তরুণ প্রজন্মের প্রতি এক বয়স্বীর জবানবন্দী

এএইচএম নোমান || বাংলাদেশের উপকূলীয় ৭০’ এর ভয়াল ১২ নভেম্বর আমাকে farewell দিয়েছিল, আমার পেশাগত শিক্ষা জীবন সি এ পড়া থেকে। তা ছিল ১০ লাখ (?) আদম সন্তানের বন্যা ও জলোচ্ছাসে ভাসিয়ে নেয়া জীবন সলিল সমাধির বিনিময়ে। যা আমাদের রক্ত ঝরা মুক্তিযুদ্ধকেও এগিয়ে দিয়েছিল। ৬ দফা থেকে ১ দফায় পরিণত করেছিল।

আজ সেই নভেম্বরকে (১৯৭০) স্মরণ করে ২০১৫ তে খ্যাতনামা World University’র সুশৃংখল জ্ঞানলব্ধ উচ্ছসিত একগুচ্ছ ছাত্র ছাত্রীদের প্রিয় বিদ্যাপিঠ থেকে বিদায় সংবর্ধনা দিনে, দেশ তথা বিশ্ব, তরুণদেরকে বরণ করে নিচ্ছে। যারা মা-মাটি-মানুষের মালিকানা ফিরিয়ে আনার কাজে নিজেকে, নিজের জীবনকে, ইচ্ছেকে, মেধাকে, নিয়োজিত করবেন। তাই দেশ ও বিশ্বকে এগিয়ে নেয়ার জগতে আমিও আপনাদেরকে স্বাগত জানাই।

স্বাধীন, সৎ, নির্ভিক, অল্পতে তুষ্ট এ দেশের আম জনতা ‘মানুষ’। এই মানুষদের মৌলিক অধিকার প্রাপ্য, দেশের সম্পদ, কৃষ্টি-কালচার, আচার-ব্যবহার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আবাসন, কর্মসংস্থান’র মালিকানা। আছে কি সকল মানুষের ন্যায্যতা, সাম্যতা-সমভাবে? যা জাতির ‘স্বপ্ন’ ও স্বাধীনতা ঘোষনার অঙ্গীকার, যা আজও আমরা প্রাপ্তির জন্য সংগ্রামরত।

তাই আপনাদের এই আনুষ্ঠানিক বিদায় দিনে আবারো অভিনন্দন জানাই, এই বলে যে, আপনারা এই স্বনামধন্য বিশ্ব-বিশ্ববিদ্যালয়ের  শুধু ছাত্র-ছাত্রীই নন বরং আজ থেকে আপনারা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ টেকসই ‘দূত’ও বটে। যেখানেই যাবেন-থাকবেন, জানান দিতে হবে, মন, শিক্ষা, জ্ঞান অর্জন আমার-আপনার, কিন্তু দেশটা সবার। সবার জন্যই করতে হবে, শুধু আমার জন্যই নয়। সবার ‘সঙ্গে’ থেকেই করতে হবে। ‘জন্য’ আর ‘সংগ’কে মিলাতে পারলেই আপনার এ বিশাল সর্বোচ্চ অর্জন শিক্ষা- জ্ঞান সার্থক হবে। তাহলেই গ্রাম-বাংলার দেশ পাবে আপনাকে এবং দিবেও আপনাকে।

এ সঙ্গে আমার তরুন দিনের কর্মজীবন রচনায় ব্যবহারিক জীবনে ‘ধ্বংস থেকে সৃষ্টি’র’ প্রেরণা নিয়ে ঐতিহাসিক অন্যতম একটি উদ্যোগের কথা আপনাদেরকে জানাই। এখানে ‘বিশ্ব-বিশ্ববিদ্যালয়’ ও ‘বিশ্বগ্রাম’ নিয়ে আজকের এ দিনে ব্যবহারিক জীবনে, কাকতালীয়ভাবে আরেকটি মিল খুঁজে পাই।

তা হলো নাম ও কাজের মিলে-মানুষ গড়ার World University এবং সমাজ গড়ার World Village।

যা হলো ৭০’ এর জলোচ্ছাসে বেঁচে থাকা অসহায়, মুক্তিযুদ্ধ, নদী ভাঙ্গা, বেড়ী বাঁধের বাইরে থাকা ক্ষতিগ্রস্থদেরকে দেশে প্রথম গুচ্ছগ্রাম ‘বিশ্বগ্রাম’ বাস্তবায়ন করি। তখন ‘গুচ্ছগ্রাম’ নামের জন্ম হয়নি। সমবায়ের মাধ্যমে ‘কলোনি’ নামে শুরু করেছিলাম।  শত বাঁধা বিপত্তি ও প্রশ্নের পরও মুক্তির ইচ্ছাশক্তিকে থামাতে পারেনি। সরকারের তৎকালীন ভুমি সংস্কার কমিশনের সাথে যোগাযোগ ও দেন-দরবার চলতে থাকে….।

পরবর্তিতে হায়নাদের পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে নিজভুমি বাংলাদেশে প্রত্যাবতর্নের অব্যবহিত পর ১৪ জানুয়ারি ’৭২ এ, প্রথম পোড়াগাছায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান দেশ গড়ার স্মারক হিসাবে নিজেই কোদাল ঝুঁড়ি নিয়ে স্বেচ্ছাশ্রমে সড়ক বাঁধার কাজ উদ্বোধন করেন। সেখানের  চর-গ্রামে সভা-মঞ্চের স্মৃতি বিজড়িত বৃহত্তর নোয়াখালীর রামগতির ‘শেখের কিল্লা’ স্থানটি আজো কালের সাক্ষী হয়ে আছে। যা আজ জাতির অনুপ্রেরণার প্রতীক। যেখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন ঐতিহাসিক ভাবে জরুরী।

বিজয়ের জোঁশে ’৭২ সালে রামগতির পোড়াগাছায় বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে World Village অভিজ্ঞতায় ‘গুচ্ছগ্রাম’ প্রতিষ্ঠা হয়।  যা পরবর্তিতে ঠিকানা-আদর্শ গ্রাম- আশ্রায়ন নামে সারাদেশে স্থাপিত হয়েছে ও স্থাপন চলছে।

আজকের এই দিনের তরুণদেরকে আরেকটি উদ্ভাবনী বিষয় নিয়ে জানাতে চাই, তা হলো, সরকারের মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয় আওতায় ও গরিবের সংগঠন ‘ডরপ’ এর সহযোগীতায় সারাদেশে মাতৃত্বকালীন ভাতা ও এর কেন্দ্রিক ‘স্বপ্ন প্যাকেজ’ SAPNA (Social Assistance Program for Non-Asserters) পরিচালনা করছে। একই সঙ্গে তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের আওতায় ‘প্রজন্ম প্রতিভা বির্নিমাণ’ প্রকল্প শুরু করতে যাচ্ছে যার প্রাথমিক ভিত্তি হলো মাতৃত্বকালীন ভাতা কেন্দ্রিক ‘স্বপ্ন প্যাকেজ’। আশা করা যাচ্ছে, এর ফলে দীর্ঘ ২০ বছর এক প্রজন্ম মেয়াদী পর আর কেউ স্বাস্থ্যহীন, শিক্ষাহীন, ঘরহীন ও  কর্মসংস্থানহীন থাকবেনা।

গরিবী আর শান্তি একসাথে চলতে পারেনা।একটি সুসংগঠিত ও পরিকল্পিত SDG (Sustainable Development Goals) তৈরি হলো কিন্তু এর কোন ‘তলরেখা’ নাই। SDG- র ১৭ এজেন্ডার ১ম টাই হলো Ending Poverty. এটাকে শিরোনামে রেখে আল্লাহর অপার দান ‘মা’ কে উন্নয়ন তলরেখা (Bottom Line) ধরে, অগ্রসর হলে শুধু বাংলাদেশই নয়, বিশ্বও দারিদ্র মুক্তির পথ খুঁজে পাবে। স্বাচ্ছন্দ উন্নত জীবনমানে স্বয়ংক্রিয়ভাবে টেকসইতা আসবে। শান্তির গতি বাড়বে, বৈষম্য দুর হবে, ন্যায্যতা বাড়বে, স্বাধীনতার স্বাদ ভোগ করবে।

কেননা ‘মা’ স্রষ্টা প্রদত্ত অপার ক্ষমতাবান ও সম্পদ। এক সাহাবী রাসূলকে (সঃ) জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া আল্লাহ, মানুষের মধ্যে আমার উপর কার হক বেশী, রাসূল (সঃ) ৩ বার বললেন, তোমার মা’র এবং চতুর্থবারে বললেন তোমার বাবা’র।

মেগা প্রজেক্ট পদ্মা সেতু, ফ্লাইওভার, আন্ডার পাস, ওভারব্রীজ বহু লেন বিশিষ্ট সড়ক, মেট্রোরেল ইত্যাদি ‘অবকাঠামো উন্নয়নের’ পাশাপাশি ‘স্বপ্ন প্যাকেজ’ বাস্তবায়নের মাধ্যমে ‘সুস্থ্য মানব সম্পদও সৃষ্টি হবে’।  বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম, সপ্ন কন্যা আঁখির পলকে পরিয়ে দিবে বিশ্ব দরবারে দারিদ্র্য বিমোচনের ‘জয়’ এর মালা। এই যুগের সাহসি ও দৃঢ়তার প্রতীক বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেমন ‘অবকাঠামো উন্নয়নে পদ্মা সেত‍ু নিজের টাকায় নির্মাণ করতে পারছেন তেমনি সামাজিক বিনিয়োগের মাধ্যমে ‘মানব-সম্পদ উন্নয়নে স্বপ্ন প্যাকেজ’ও বাস্তবায়ন করবেন-পারবেন ইনশাল্লাহ। তাহলেই পুনঃ আবিস্কার হবে স্বপ্নের বাংলাদেশ ।

প্রিয় আমার সন্তানেরা, আজকের এই পরম সুখের দিনে, মধুর কথা দিয়ে, লিখার প্রসাদ গুনে কি, তোমাদেরকে মানানসই তথা যথাযথ সংবর্ধণা জানান সম্ভব? বরং তোমাদের অর্জন তুলনায় অনেক অপ্রতুলতাই ধরা পরবে। কৃপণতাই প্রকাশ পাবে। আজ আহবান থাকবে, তোমাদেরকে  অনেক উর্দ্ধে উঠে, মুক্ত বিহঙ্গের মতো আকাশে ডানা মেলে, মাটিতে পা রেখে জীবন গড়ার যুদ্ধে গরীবি হটানোর কাজে শান্তির অন্বেষায় নির্ভিক সৈনিক-দূতের ব্যবহারিক ভুমিকায় অবতীর্ন হবে। তোমাদের সবাইকে আন্তরিক অভিনন্দন ও উজ্জল ভবিষৎ কামনা করছি।

(ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ এর ছাত্র-ছাত্রীদের বিদায় বিদায় অনুষ্ঠানে আন্তর্জাতিক গুসি অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্ত এ এইচ এম নোমান এর ভাষণ)

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts