মুশফিকুর রহমান বাদল ॥ বীরাঙ্গনা; মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের দ্বারা ধর্ষিত ও নির্যাতিত নারীদের এই খেতাব দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। কিন্তু সামাজিকভাবে তারা আজও প্রাপ্য মর্যাদা পাননি। বীরাঙ্গনারাও মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছেন। তারা স্বীকৃতি চান। যদিও রাষ্ট্র ৪১ জন বীরাঙ্গনাকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিয়েছে। এর বাইরে রয়ে গেছেন আরো অনেকে যারা আজও বয়ে বেড়াচ্ছেন একাত্তরের দুঃসহ স্মৃতি। সেইসব বীরাঙ্গনাদের উৎসর্গে দেশাত্মবোধক কাব্যগ্রন্থ ‘বীরাঙ্গনা থেকে মুক্তিযোদ্ধা’।
কবি এখানে বীরাঙ্গনাদের নিয়ে পঙ্ক্তিমালা রচনা করেছেন হৃদয়ের গহীন তাড়না থেকে। স্বাধীনতার পর অনেকেই বিভিন্নভাবে ভাগ্য পরিবর্তন করতে সক্ষম হলেও, হাজারো মুক্তিযোদ্ধা, বীরাঙ্গনা রয়ে গেছেন অবহেলিত। কেন এই অবহেলা? শেষ জীবনে এসেও কী তারা মূল্যায়িত হবেন না। এই বোধ কবি মনকে আলোড়িত করে। কবি লিখেছেন :
‘কে আমি?
কি-বা আমার পরিচয়?
হ্যাঁ, আমি এক পাড়াগাঁয়ের
গৃহহীন, স্বজনহীন,
অর্ধহারে, অনাহারে, অবহেলিত
‘বাংলার বীরাঙ্গনা’ বলছি-
থমকে যাবেন না, আমার পরিচয়ে!
হ্যাঁ, আমরা গুটিকয়েক বেঁচে আছি
সমাজের বোঝা হয়ে।
কষ্ট পাবেন না, কয়েকটি বছর পর
আর খুঁজে পাবেন না
এই বীরাঙ্গনাদের বাংলার মাটিতে।’
‘বীরাঙ্গনা থেকে মুক্তিযোদ্ধা’ কাব্যটির রচয়িতা দেবাশীষ দাশ। কাব্যগ্রন্থটিতে বীরাঙ্গনারা কীভাবে তাদের জীবন উৎসর্গ করেছেন দেশের জন্য তা অত্যন্ত যত্ন নিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। যে কাব্যে রয়েছে একাত্তরের করুণ কাহিনী। দেবাশীষ দাশ প্রবাসী কবি। এটি বীরাঙ্গনাদের নিয়ে উল্লেখযোগ্য একটি কাজ। ২০১৫ সালে বাংলা একাডেমি একুশে বইমেলায় বইটি প্রকাশিত হয়েছে। বইটি সম্পর্কে নতুন যে কথাটি বলার আছে তা হলো, এর কবিতাগুলো কণ্ঠে তুলে নিয়েছেন আবৃত্তিশিল্পীরা। আসমা দেবযানীর নির্দেশনায় জনপ্রিয় অভিনেত্রী ও নাট্যব্যক্তিত্ব লাকি ইনাম কবিতাগুলো আবৃত্তি করেছেন।
‘একই ময়দানে যুদ্ধ করেছিলাম, তুমি হলে বীরউত্তম,
আর আমি হলাম বীরাঙ্গনা।
ধর্ষিতা নারী বলে সমাজে অবহেলিত,
তুমি পুরুষ বলে বীর উত্তম, বীর বিক্রম খেতাবে সম্মানিত হলে।
তোমার মাথায় স্বাধীনতার মুকুট
আর আমার মাথায় কলঙ্কের কালো টিকা।
আমি এক মুকুটবিহীন সম্রজ্ঞী বলছি-
আমার রাজত্ব নেই,
ধন নেই, মান নেই,
বাড়ি নেই, গাড়ি নেই,
তবুও নিজের রাজ্যে নিজেই সম্রাজ্ঞী সেজেছি।
ভাগ্যের নির্মম পরিহাস
গড়েছি বিরাট এক ইতিহাস।”
লেখক ঠিকই বলেছেন, আমাদের এই অসহায় বীরাঙ্গনারা আজ স্বাধীন দেশে পরাধীন সৈনিক হয়ে বেঁচে আছেন। আজ তারা কি শুধুই ইতিহাসের পাতায় সীমাবদ্ধ থেকে যাবেন? না, এটি কিছুতেই হতে পারে না? হয়তো এই অসহায় বীরাঙ্গনাদের দেখভাল করার জন্য সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও সরকার এগিয়ে আসবে ও তাদের যথাযথ মর্যাদা দেওয়া হবে, এটাই আমাদের সবার একান্ত কামনা।
আমরা যারা আমাদের শাশ্বত স্বপ্নে লালিত স্বাধীন বাংলাদেশ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গর্ববোধ করি তাদের জন্য যুগে যুগে অনুকরণীয় হয়ে থাকবে এই বীরাঙ্গনাদের জীবন নিয়ে রচিত ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’ এবং ইতিহাসের পাতায় যোগ হবে আরেকটি নব অধ্যায়। লেখককে অভিনন্দন একটি ইতিহাস-ঘনিষ্ঠ মূল্যবান কাব্যগ্রন্থ উপহার দেওয়ার জন্য।
কবিতাটি শোনার জন্য ইউটিউব লিংক :