তানজিনা ইভা : ‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,/সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে/অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধুসর জগতে/সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;/আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,/আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।’
এই বিখ্যাত ও জনপ্রিয় লাইন কটির স্রষ্টা জীবনানন্দ দাশ। প্রকৃতি যার কবিতায় ফুটে আছে তৈলচিত্রর মতো।আমাদের চারপাশকে তার ভাবনার সঙ্গে এক অপূর্ব সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন। যা তাকে কবিতার ভূবণে আলাদা বৈশিষ্টমন্ডিত করে রেখেছে।চারপাশের খুব সাধারণ দৃশ্যপটকে কতটা অসাধারণ করে তুলেছেন তার আরেক উদাহরণ-
‘হায় চিল, সোনালী ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে/তুমি আর কেঁদো নাকো উড়ে-উড়ে ধানসিঁড়ি নদীটির পাশে!/তোমার কান্নার সুরে বেতের ফলের মতো তার ম্লান চোখ মনে আসে!/পৃথিবীর রাঙা রাজকন্যাদের মতো সে যে চলে গেছে রূপ নিয়ে দূরে;/আবার তাহারে কেন ডেকে আনো? কে হায় হৃদয় খুঁড়ে/বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!/হায় চিল, সোনালী ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে/তুমি আর উড়ে-উড়ে কেঁদো নাকো ধানসিঁড়ি নদীটির পাশে!’
সাহিত্যের ভূবনে আলোড়ন সৃষ্টিকারী বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাংলা কবি জীবনানন্দ দাশের ৬১তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ।১৯৫৪ সালের আজকের এই দিনে তিনি কলকাতার শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। এর আগে কবি কলকাতার বালিগঞ্জে এক ট্রাম দূর্ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন।
জীবনানন্দ দাশের জন্ম ১৮৯৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি বরিশালে। তিনি ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাংলা কবি। তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার অন্যতম পথিকৃত। রবীন্দ্র-পরবর্তীকালে বাংলা ভাষার প্রধান কবি হিসাবে তিনি সর্বসাধারণ্যে স্বীকৃত।
জীবনানন্দ ১৯১৯ সালে কলকাতার নামকরা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্সসহ বি.এ. পাশ করেন। ওই বছরেই ‘ব্রাহ্মবাদী’ পত্রিকার বৈশাখ সংখ্যায় তার প্রথম কবিতা ছাপা হয়। কবিতাটির নাম ছিল ‘বর্ষ আবাহন’। কবিতাটিতে কবির নাম ছাপা হয়নি। তবে পত্রিকার বর্ষশেষের নির্ঘণ্ট সূচিতে তার পূর্ণ নাম ছাপা হয় শ্রী জীবনানন্দ দাশগুপ্ত, বিএ।
১৯২৭ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরা পালক’ প্রকাশিত হয়। সে সময় থেকেই তিনি `দাশগুপ্তের` বদলে `দাশ` লিখতে শুরু করেন।তিনি কেমন কবি তা নিজেই লিখেছেন কাব্য ‘ঝরা পালকে’ প্রকাশিত ‘আমি কবি- সেই কবি’ কবিতায় :
‘আমি কবি– সেই কবি,– /আকাশে কাতর আঁখি তুলি হেরি ঝরা পালকের ছবি! /আন্মনা আমি চেয়ে থাকি দূর হিঙুল-মেঘের পানে! /মৌন নীলের ইশারায় কোন্ কামনা জাগিছে প্রাণে! /বুকের বাদল উথলি উঠিছে কোন্ কাজরীর গানে! /দাদুরী-কাঁদানো শাঙন-দরিয়া হৃদয়ে উঠিছে দ্রবি! /স্বপন-সুরার ঘোরে /আখের ভুলিয়া আপনারে আমি রেখেছি দিওয়ানা ক’রে! /জন্ম ভরিয়া সে কোন্ হেঁয়ালি হল না আমার সাধা– /পায় পায় নাচে জিঞ্জির হায়, পথে পথে ধায় ধাঁধা! /-নিমেষে পাসরি এই বসুধার নিয়তি-মানার বাধা /সারাটি জীবন খেয়ালের খোশে পেয়ালা রেখেছি ভ’রে!’
১৯৩০ সালের ৯ মে তিনি লাবণ্য দেবীর সাথে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ে হয়েছিলো ঢাকায়। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে কবির প্রথম সন্তান মঞ্জুশ্রীর জন্ম হয়। বেকারত্ব, অর্থসঙ্কট কবিকে বিচলিত করেছে বারবার। যার জন্য একদিকে যেমন সংগ্রাম করেছেন, অন্যদিকে হতাশাও গ্রাস করছিল তাকে। এই দোলাচলের জীবনেও তার রচনাসম্ভার বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ।
১৯৩৫ সালে জীবনানন্দ তার পুরনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্রজমোহন কলেজে ফিরে যান, যা তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ছিল। তিনি সেখানকার ইংরেজি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন।
জীবনানন্দ দাশের মা কুসুমকুমারী দাশও ছিলেন প্রতিভবান। তার সুপরিচিত কবিতা ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/ কথায় না বড় হয়ে কাজে বড়ো হবে’ কে না জানে! জীবনানন্দের পিতা সত্যানন্দ দাশগুপ্ত ছিলেন বরিশাল ব্রজমোহন স্কুলের শিক্ষক এবং ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র ‘ব্রাহ্মবাদী’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক।
তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে : ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ (১৯৩৬), ‘মহাপৃথিবী’ (১৯৪৪), ‘সাতটি তারার তিমির’ (১৯৪৮), ‘রূপসী বাংলা’ (রচনাকাল ১৯৩৪, প্রকাশকাল ১৯৫৭) ‘বেলা অবেলা কালবেলা’ (১৯৬১)।
জীবনানন্দ দাশ উপন্যাসও লিখেছেন। উল্লেখযোগ্য উপন্যাসসমূহ হলো : ‘মাল্যবান’ (১৯৭৩), ‘সুতীর্থ’ (১৯৭৭), ‘জলপাইহাটি’ (১৯৮৫), ‘জীবনপ্রণালী’, ‘বাসমতীর উপ্যাখ্যান’ ইত্যাদি। তার গল্পের সংখ্যাও প্রায় দুই শতাধিক। ‘কবিতার কথা’ (১৯৫৫) নামে একটি মননশীল ও নন্দনভাবনামূলক প্রবন্ধগ্রন্থও আছে তার।
১৯৫২ সালে তার জনপ্রিয় কবিতার বই ‘বনলতা সেন’ পরিবর্ধিত আকারে প্রকাশিত হয়। বইটি পাঠকানুকূল্য লাভ করে এবং নিখিল বঙ্গ রবীন্দ্রসাহিত্য সম্মেলন-কর্তৃক ঘোষিত ‘রবীন্দ্র-স্মৃতি পুরস্কার’ জয় করে। ১৯৫৪ খৃস্টাব্দের মে মাসে প্রকাশিত হয় ‘জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা’। বইটি ১৯৫৫ খৃস্টাব্দে ভারত সরকারের সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করে।
রূপসী বাংলার এই কবির মৃত্যুবার্ষিকীতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি। কবি তার সৃষ্টিকর্মের মধ্য দিয়ে যুগে যুগে বাংলার মানুষের মনে চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।