আপোষহীন আসফউদদৌলা রেজা ॥ নাজনীন মহল অঞ্জনা

নীতির কাছে আপোষহীন যে মানুষটি সকল মহলের শ্রদ্ধা আর ভালবাসার পাত্র, যে মানুষটি নিরীহ অসহায় মানুষের মাথার উপর বটবৃক্ষের ছায়াতল, যে মানুষটি পেশাগত নিষ্ঠা লোভ-মোহ বর্জিত সমাজ সেবা, দেশপ্রেম সহ জীবনের নানা ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ মানুষের দৃষ্টান্ত, মৃত্যুর মধ্যদিয়ে সে মানুষটির সঙ্গে চির বিরহ রচিত হয়েছিল ১৪ ফেব্রুয়ারী ১৯৮৩ সালে।

সেদিন ছিল পহেলা ফাল্গুন। সকাল ৮.৩০ মিনিটে ঢাকা সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে চিকিৎসা বোর্ডের ডাক্তারদের সবরকম চেষ্টা ব্যর্থ করে চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে গেলেন সাংবাদিকতা জগতের প্রিয় রেজা ভাই আর বেতার জগতের গ্রাম- বাংলার প্রিয় আসফ ভাই।

পুরো নাম রেজাউল মুস্তফা, মুহম্মদ আসফ-উদ দৌলা রেজা। বেতার ও টেলিভিশনে বিশেষ ঘোষনায় মৃত্যু সংবাদটি বারবার জানানো হচ্ছিল দেশবাসীকে সবার হৃদয়কে আহত করেছিল এ মৃত্যু। প্রবল ব্যক্তিস্বার্থ আর আত্মকেন্দ্রিকতায় আচ্ছন্ন এক সমাজ ব্যবস্থায় মুহঃ আসফ-উদ দৌলা ছিলেন ব্যতিক্রমী মানুষ। দেশ জাতি ও সমাজ কল্যান ছিল তাঁর অন্যতম ব্রত। পেশাগত জীবনে সাংবাদিকের কলমে সে ব্রত অক্ষুন্ন রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন সার্থক ভাবে। মাথা উঁচু করে সরকারী মহল ও শক্তিশালী মহলের চাপ ও হুমকির মোকাবেলা করেছেন বারবার।

বেশ কয়েকবার চাকুরীচ্যুত হয়ে আর্থিক অনটনে পড়েও নির্ভীক স্বাধীন ও আদর্শ নিষ্ট এই মানুষটি কোন শক্তির কাছে যেমন মাথা নত করেননি-তেমনি কোন লোভ ও ব্যক্তিস্বার্থে কখনও বিবেক বির্সজন দেননি। নীতি আদর্শের কাছে তার ছিল চির উন্নত শির। জীবনের নানা ক্ষেত্রে বিস্তৃৃত বিষ্ময়কর এই মানুষটি ছিলেন অনুকরনীয় অনুসরনীয় দৃষ্টান্ত। তাঁর যোগাযোগের ব্যাপ্তি ছিল দেশের শীর্ষ স্থানীয় ব্যক্তি থেকে দিন মজুর সবার সঙ্গে। বসবার ঘরটিতে শিল্পী সাহিত্যিক সাংবাদিক, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, দারোয়ন, পিয়ন, সুইপার সবার প্রবেশাধিকার ছিল।

দেশের তরুন যুবকদের সঙ্গে ছিল স্নেহ-শ্রদ্ধা আর বন্ধুত্বের অপূর্ব সমন্নয়। উদ্যমী, সাহসী, পরিশ্রমী সংগঠক হতে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করতেন তরুনদের। প্রবীণদের উপদেশ অভিজ্ঞতা শিরোধার্য করে নিজের চলার পথকে সুগম করেছেন।

১৯২৬ সালে বৃটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনীতিকদের মিলন ক্ষেত্র  সিরাজগঞ্জের ঐতিহাসিক “বানীকুঞ্জে” জন্ম গ্রহন করেন তিনি। নিজ পরিবারের কাছেই পেয়েছেন শিক্ষা স্বাধীনতা আপোষহীনতার প্রথম দীক্ষা। দানবীর (মহারানী ভিক্টোরিয়া প্রদত্ত) মানিক উদ্দীন সরকারের বিত্ত-বৈভব আর অগ্নিপুরুষ সৈয়দ ইসমাইল হোসেন শিরাজীর যশঃ-গৌরবের ঐশ্বর্যে লালিত বর্ধিত হয়েছেন।

গৌরবময় শৈশব-কৈশোর কেটেছে কীর্তিনাম মহাপুরুদের স্নেহময় সান্নিধ্যে। বর্নাঢ্য জীবনে ছিলেন শিক্ষক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, অনুবাদক, ব্রডকাষ্টার, বক্তা, আবৃত্তিকার, ও ভাষ্যকার। অভিনয়ে সুনাম অর্জন করেছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিনিত কালিন্দী নাটকে অহীনের চরিত্রে অভিনয় করে সম্বর্ধিত হয়েছিলেন।

প্রথম বাংলা ছায়াছবি ‘মুখ ও মুখোশ’ এ নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করার বিশেষ অনুরোধ এসেছিল। স্বপন কুমার ছদ্মনামে গোয়েন্দা সিরিজ দস্যু মিহির বিপুল জনপ্রিয় হয়েছিল সে সময়। জাতীয় নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যু সংবাদটি প্রথম রেডিওতে ঘোষণা আর মৃতদেহ বিমানবন্দর থেকে লক্ষ মানুষের ভীড় ঠেলে হাইকোর্ট প্রাঙ্গনে পৌছাতে ৭/৮ ঘন্টার ধারা বিবরনীর কন্ঠ ছিল মুহঃ আসফ-উদ দৌলা রেজার।

১৯৫১ সালে দৈনিক আজাদে কর্মজীবন শুরু হলেও সরকারী তোষননীতিতে আপোষ করতে না পেরে ১৯৫৫ সালে দৈনিক ইত্তেফাকে যোগ দিয়ে মৃত্যু অবধি জড়িয়ে ছিলেন ইত্তেফাকেই। ২৫ মার্চ কালরাত্রীতে ধ্বংস স্তুপে পরিনত হল ইত্তেফাক, অলৌকিক ভাবে বেঁেচ গেলেন আসফ-উদ দৌলা রেজা ও সিরাজউদ্দীন হোসেন (শহীদ)। তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার অবর্তমানে যোগ্য উত্তরসুরী হিসাবে আসফউদ-দৌলা রেজা ও সিরাজ উদ্দীন হোসেনের সাহসী কলমে ইত্তেফাক হয়ে উঠেছিল জনগনের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের মুখপত্র।

naznin-mohol-anjona
ছবি : বর্তমানে নিজ পরিবারে ‍একান্ত আপনজনদের সঙ্গে আসাফ ‍উদ দৌলা রেজার কন্যা নাজনীন মহল অঞ্জনা

৭১’র ১৪ ডিসেম্বর প্রাণপ্রিয় সহপাঠীবন্ধু সহকর্মী সিরাজউদ্দীন হোসেনকে হারিয়ে দাঁড়ালেন তাঁর শিশু সন্তানদের পাশে আর কাঁধে তুলে নিলেন ধ্বংসস্তুুপ থেকে ইত্তেফাককে গড়ে তোলার দায়িত্ব।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ঢাকা শহরে পাকিস্তানী সেনাদের কড়া নজরে থেকেও সত্যিকার মুক্তিযোদ্ধা হয়ে কাজ করেছেন। ব্যাপক ঝুঁকি জেনেও মুক্তিযোদ্ধাদের তথাকথিত “ডান্ডিকার্ড” সরবরাহ করছেন। প্রায়ই ঘরে মুক্তিযোদ্ধা থাকা অবস্থায় ঘর্মাক্ত ও বিচলিত মানষিক বির্পযয়ে পাকিস্তানী সেনাদের মোকাবেলা করেছেন সুকৌশলে। বালিশের ভেতরে ক্যাসেট, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ইত্যাদি জিনিস পাঠাতেন। ফকির সেজেও কত মুক্তিযোদ্ধা এসেছে বাসায়।

যে মানুষটি জীবনের সবটা সময় ব্যয় করলেন সাংবাদিকতায়, দেশের কল্যানে, সামাজিক উন্নয়নে, পরোপকারে। এই বেহিসাবী কর্তব্য নিষ্ঠার ফলে সংসার হয়েছিল বঞ্চিত। সৎ সামর্থের বাহিরে কিছু করার ইচ্ছে ও ছিলনা, ফলে নগদ অর্থ, এক খন্ড জমি কিছুই রেখে যায়নি সন্তানদের জন্য। দুঃখবোধ তো নেই-ই বরং গর্বিত সন্তানরা। কারন একজন সৎ, সাহসী, নির্লোভ আদর্শ মানুষের সন্তান হিসাবে এখনও মানুষের স্নেহ-শ্রদ্ধা-ভালবাসা পাই অনায়াসে। দুঃখ হয়, যখন আত্ম-প্রচারে ব্যস্ত স্বনামধন্য লেখকদের কলম যথাস্থানে আসফ-উদ দৌলা রেজা নামটি এড়িয়ে যায়।

 

নাজনীন মহল অঞ্জনা    আসফউদদৌলা রেজার কন্যা

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts