পার্থ সনজয়
নুহাশ পল্লী থেকে তিনি যেদিন চলে গিয়েছিলেন, দিনটি ২০১২ সালের ২৬ মে। আবারো তিনি এসেছিলেন নুহাশের বিস্তীর্ণ সবুজে। কি ঝুম বৃষ্টি নেমেছিল সেই দিনটিতে! একই বছরের ২৪ জুলাই। এলেন কফিন বন্দি হয়ে। শেষ শয্যায় শায়িত হলেন লিচু তলায়। সবুজের মাঝে শ্বেত পাথরের সেই সমাধিতে আছে এপিটাফ। তাতে লেখা আছে, ‘চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে, নিয়ো না নিয়ো না সরায়ে।’
এই নুহাশ পল্লীতেই ২০১২ সালের ২৫ মে খুব সকালে হাজির হয়েছিলাম। তখন আমি সবে যোগ দিয়েছি একাত্তর টেলিভিশনে। একটা ইন্টারভিউ করতে হবে তাঁর। কত ইস্যু। তাঁর লেখা বই ‘দেয়াল’ তখন আলোচনা সমালোচনা। আছে আইনি বিষয়। আর দুরারোগ্য ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াইয়ের কথাও জানা চাই। এটা তো গেল অফিসের চাহিদা। আর নিজের চাহিদা বাঙালির এই লিটারেরি আইকনের সঙ্গে একটু আড্ডা। একটু সাহচর্য।
শুক্রবারের সকাল। আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুনও এলেন। তিনি এসেছেন সারাদিনের চুক্তিতে। দিনভর নাকি ছবি তুলবেন হুমায়ূনের। সেরকমটাই নাকি চেয়েছেন সাহিত্যের রাজপুত্র।
ঘড়ির কাঁটা ১০টা পেরিয়ে গেছে। এর মাঝেই দূর থেকে কয়েকবার তাঁকে দেখলাম, দ্রুত লয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছেন, পল্লীর এ মাথা ও মাথা। কিছুক্ষণ পর ডাকলেন। ঘরের পাশেই পাতা চেয়ার টেবিলে আমরা বসলাম। আমার দুজন ক্যামেরাম্যান রেকর্ড বাটনে হাত রাখলেন। আর একের পর এক সাটার টিপছেন নাসির আলী মামুন।
কত প্রস্তুতি নিয়ে, কত কঠিন কঠিন প্রশ্ন তৈরি করেছিলাম। তার কোনোটার উত্তর দিলেন দুই তিন শব্দে। কোনোটার দুই তিন লাইনে। কোনোটা বা দিলেনই না। তার মাঝেই জানা হলো, ক্যান্সার সেরে গেলে এর চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল গড়বেন। সেন্টমার্টিনে পা ভিজিয়ে শুরু করবেন হাসপাতাল গড়ার তহবিল সংগ্রহের কাজ। সবার কাছে অর্থ চাইবেন। কনফুসিয়াসের কথা ধার করে বললেন, যদি তিনি শেষ নাও করতে পারেন তবু হাজারো মাইল পাড়ি দেওয়ার শুরুটা তিনি করে দেবেন।
‘দেয়াল’ নিয়ে কথা হলো। কথা হলো নিউইয়র্কে চিকিৎসা নিয়ে। পাঠকের কাছে তিনি দায়বদ্ধ নন, সেটাও জানালেন। বললেন, তিন মেয়ের রঙিন টিভি দেখার শখ পূরণে টিভি নাটক লেখার কথা। এখনো একটি টিভি নাটক লিখছেন। মানসিক প্রতিবন্ধী এক মেয়ের গল্প নিয়ে। এমন কত প্রসঙ্গ। তবু আমার তৃপ্তি মেটে না।
এক সময় নিজেই উঠলেন। বললেন, চল তোমাকে গাছ দেখাই। হেসে হেসে বললেন, আমার ইন্টারভিউ বাদ দিয়ে নূহাশ পল্লীর গাছেদের ইন্টারভিউ করো। হাঁটতে হাঁটতেই স্টেভিয়া গাছের পাতা ছিঁড়ে আমাকে দিলেন। বললেন, খেয়ে দেখ। চিনির থেকে ষাট গুণ বেশি মিষ্টি। হাঁটতে হাঁটতে মৎস্য কুমারীর কাছে আসা। তার পায়ের কাছে ছোট্ট কুয়ার মতো। হুমায়ূন সেখানে পদ্ম ফুল ফোটান। সেদিন কোনো পদ্ম ছিল না। নিষাদকে নিয়ে সেখানে কিছুক্ষণ বসলেন। একের পর এক ছবি উঠছে নাসির আলী মামুনের ক্যামেরায়। আর একাত্তরের ক্যামেরায় হচ্ছে ভিডিও।
দীঘি লীলাবতীর কাছে এসে ভিত্তিটার সামনে দাঁড়িয়ে মুহূর্তের জন্য আনমনা হলেন। নিষাদকে বললেন, এই যে লীলাবতী, এটা তোমার দিদির নাম। দীঘিটার অপর পাড়ে যেতে যেতেই দেখালেন পাড় ঘিরে লাগানো তালগাছগুলো। বললেন, ‘এই গাছ বড় হতে নাকি ৭০ বছর লাগে। যখন এই গাছ লাগানোর কথা ভাবছিলাম, তখন অনেকেই বলেছে, আপনি তো দেখে যেতে পারবেন না। আমি বললাম, তাতে কী! অন্যরা দেখবে।’
নুহাশজুড়ে এত্ত এত্ত গাছ। সবই তাঁর নিজ হাতে লাগানো। বললেন, মানুষের চেয়ে গাছ তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ। ভাবলাম তাই কি হয়? কিছুক্ষণ আগেই না জানালেন, মানুষের জন্য ক্যান্সার হাসপাতাল গড়ার কথা!
হুমায়ূন এমনই। এই দুই সন্তান নিনিত ও নিষাদকে নিয়ে গাছে চড়ছেন। এই দোলনায় ঝুলছেন। আর আমার মস্তিষ্কে স্মৃতি জমা হচ্ছে একের পর এক।
জীবন তাঁকে সংকট দিয়েছে। দিয়েছে ঘাত প্রতিঘাত। মুক্তিযুদ্ধে বাবাকে হারিয়েছেন। কন্যা লীলাবতীর মৃত্যু বেদনা সয়েছেন। কখনো কোথাও কাউকে হয় তো পাননি, বেদনা ভাগাভাগি করে নেওয়ার জন্য। কখনোবা বহু মানুষের আপনজন হয়ে আপনাকেই খুঁজেছেন। সেই খোঁজা শুধু ৩৬০টি বই, টিভি নাটক আর সেলুলয়েডে নয়।
দেশভাগের পরে পূর্ববঙ্গে হুমায়ূন জন্মেছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে তাঁর লেখার বেড়ে ওঠা। আমাদের একজন লিটারেরি আইকনের দরকার ছিল। বন্দোপাধ্যায়দের বিপরীতে কাউকে দাঁড় করানোর জন্যই কি? হয়তো বা তাই। পূর্ববঙ্গ তখন রুদ্ধশ্বাসে দৌঁড়ুচ্ছে শহর ঢাকার দিকে, খুন হয়ে যাচ্ছে একের পর এক ইনোসেন্স। আমাদের আনন্দিত নরকে আমাদেরই অধিষ্ঠান হচ্ছে অকাল বোধনের কাল পেরিয়ে।
হুমায়ূনের গল্পে জাদুবাস্তবতা ছিল না। ছিল জাদুময়তা। আর তাতেই উঁকি দিয়েছে সুখী নীলগঞ্জ। কিংবা বাড়ির পাশের মেয়ে মুনা। আমাদের গল্পেরা কথা বলেছে হুমায়ূনের আঙ্গুলে।
হিমু কিংবা মিসির আলী কি শুধুই লজিক আর এন্টি লজিক? আমার তো মনে হয়, বস্তু বনাম ভাবের লড়াই। আমাদের দুটোই ভালো লাগে। কারণ আমরা যে এর কোনোটাই না! আমরা যা হতে চেয়েছিলাম তার নাম হিমু। আমরা যা হতে পারিনি তার নামও হিমু।
ভালো থাকুন হিমু, মিসির আলী, ধ্রুব এমন হাজারো চরিত্রের স্রষ্টা।