অনুবাদ: মনোজিৎকুমার দাস
(এ.পি.জে আব্দুল কালামের লেখা আত্মজীবনীমূলক বই “মাই জার্নি ” এর তৃতীয় অধ্যায়কে “আট বছরের একটি কর্মীবালক ” শিরোনামে বঙ্গানানুবাদ করা হল।)
আমি ১৯৩১ সালে জন্ম গ্রহণ করি। আমার বয়স যখন আট, তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। ভারতীয় কংগ্রেসের বিরোধিতা সত্ত্বেও ব্রিটিশরা নাজি জার্মানীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ভারত ব্রিটিশদের কলোনী হওয়ায় ভারতও যুদ্ধে জড়িয়ে যায়। সারা পৃথিবীর বিভিন্ন যুদ্ধাঞ্চলে রেকর্ড সংখ্যক ভারতীয় সৈন্যদেরকে প্রেরণ করা হয়। যাহোক , দৈনন্দিন জীবন বিশেষ করে আমাদের দক্ষিণ ভারতের যুদ্ধের প্রভাব তেমনটা পড়ে না।
আমি এখানে উল্লেখ করতে চাই ১৯৪০ এ আমাদের ছোট্ট শহরটি ছিল বেশই শান্ত । তীর্থযাত্রীদের আগমনে ছোট্টটি শহরটি জীবন্ত হয়ে থাকতো। অধিবাসীদের অধিকাংশই ছিল ব্যবসাবাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত। তাদের মধ্যে অনেকেই ছিল ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। শহরটি একটি মন্দির দ্বারা পরিচালিত হতো। যদিও সেখানে একটি মসজিদ ও একটি গীর্জাও ছিল। শহরের লোকদের মধ্যে সৌহার্দ ও শান্তি বিরাজ করতো। অন্যান্য শহর কিংবা গ্রামে ঝুটঝামেলা থাকলেও এখানে তেমন কোনঘটনা ঘটতো না।
শহরের বাইরের পৃথিবীর খবরাখবর পাওয়ার একমাত্র মাধ্যম ছিল খবরের কাগজ। আমার কাজিন সামসুদ্দিনের সংবাদপত্রের এজেন্সি ছিল। আমার বাল্যকালে জালাল্লুদ্দিনের মতো সামসুদ্দিনেরও আমার খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল। জালাল্লুদ্দিন যদিও লিখতে পড়তেন পারতেন, সামসুদ্দিন কিন্তু তেমন উচ্চ শিক্ষিত ছিলেন না। তবুও তিনি আমাকে খুব স্নেহ করতেন এবং নানা ভাবে আমাকে উৎসাহিত করতেন। ফলে তিনি আমার জীবনের পথপ্রদর্শক হয়েছিলেন। এই দু’জন মানুষ আমার গভীর চিন্তা ভাবনা ও অনুভূতিকে বুঝতে পারতেন। আমার কাছে তারা ছিলেন বয়স্ক মানুষ যারা সমস্ত প্রকারের পশ্চাদপদতাকে পেছনে দূরে ঠেলে দিয়ে আমাকে তাদের দৈনন্দিন জীবন, ব্যবসাবাণিজ্য ও বৃহত্তর জগতের সঙ্গে আমাকে পরিচিত করান।
রামেস্বরমে একমাত্র সামসুদ্দিনের সংবাদপত্র বিতরণের এজেন্সি ছিল। সে সময় শহরে হাজার খানেক শিক্ষিত লোক বসবাস করতেন। তিনি তাদের প্রত্যেককে সংবাদপত্র বিতরণ করতেন। সংবাদপত্রে স্বাধীনতা আন্দোলনের খবরাখবর প্রকশিত হতো, আর স্বাধীনতা আন্দোলনের খবর কাগজে হেডিং হতো। এই সমস্ত খবরগুলো প্রত্যেকেই আগ্রহ ভরে পড়ে আলোচনা করতো। তাছাড়া হিটলার ও নাজি সেনাবাহিনীর সংবাদ সহ রণাঙ্গনের খবরাখবরও কাগজে থাকতো। অবশ্যই, খবরের কাগজগুলোতে অন্যান্য খবরগুলোর মতো জ্যের্তিবিজ্ঞান সোনারুপার দামও থাকতো। খবরগুলোর মধ্যে তামিল ভাষার খবরের কাগজের সংখ্যাই ছিল বেশি।
রামেস্বরমের মতো জায়গায় খবরের কাগজ পৌছানো ছিল একটি কষ্টকর কাজ। কাগজগুলো সকালের ট্রেনে আসতো। রামেস্বরম স্টেশনে কাগজগুলো নামিয়ে রাখা হতো। ওখান থেকে কাগজগুলোকে গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হতো। কাজগুলো সামসুদ্দিন করতেন। যাহোক , দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘোরতর রূপ ধারণ করলে আমরা কোনক্রমেই নিশ্চুপ থাকতে পারলাম না। এটা আমার জীবনেও প্রভাব ফেললো। খবরের কাগজ বিলিবন্টন করা আমার জীবনে নতুন একটি পথের দিশা দেখালো।
ব্রিটিশ সরকার বিভিন্ন জিনিসের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করলো এবং বিভিন্ন জিনিসের রেশন করলো। আসলে এক ধরনের জরুরী অবস্থা । বড় পরিবার হওয়ার ফলে আমাদের পরিবার অসুবিধায় পড়লো। খাদ্য, কাপড়চোপড়, শিশুদের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস পাওয়া কষ্টকর হলো। আমাদের পরিবারে পাঁচটি ছেলেমেয়ে আর আমার চাচাদের পরিবার। আমার দাদা ও নানী’র দায়দায়িত্ব ছিল তাদের সব রকমের প্রয়োজন মেটানো।
যুদ্ধের খারাপ প্রভাব আমাদের পরিবারের উপর পড়লো। একদিন সামসুদ্দিন একটি প্রস্তাব নিয়ে আমাদের এখানে এলেন। আমি তার প্রস্তাবের কথা শুনে আমি যারপর নাই আহ্লাদিত হলাম। তিনি বললেন যে ট্রেন এরপর থেকে রামেস্বরম স্টেশনে থামবে না। তাহলে আমরা কিভাবে আমাদের কাগজের কী হবে? কেমন করে কাগজ ট্রেন থেকে নামানো যাবে, আর কিভাবেই বা তা গ্রাহকদের মধ্যে বিলি করা হবে? শহরের গ্রাহকরা কাগজের খবরের অপেক্ষায় কি তাকিয়ে থাকবে না? সামসুদ্দিন একটি উপায় দেখতে পেলেন। একটি বড় বান্ডিলে খবরের কাগজগুলো প্রস্তুত করে রাখা হবে।রামেস্বরম—ধনুশকোদি লাইনে ট্রেন রামেস্বরম প্লাটফরম পার হওয়ার সময় ধীরে চলাকালে কাগজের বান্ডিলটি ট্রেন থেকে প্লাট ফরমে ছুড়ে ফেলে দিতে হবে। আমাকে রামেস্বরম স্টেশনে উপস্থিত থেকে কাগজের বান্ডিলটি সংগ্রহ করতে হবে। চলন্ত ট্রেন থেকে ছুড়ে ফেলে দেওয়া কাগজের বান্ডিলটি সংগ্রহ করে কাগজগুলো শহরের গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য সামসুদ্দিন আমাকে এই কাজটি করার প্রস্তাব দিলেন।
আমার উৎসাহের কমতি ছিল না। আমার বয়স মাত্র আট বছর। আমি কিন্তু এ কাজ করে আমার আয় পরিবারের খরচপাতিতে যোগ করতে পারি। আমি অনেকদিন থেকে লক্ষ করছিলাম আমাদের খাবার দেওয়ার পর আমার মা ও দাদির থালায় খাবারের পরিমাণ কমই থাকতো। ছেলেমেয়েদেরকে প্রথমে খাওয়ানো হতো। আগে আমার কখনো মনে হয়নি আমাদের কেউ ক্ষুধার্ত থাকতে পারে।
বস্তুতপক্ষে, মহিলারা আমাদেরকে খাওয়ানোর জন্য তারা পুষ্টিকর খাবার নিজেরা না খেয়ে ত্যাগ স্বীকার করেন। আমি সামসুদ্দিনের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম।
যাহোক, আমি নিয়মিত আমার নতুন দায়িত্ব পালন করতে থাকলাম। আমি আমার স্কুলের পড়াশোনা আগে ভাগেই প্রস্তুত করে নিতাম। অন্যান্য কাজের মাঝেই আমি কাগজ বিলি করার কাজ চালিয়ে যেতে থাকলাম। আমি আমার ভাই ও কাজিনদের মধ্যে আমি গণিত বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছিলাম। আমার বাবা আমাদের অংকের শিক্ষকের কাছে গণিত পড়ার জন্য ব্যবস্থা করলেন। যাহোক, আমাকে একটি শর্ত দিলেন যে আর চারজন ছাত্রের সঙ্গে ভোরে গোসল করে পড়তে আসতে হবে। আমি এক বছর শিক্ষকের কাছে পড়েছিলাম।
বাইরে রাতের আঁধার, সেই সময় থেকেই আমার কাজ শুরু হতো। আমার মা আমাকে নাড়া দিয়ে জাগিয়ে তুলতেন। তিনি আমি ঘুম থেকে উঠার আগেই উঠতেন। তিনি আমার স্নানের ব্যবস্থা করতেন। আমার গোসলের পর তিনি আমাকে শিক্ষকের বাড়িতে পাঠিয়ে দিতেন। আমি সেখানে এক ঘন্টা পড়াশোনা করে সকাল ৫টায় ফিরতাম। তারপর আমার বাবা আমাকে নিয়ে কাছের আরবী শিক্ষকের কাছে নিয়ে যেতেন। আমি সেখানে কোরআন শরীফ পড়া শিখতাম।
কোরআন শরিফ পড়া শেখার পর আমি স্টেশনের দিকে রওনা হতাম। সেখানে আমি ট্রেন আসার অপেক্ষায় থাকতাম। আমি সামনে পা বাড়াতাম চোখ কান খোলা রেখে ট্রেন আসার অপেক্ষয় থাকতাম। বিস্ময়কর ব্যাপার ছিল যে ট্রেন ঠিক সময়ই আসতো। মাদ্রাজ —ধনুশকোদি মেইল ট্রেন খুব কম দেরি করে আসতো! শীঘ্র শীঘ্রই দূরে ট্রেনের ইঞ্জিনের ধোয়া দৃশ্যমান হতো। খুব জোরে ট্রেনের বাঁশি শোনা যেত। গর্জন করে ট্রেন স্টেশন পার হয়ে যেত। আমি চোখ রাখতাম কোথায় কাগজের বান্ডিলটা ট্রেন থেকে পড়ে সেদিকে। সঠিক সময়ে বান্ডিলটি প্লাটফর্মে পড়তো। সামসুদ্দিনের লোক খবরের কাগজের বান্ডিল ট্রেনের প্লাটফর্মে ফেলে দিয়ে আমার দিকে হাত নাড়াতো। ট্রেন প্লাটফরর্ম ছেড়ে দূরে যাওয়ায় ট্রেনে বাঁশির শব্দ ম্লান হয়ে আসতো।
তারপর আমি বান্ডিলটি সংগ্রহ করে এক এক পাড়ার গ্রাহকদের কাগজগুলোর ভাগে ভাগ করে সাজিয়ে তা বিলি করার জন্য রওনা হতাম। এক ঘন্টার মধ্যে রামেস্বরমের চারপাশের গ্রাহকদের প্রত্যেকের কাছে কাগজগুলো বিলি করতাম। শীঘ্রই খবরের কাগজ পড়া মানুষগুলোর সঙ্গে আমার চেনাশোনা হয়ে গেল। অনেকেই আমার জন্য অপেক্ষা করতে থাকতেন। তারা আমার সঙ্গে বন্ধু সুলভ আচরণ করতেন। তাদের কেউ আমাকে তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে বলতেন, যাতে স্কুলে যেতে দেরি না হয়ে যায়! আমি ভাবি, আট বছরের একটি উৎফুল্ল বালকের পক্ষে খবরের কাগজ তাদের হাতে তুলে দেওয়া সবচেয়ে উপভোগ্য ছিল।
আমাদের শহরটি পূর্ব উপকূলে অবস্থিত। সকাল আটটার মধ্যে আমার কাজ শেষ হয়ে যেত। সূর্য আকাশের বেশটা উপরে। তারপর আমি বাড়িতে ফিরে যেতাম। মা বাড়িতে আমার ব্রেকফাস্ট নিয়ে অপেক্ষা করতেন। সাধারণ খাবার আমাকে তিনি খেতে দিতেন। কিন্তু আমি সে সময় খুবই ক্ষুধার্ত থাকতাম! আমি প্রত্যেকটি খাবার খেয়ে ফেলতাম মা আমাকে স্কুলে পাঠানোর আগে। আমার কাজ কিন্তু শেষ হতো না।
স্কুলের পরে সন্ধ্যায় আমি আবার সামসুদ্দিনের গ্রাহকদের যেতাম কাগজের দাম আনতে। তারপর আমি সামসুদ্দিনের সঙ্গে দেখা করে সেই দিনের হিসাব মতো কাগজে দাম তাকে দিতাম।
তারপর , সমুদ্রের ধারে কোথায়ও বসতাম। মৃদুমন্দ বাতাস বইতো সে সময়। জালাল্লুদ্দিন কিংবা সামসুদ্দিন দিনের কাগজ খুলে পড়তেন। আমরা সবাই দিনমণি কাগজের কাল কাল অক্ষরগুলোতে চোখ রাখতাম। আমাদের মাঝ থেকে একজন জোরে জোরে খবরগুলো পড়তাম। এ থেকে আমরা ধীরে ধীরে পৃথিবীর খবরাখবর সম্বন্ধে সচেতন হয়ে উঠতে থাকলাম।গান্ধী, কংগ্রেস, হিটলার, পেরিয়ার ই.ভি.রামাস্বামী কথাগুলো সেই সন্ধ্যার বাতাসে ছড়িয়ে পড়তো। আমি ফটো ও কথাগুলোর উপর আঙ্গুল দিয়ে চিহ্নিত করতাম। এভাবেই বৃহত্তর পৃথিবীর সঙ্গে আমার পরিচয় গড়ে উঠলো। আমি ভাবলাম একদিন আমি মাদ্রাজ, বোম্বে, ও কলকাতার মতো বড় বড় শহরে হয়তো যেতে পারবো। আমি কি কখনো গান্ধী ও নেহেরুর সঙ্গে দেখা করতে পারবো? আমার ভাবনাচিন্তায় ছেদ পড়তো আমার খেলা সাথীদের ডাকে। তারপর আমাকে রাতের খাবার খেতে হতো। আমাকে হোমওয়ার্ক করতে হবে। আমার মতো আট বছরের একটি ছেলের প্রচুর এনার্জি ছিল। রাত ৯টার দিকে আমি ঘুমাতে যেতাম। পরদিন আমাকে আবার আরো আরো পড়াশোনা করতে হবে। কাগজ বিলির কাজও করতে হবে।
এই রুটিন এক বছর ধরে আমাকে মেনে চলতে হলো। এক বছর কাগজ বিলির কাজ করে আমি যেন বড়সড় হয়ে পড়লাম, আমার অনেক অভিজ্ঞতাও হলো। আমি আরো জানতে পারলাম যে আমি এখন সঠিকভাবে বিচারবিবেচনা করতে পারি। আমার নিজের হাতে এক বান্ডিল কাগজ বিভিন্ন এলাকায় বিলিবন্টন করতে পারি প্রত্যেক দিন। সামুদ্দিনের কাগজের গ্রাহকদের কাছ থেকে হিসাবপত্র মিলিয়ে দিনের হিসাব মতো কাগজের দাম তাকে মিটিয়ে দিতে পারি। আমি শিখতে পারলাম একজন কাজের লোককে প্রতিদিন কী কী কাজ করতে হয়। হোমওয়ার্ক, শিক্ষকের কাছ থেকে পাঠ গ্রহণ, নামাজ পড়া আমি সঠিক ভাবে চালিয়ে যেতে পারলাম। মাদ্রাজ—- ধনুশকোদি মেইল আমার জন্যে অপেক্ষা করলো না। আমাকে সঠিক সময়ে স্টেশনে অপেক্ষা করে সঠিক জায়গা থেকে কাগজের বান্ডিল গ্রহণ করতাম। এটাই ছিল আমার জীবনে প্রথম একটি দায়িত্ব পালন করা। আমি সামসুদ্দিনের কথা মতো কাজ করতে ব্যত্যয় ঘটাইনি। এই সময়টা আমার জন্য উপভোগ্যও ছিল। ওই কাজের প্রতি মুহূর্তকে পছন্দ করতাম। এ সব সত্ত্বেও আমি প্রত্যেক রাতেই ক্লান্ত হয়ে পড়তাম। মা আমাকে অতিরিক্ত কাজ করতে নিষেধ করতেন, কিন্তু আমি মাথা নাড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে হাসতাম। আমার আয় থেকে সংসারের কিছুটা হলেও সাহায্য হচ্ছিল। মা আমার কাজের জন্য ভেতরে ভেতরে গর্বিত ছিলেন আট বছরের একটি ছেলে কাজে পরও মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলায়।
মনোজিৎ কুমার দাস : প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, গল্পকার ও কবি
email:monojitdas1947@gmail.com