বিদায় ২০১৫ || স্বাগত ২০১৬

আখতার-উজ-জামান || ৪৪ বছর পর গৌরবময় বাংলাদেশের অনেক বড় অর্জন ছিল ইংরেজি বছরের শেষ মাসটি।  আকাঙ্খিত, অনাকাঙ্খিত ইস্যু নিয়ে দেশ মাতৃকার ছায়াতলে জড়িত এক একটি বছর। হউক সেটি ইংরেজি বা বাংলা; তারপরও বিভিন্ন সময়ের প্রেক্ষাপটের জন্ম তার নিজস্ব কার্যক্রমের চিত্র তুলে ধরে।

আমরা বাস্তবসম্মত রূপ রেখায় প্রজ্জলন ঘটানোর অপেক্ষার দিকে তাকিয়ে কিছুটা স্বস্তি আর দীর্ঘশ্বাস ফেলে থাকি নব দিগন্তে উদিত সূর্যের দিকে তাকিয়ে।

ইংরেজী বছর নিয়ে অনেক তথ্য রয়েছে।  বেশীদিন হয় নি যখন থেকে এই তারিখ সর্বজনীনভাবে নববর্ষ হিসেবে গৃহীত হয়ে আসছে। এই রীতিটি এসেছে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার হতে যেখানে বছরের শুরু হয় জানুয়ারি মাসের ১ তারিখে। বিশ্বের যেসকল দেশ এই ক্যালেন্ডারকে সিভিল ক্যালেন্ডার হিসেবে গ্রহণ করেছে, তারা সবাই ইংরেজি নববর্ষ পালন করে থাকে। তবে অনেক দেশই ক্যালেন্ডারটি গ্রহণ করার পূর্বে নববর্ষের রীতিটি গ্রহণ করেছে।

১৬০০ খ্রিস্টাব্দে স্কটল্যান্ড এবং ১৭৫২ সাল থেকে ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড এবং ব্রিটিশ কলোনিগুলো নববর্ষের রীতি অনুসরণ করতে শুরু করে। কিন্তু তারা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের সাথে পরিচিত হয় ঐ বছরের সেপ্টেম্বরে।

বিভিন্ন সূত্রমতে, আধুনিক বিশ্বে নববর্ষ হিসেবে পহেলা জানুয়ারিকে প্রচলিত করার ব্যাপারে “রিপাবলিক অফ ভেনিস” (দেশটি ১৭৯৭ সালে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কারণ তারা ১৫২২ সাল হতে এ দিনকে বছরের প্রথম দিন হিসেবে গণনা করতে শুরু করে। এরপর ১৫৫৬ সালে স্পেন, পর্তুগাল; ১৫৫৯ থেকে প্রুশিয়া, সুইডেন; ১৫৬৪ তে ফ্রান্স; ১৭০০ সাল হতে রাশিয়া এই রীতি অনুসরণ শুরু করে।

ব্যতিক্রম সব জায়গাতেই আছে। যেমনঃ ইসরায়েল। এই দেশটি গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসরণ করে থাকলেও ইংরেজি নববর্ষ পালন করে না। আবার কিছু কিছু দেশ গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারকে গ্রহণ করেনি। যেমনঃ সৌদি আরব, নেপাল, ইরান, ইথিওপিয়া এবং আফগানিস্তান। এসব দেশও ইংরেজি নববর্ষ পালন করে না।

প্রথম রোমান ক্যালেন্ডারটি ছিলো চন্দ্রকেন্দ্রিক এবং এতে মাস ছিলো দশটি। এই ক্যালেন্ডার অনুযায়ী বছরের প্রথম মাসটি ছিলো মার্চ। তাই তখন মার্চের ১ তারিখকে বছর শুরুর দিন হিসেবে উদযাপন করা হতো। ৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমের রাজা নুমা পম্পিলিয়াস এই ক্যালেন্ডারে নতুন দুটি মাস যুক্ত করেন – জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি। এরপর বছরের প্রথম মাস মার্চ হতে জানুয়ারিতে পরিবর্তন করা হয়। তবে জানুয়ারির ১ তারিখকে নববর্ষ হিসেবে চালু করতে বেশ সময় লাগে।

এটি প্রথম চালু হয় ১৫৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, রোমে। তখন এটি অনিয়মিতভাবে পালিত হতো। কারণ তখনো বিভিন্ন স্থানে জনগণ মার্চের ১ তারিখকে নববর্ষ শুরুর দিন হিসেবে ব্যবহার করতো। কিন্তু ৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমসম্রাট জুলিয়াস সিজার যখন সূর্যকেন্দ্রিক “জুলিয়ান ক্যালেন্ডার” চালু করেন, তখন জানুয়ারির ১ তারিখকেই নববর্ষের প্রথম দিন হিসেবে ঘোষণা করা হয়। মূলত তখন থেকেই এই রীতি ছড়িয়ে পড়ে।

খ্রিস্টীয় দশম শতকের শেষে বা দ্বিতীয় সহস্রাব্দের শুরুতে ভারত ও চীনে যে সভ্য সমাজগুলো ছিল তারা নিঃসন্দেহে সমকালীন ইউরোপীয় সভ্যতা থেকে অনেক অগ্রসর ছিল, যদিও ক্ষয়, বন্ধ্যত্ব ও চলিষ্ণুতার অভাব এদের, বিশেষভাবে ভারতের, প্রাণশক্তিকে ধীরে ধীরে নিস্তেজ করে দিচ্ছিল। মধ্যপ্রাচ্যে, উত্তর আফ্রিকায় ও স্পেনে তখন মুসলিম সভ্যতা উদয়ের আলোয় উদ্ভাসিত। এই সভ্যতা তখন যেখানে যা কিছু মহৎ ও বরণীয় পেয়েছে তা দুহাতে অকাতরে গ্রহণ করেছে।

শিল্প বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সহস্রাব্দের শেষ দুশ বছরে সারা বিশ্বকে এমনভাবে রূপান্তর করল যে, গত পাঁচ হাজার বছরের মানবসভ্যতা ও সংস্কৃতির সঙ্গে এই নব-উদ্ভূত সভ্যতার আর কোনো মিল বা সাযুজ্যই রইল না। দু’হাজার বছর আগে জন্মানো কোনো গ্রিক বা ইতালীয় যদি কোনো অলৌকিক কারণে দু’শ’ বছর আগে ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে সশরীরে পৃথিবীতে ফিরতে পারতেন, সেই পৃথিবী তাঁর কাছে খুব বেশি অচেনা মনে হতো না, কিন্তু আজকের পৃথিবীতে এলে তিনি বিস্ময়বিমূঢ় ও হতবাক হতেন, এই পৃথিবীর সবকিছুই তাঁর অজানা ও অচেনা মনে হত।

গত পাঁচ শ’ বছরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যে অগ্রযাত্রা হয়েছে, তা আমাদের মনোজগতের যে ব্যাপ্তি ঘটিয়েছে তা অচিন্তনীয় ও অবর্ণনীয়। কোপার্নিকাস, কেপলার, গ্যালিলিও, নিউটন, আইনস্টাইন, প্লাঙ্ক, ম্যাডাম কুরি, বোর, হাইসেনবার্গ, স্রডিংগার, ডিরাক প্রমুখের অসাধারণ অধ্যবসায় ও আবিষ্কারের ফলে বিশ্বব্রহ্মাে র বিরাটত্ব ও বিশালত্বের উপলব্ধিতে আমাদের কল্পনাই কেবল মূর্ছিত হয় না, তার মধ্যে অনির্দেশ্য ও অসীমতার পরিচয়েও আমরা অতলান্তের বার্তা পাই। এই আবিষ্কারগুলো আমাদের একই সঙ্গে দাঁড় করিয়ে দেয় বিরাট সৃষ্টি ও বিশাল ধ্বংসের মুখোমুখি।

আমাদের যে সমাজ ও রাষ্ট্র জীবন সেখানেও গত হাজার বছরে ইউরোপের মাধ্যমে আমাদের হারানোর পরিমাণ যেমন বিরাট, প্রাপ্তিও খুব কম নয়। গত এক হাজার বছরের ইতিহাস, পাশ্চাত্যের জয়যাত্রার ইতিহাস। কিন্তু এই ইতিহাস নিরবচ্ছিন্ন আলোর ইতিহাস নয়। এই ইতিহাস, বিশেষত শেষার্ধের পাঁচ শ’ বছরের ইতিহাস হল পুঁজিবাদের ইতিহাস। এই ইতিহাসের বিরাট আলো অধ্যায় হলো, সারা বিশ্বের বিরাটসংখ্যক মানুষকে, বিশেষভাবে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার ঔপনিবেশিক ও নয়া-ঔপনিবেশিক শোষণের ক্রুর বিস্তারহীন জালে আবদ্ধ করা।

পরিশেষে- বছরের শুরুতে সবাই যেন মনে রাখি আমরা আমাদের স্বত্বাকে কোনভাবেই যেন বিসর্জিত না দেই।  আমরা আমাদের অনৈতিক আচরন ও পশুত্বকে যেন বিদায়ী বছরের সাথেই জলাঞ্জলি দিয়ে দেশকে ভালোবাসি, দেশের মানুষকে ভালোবাসি। এই হোক নতুন বছরে আমাদের সবার প্রতিজ্ঞা। পুরনো বছরের সব ব্যর্থতা ও অপ্রাপ্তি ভুলে নতুন বছরে অগ্রগতির পথে এগিয়ে যাবে দেশ-এই প্রত্যাশায় রয়েছেন সাধারণ মানুষ। বিদায় ২০১৫। স্বাগত ২০১৬।

 

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts