কিছু স্মৃতি ও অনুভব
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে এমএ পরীক্ষা দিয়ে রেজাল্ট হওয়ার আগেই ঢাকায় ১৯৮৩ সালের শেষে এসে চাকরি নিয়ে থিতু হলাম। সেই সময়ে কবিতা লেখার গোপনীয় স্পর্ধা নিয়ে নিজের ভেতর এক ধরনের চঞ্চলতা ছিল। সেই চঞ্চলতার রেশ নিয়ে আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘এখন সাইরেন বাজানোর সময়’ বের হয় ১৯৮৪ সালের অক্টোবর মাসে।
একুশের গ্রন্থমেলা উপলক্ষে নয়, তখন মেলা উপলক্ষে এখনকার মত বই বের হতো না, মূলত বছরের অন্যান্য সময়ে বেশি বই বের হতো। তবে, বছরের অন্যান্য সময়ে প্রকাশিত বই মেলায় বিক্রি হতো। এই বইটি বিক্রি হয়েছিল ১৯৮৫-এর একুশের গ্রন্থমেলায়, প্রকাশকের স্টলসহ অন্যান্য স্টলে, তখন এক প্রকাশকের বই অন্য প্রকাশকের স্টলে বিক্রি করা যেত।
বইটি বের হয়েছিল ৪ বাংলাবাজারের ‘পাণ্ডুলিপি’ থেকে, প্রকাশক ছিলেন লক্ষণ চন্দ্র সাহা, সেই সময়ে নির্মলেন্দু গুণ, মাসুদ বিবাগী ও আমার কাব্যগ্রন্থ একসাথে বের হয়েছিল এই প্রকাশনা থেকে।
সেই ‘পাণ্ডুলিপি’ এখন নেই, প্রকাশক লক্ষণ চন্দ্র সাহা’র খোঁজ এখন আমার অজানা! তবে, মনে আছে প্রকাশক লক্ষণ চন্দ্র সাহা’র সাথে নির্মলেন্দু গুণ ও মাসুদ বিবাগী’র বেশ সখ্য ছিল, আমিও ‘পাণ্ডুলিপি’তে গিয়েছি, প্রকাশক লক্ষণ চন্দ্র সাহা’র সাথে আমারও সংক্ষিপ্ত আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, তাঁর মুখটি এখনো উজ্জ্বলভাবে মনে পড়ে! বিশেষ করে বইমেলা বা বইয়ের কথা মনে হলে! আমার প্রথম বইয়ের প্রকাশক হিসেবে তাঁর প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা রয়েছে।
এখনো আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘এখন সাইরেন বাজানোর সময়’ বের হওয়ার অনুভুতি অনুভব করি, কী এক আবেগ ও শিহরন নিয়ে বইটি বের করেছিলাম! রাত জেগে ৬৩ হৃষিকেশ দাস রোডের তাহের আর্ট প্রেস থেকে বইটি কালিমাখা অবস্থায় ছেপেছিলাম! ৪৮পৃষ্ঠার বইটির দাম ছিল বারো টাকা। বইটির প্রচ্ছদ ও নামের লেটারিং আমি করেছিলাম দুই রংয়ে, অন্য নামে। প্রচ্ছদটি একেবারে খারাপ হয়নি, প্রশংশিত হয়েছিল। মনে পড়ে বইটির বিজ্ঞাপন ‘সচিত্র সন্ধানী’তে ছাপা হয়েছিল কয়েক সংখ্যায়, পত্রিকাটিতে তখন আমার কবিতা ছাপা হয়েছিল, এই সূত্র ধরে বিজ্ঞাপনটি ছাপা হয়। এ বিষয়ে কথাসাহিত্যিক সুশান্ত মজুমদার বিশেয় সহায়তা করেছিলেন, তখন তিনি এই পত্রিকাটির সাথে যুক্ত ছিলেন। সাপ্তাহিক একতাসহ আরও কিছু পত্রিকায় বইটির বিজ্ঞাপন ও খবর বের হয়েছিল। পরবর্তিতে বেশ কিছু আলোচনাও ছাপা হয়।
সেই সময়ে ঢাকা ও দেশের অন্যান্য এলাকার মধ্যে সড়ক ও প্রযুক্তি নির্ভর যোগাযোগ এখনকার মত ছিল না, গণমাধ্যমেরও এতটা বিকাশ হয়নি। বলতে দ্বিধা নেই, কবি হয়ে ওঠার এক ধরনের প্রেষণা নিয়ে ঢাকায় আসা এবং সেই প্রেষণার আওতায় প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ হওয়ায় স্বপ্ন ছুঁয়ে আনন্দ অনুভব করেছিলাম।
উল্লেখ্য, এই কবিতার বইটি যখন বের হয়, তার অনেক আগে থেকেই গাইবান্ধায় অবস্থান করার সময় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে ঢাকার উল্লেখযোগ্য দৈনিক পত্রিকা ও সাময়িকীতে আমার কবিতা নিয়মিত ছাপা হচ্ছেছিল।
আরও উল্লেখ্য, স্বৈরাচার নিয়ন্ত্রিত সরকার রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ধারাকে তখন করছিল বাধাগ্রস্ত। এ সময়ের মত ছিল না কম্পিউটার শাসিত প্রকাশনা-শিল্প। বইমেলা তখন এতটা বিস্তৃত ছিল না। অল্পকিছু প্রকাশক ও কবি-লেখকরা নিজেরা স্টল সাজিয়ে বসত।