শাহ মতিন টিপু : মশা যে কী প্রকারের পতঙ্গ, তা সকলেরই জানা। রক্তপায়ী এ পতঙ্গে বিরক্ত হননি এমন মানুষ আছেন বলে মনে হয়না। সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে, মশা ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া, ওয়েস্ট নাইল ভাইরাস, মস্তিষ্কপ্রদাহ, হলুদ জ্বর, ডেঙ্গু জ্বর এবং পীত জ্বরের মত রোগের সংক্রামক।
আজ কে না জানে মশা ম্যালেরিয়ার বাহন? যার কারণে আমাদের এ তথ্যটি জানা সম্ভব হয়েছে, তিনি স্যার রোনাল্ড রস। মশা থেকে ম্যালেরিয়া আবিষ্কার করে ১৯০২ সালে স্যার রোনাল্ড রস নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
আমাদের রক্তের লোহিত রক্ত কনিকার (লাল) মধ্যে প্রবেশ করে ম্যালেরিয়ার পরজীবি চষধংসড়ফরঁস ভধষপরঢ়ধৎঁস, যে ছয়টি ম্যালেরিয়ার পরজীবি মানুষের ম্যালারিয়ার কারণ তার মধ্যে এটি সবচেয়ে ভয়ানক। লোহিত রক্ত কনিকার মধ্যে ঢুকে এরা হিমোগ্লোবিনকে খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করে এবং বংশবৃদ্ধি করে। একসময় কোয়ের পর্দা ছিড়ে বের হয়ে আসে অন্য লোহিত রক্ত কনিকাকে আক্রমন করতে।
কত সাহেব-ই তো এসেছে কলকাতায়। রাতের পর রাত মশার অত্যাচারে তারা ছটফট করেছে বিছানায় পড়ে। কখনও ঘরময় ছুটে বেড়িয়েছে মশা-শিকারের ব্যর্থ-চেষ্টায়। কিন্তু পরিবর্তে এই ছোট্ট কীটটির মৃত্যু-কামড়ে শিকার হয়েছে নিজেরাই। মুরদের চেয়েও ইংরেজরা বেশি ভয় করত মশাকে। মশা ছিল তাদের কাছে আতঙ্ক। কোকিল নিয়ে ইংরেজ কবিরা কবিতা লিখেছেন। কিন্তু ভারতে ইংরেজ কবির অন্যতম বিষয় ছিল সেদিন মশা। ‘মশা’ নিয়ে কত কবিতা কত গান যে আছে ‘অ্যাংলো ইন্ডিয়ান’ সাহিত্যে তার ইয়ত্তা নেই। সবই হয়েছে গান, গালাগালি, মশারির উদ্ভাবন ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক কিছু। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ যেটি সেটি হলো অনেক, অনেক দিন পরে। অবশেষে স্যার রোনাল্ড রস যেদিন কলকাতায় এলেন সেদিন। এনোফেলিস মশা যে ম্যালেরিয়ার জীবাণু দেহ থেকে দেহান্তরে বয়ে নিয়ে যায় রোনাল্ড রস-ই এই তত্ত্বটির আবিষ্কারক।
মশা। খ্রিষ্টের জন্মের ২৭০০ বছর আগে চাইনিজরা তাকে চিনত। গ্রীক বীরেরা বার বার পরাজিত হয়েছে এ দানবের কাছে। শক্তিশালী রোমান সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম কারণ ছিল সে । মিশরীয় ইবার প্যাপিরাসে, সুমেরীয় কিউনিফর্ম ট্যাবলেটে, হিপোক্রেটিসের চিকিৎসা শাস্ত্রে, সংস্কৃত সুশ্রুতা’য়, শেক্সপিয়ারের অন্তত ৮টি নাটকে উচ্চারিত হয়েছে এ নাম না জানা শত্রুর কথা। জনশ্রুতি আছে আলেক্সান্ডার দ্যা গ্রেটের সৈন্য বাহিনীর সঙ্গে এটি ছড়িয়ে পড়েছিল পৃথিবীব্যাপী।
স্যার প্যাট্রিক ম্যানসন প্রথম জানান যে জীবাণু (এলিফেন্টিয়াসিস বা গোঁদ রোগ) মানুষকে আক্রান্ত করে সেটা মশার শরীরেও থাকে। ডা. রোনাল্ড রস স্যার প্যাট্রিক ম্যানসনের কাজের সূত্র ধরে ডা. চার্লস ল্যাভেরনের ম্যালেরিয়া জীবাণু কিভাবে মানুষের দেহে আসে সেটা নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। ১৮৯৭ সালে এক এনোফিলিস মশাকে ব্যবচ্ছেদ করে মশার পাকস্থলিতে ম্যালেরিয়ার জীবাণু পান ডা. রস এবং পরবর্তিতে পাখির উপর গবেষণা করে প্রমাণ করেন ম্যালেরিয়া জীবাণুর জন্য মশা ইন্টারমিডিয়েট হোস্ট হিসেবে কাজ করে। ১৯০২ সালে মেডিসিনে নোবেল পুরষ্কার পান। আজ পৃথিবী থেকে ম্যালেরিয়া নির্মূলের জন্য যে কাজ চলছে তার ভিত্তি রচিত হয়েছিল ডা. রোনাল্ড রসের আবিষ্কারের মাধ্যমে।
মশা যেভাবে কামড়ায় : আশপাশে কোথাও উষ্ণ রক্তের উৎস বা খাবার রয়েছে তা দর্শন ইন্দ্রিয় ও অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে বুঝতে পারে মশা। বিজ্ঞানীরা বলছেন, মশার ঘ্রাণ ইন্দ্রিয় প্রখর। প্রায় ১০ থেকে পঞ্চাশ মিটার পর্যন্ত দূর থেকে নির্গত কার্বন ডাইঅক্সাইড শনাক্ত করতে পারে মশারা। খাবারের উৎস টের পেয়ে তারা হুল ফোটাতে বা কামড়াতে ছুটে আসে।
গবেষকেরা বলেন, যতই কীটনাশক, সুগন্ধি বা মোমবাতি ব্যবহার করা হোক না কেন তবুও মশার কামড় থেকে রক্ষা পাওয়া যায় না কারণ মশার দর্শন, ঘ্রাণ ও তাপ বোঝার সক্ষমতা আছে। তারা যেকোনো ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে খাবারের উৎস সম্পর্কে টের পায়।
ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয় ও ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির গবেষকদের দাবি, মশা যখন প্রখর ইন্দ্রিয় দিয়ে খাবারের ঘ্রাণ পায় তখন তারা দর্শন ইন্দ্রিয় ও অন্যান্য ইন্দ্রিয় ব্যবহার করে কামড়াতে ছুটে আসে। ১০ থেকে পঞ্চাশ মিটার পর্যন্ত মশা শুধু কার্বন ডাইঅক্সাইডের ধোঁয়ার ঘ্রাণ পায়। এরপর যখন পাঁচ মিটারের কাছাকাছি আসে তখন খাবারের উৎসকে দেখতে পায়। এরপর আরও কাছে এসে শরীরের উত্তাপ বুঝে কামড় বসায়। এক মিটার দূর থেকেও শরীরের উত্তাপ টের পায় মশারা। অন্য আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, মশারা উষ্ণ বস্তু বেশি পছন্দ করে।
এক হেল্থ সাময়িকীতে দেখা যায়, এ পর্যন্ত পৃথিবীতে ৩৫১২ প্রজাতির মশা দেখতে পাওয়া যায় এর মধ্যে বাংলাদেশে রয়েছে ১১৪ প্রজাতির মশা ( নতুন আবিষ্কৃত কিউলেক্স মাইমেটিকাস সহ ) । সব মশা মানুষ কে কামড়ায় না বরং স্ত্রী কিউলেক্স ও স্ত্রী এনোফিলিস জাতীয় মশা বেশি কামড়ায় বা রক্ত পান করে। একটি মশার ওজন সাধারণত ২.৫ মিলিগ্রাম। মশা ১ থেকে ৩ মাইল পর্যন্ত উড়ে যেতে পারে, যা ঘন্টায় সর্বোচ্চ ২.৫ কিলোমিটার বেগে উড়তে পারে। ওরা প্রতি সেকেন্ডে ২৫০/৩০০ বার পর্যন্ত পাখা নাড়াতে পারে ( এর জন্য ঝাঁক বেঁধে মাশার দল কোথায় যেতে থাকলে আমরা খুবই ভয়ঙ্কর এক ধরনের আওয়াজ শুনতে পাই।
রক্ত চোষা স্ত্রী জাতীয় মশারা ১৩৫/১৬০ ফুট দূর থেকে বুঝে নিতে পারে কোথায় তার খাবার আছে। মশার লাইফ সার্কেল হিসাবে প্রাথমিক ভাবে ৪টি স্তর আছে- ডিম লারভা পোপা ও এডাল্ট। মশারা উড়ন্ত অবস্থায় যৌন মিলন করে এবং সেক্সুয়েল ট্রান্সমিশন সময় ১৫/১৭ সেকেন্ড। এর ৩/৬ দিনের ভিতর মশা ডিম পেরে থাকে। স্ত্রী মশা সরাসরি পানিতে ডিম পারে এবং এক সাথে ২৫০/৩০০ পর্যন্ত ডিম ছাড়ে। একটি মশার জীবদ্দশায় স্ত্রী মশা দশ হাজার পর্যন্ত ডিম পেরে থাকে। স্ত্রী মশার ডিম উৎপাদনের জন্য প্রচুর প্রটিনের প্রয়োজন হয়। তাই যত বেশি রক্ত চুষতে পারবে ততই ডিমের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে।
গড়ে একটি মশা একবারে ০.০০১ থেকে ০.০১ মিলিলিটার রক্ত খেতে পারে অর্থাৎ একজন মানুষের শরীরের সম্পূর্ণ রক্ত চুষতে ১২ লাখের উপর মশা প্রয়োজন। ডিম পারার ২/৩ দিন পর তা লাভা তে পরিনত হয় যা পানি এবং সাথে লতাপাতা কিছুর উপর ভর করে ভাসতে দেখা যায় এবং এর ৮/১০ দিন পরই পোপাতে পরিনত হয় । যা দেখতে শুধু মাত্র মাথা ও লেজ দেখা যায়, পোকার মত (এই পোপাকে মাছ এবং ছোট পাখিরা খেতে খুব ভালবাসে)। অবশেষে এর ১/২ দিন পর পূর্ণ মশাতে রুপান্তরিত হয়। একটি পুরুষ মশা গড়ে ১০ /২০ দিন এবং স্ত্রী মশা ৩ থেকে ১০০ দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকে ।
কাকে কামড়ায় : মশা সাধারণত ফুল বা অন্যান্য লতা পাতা জাতীয় আবর্জনা থেকেই চুষে খাদ্য সংগ্রহ করে তবে পুরুষ মশা রক্ত পান করেনা বা প্রাণীকে আক্রমণও করেনা । শুধু স্ত্রী মশা ডিম্বের উর্বরতা শক্তি বাড়ানোর জন্য যে কোন ভাবে রক্ত পান করতেই হয় । মশা নোংরা জায়গায় বেশি থাকতে ভালবাসে। কারণ, সেখানে এমোনিয়া জাতীয় বিষাক্ত পদার্থ বেশি থাকে।
মানুষকে স্ত্রী মশারাই আক্রমণ করে এবং সবচেয়ে বেশী আক্রমণ করে গর্ভবতী নারীদেরকে । কারণ ২১ শতাংশ বেশি কার্বন ডাই অক্সাইড ও দেহের তাপমাত্রাও সাধারণের চেয়ে ১.২৬ ডিগ্রি বেশি। এর পরেই শিশু এবং জেনেটিক বা অসুখ জনিত কারণে যারা বেশি বেশি শ্বাস-প্রশ্বাস নেন তাদেরকে । যারা ব্যায়াম বেশি করেন তাদেরকেও অতি সহজে মশা খুঁজে বের করে ফেলে। কারণ বেশি শ্বাস প্রশ্বাস নিতে প্রচুর কার্বন ডাই অক্সাইড, ইউরিয়া ও অন্যান্য রেচন জাতীয় পদার্থ বের হয় প্রশ্বাস ও ঘামের মাধ্যমে, তখন মশা ৩০/৫০ মিটার দূর থেকে বুঝে নিতে পারে সেই গন্ধ, তাই দ্রুত ছুটে চলে আসে সেই শরীরে।
যারা ‘বিয়ার’ ও ‘অ্যালকোহল’ জাতীয় পানীয় পান করেন, কিছু প্রজাতির মশা তাদের বেশি আকৃষ্ট করে বলে দাবি আরেক দল গবেষকের। এ ছাড়া শরীর থেকে নির্গত রাসায়নিক পদার্থের সংমিশ্রণের ফলে সৃষ্ট গন্ধ মশাদের আকৃষ্ট করে । তবে প্রাচীন একটি বিষয় প্রচলিত রয়েছে যে, পর্যাপ্ত পরিমাণে রসুন গ্রহণ করলে ও চিনি এড়িয়ে চললে মশার কামড় থেকে দূরে থাকা সম্ভব। আর বাড়ির আশপাশ ও বাগান নিয়মিত পরিষ্কারের পরামর্শ দিয়েছেন গবেষকরা।