোর ব্যবস্থা এর আগে কেউ করেনি। তিনি উপেক্ষিত ছিলেন রাজনৈতিক অঙ্গনের বহু ক্ষেত্রে। মাতৃভাষার সঠিক ইতিহাস রচনায় গোলাম মাওলাকে উহ্য রাখলে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনও স্বাধীনতার ইতিহাস প্রশ্নবিদ্ধ হবে। দেশের নতুন প্রজন্ম গোলাম মাওলাকে জানতে চায়। এ দায়িত্ব বাংলা ভাষাপ্রেমী প্রতিজন গবেষক, লেখক, প্রকাশক, রাজনীতিবিদ ও সরকারের। ভাষা সংগ্রামের ইতিহাসে ডা. গোলাম মাওলার জন্য সঠিক স্থান নির্ধারণ করে দেয়া এখন সময়ের দাবী।

ইসমাইল হোসেন স্বপন: ইতালি প্রবাসী, সাংবাদিক।
shaponislam87@yahoo.com

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts