একটা স্বপ্ন ও গ্লোবাল ইয়ুথ কনফারেন্স ২০১৫

আব্দুল্লাহ আল কাইয়ুম কাফি, জাপান থেকে ফিরে : শুরুটা ২০০৫ সালে। কালীগঞ্জ ইয়ুথ এগেইনস্ট হাঙ্গার ইউনিটের সাধারণ সদস্য হিসেবে। পরে পড়াশোনার সুবাদে ঢাকাতে ২০১০ সাল থেকে বাংলাদেশ জাতীয় কমিটির সঙ্গে কাজ করা শুরু।

বর্তমানে ইয়ুথ এগেইনস্ট হাঙ্গার বাংলাদেশ জাতীয় কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছি এবং ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগে অধ্যয়নরত। দশ বছরের বেশি সময় ইয়ুথ এগেইনস্ট হাঙ্গারের সঙ্গে। এসময় অনেকে অনেক নেগেটিভ কথাবার্তা বলেছে। তবুও মনোবল হারায়নি। জাপান থেকে যখন কোনো কর্মকর্তা কিংবা ইয়ুথ সদস্য প্রজেক্ট অফিস পর্যবেক্ষণ করতে আসত তখন থেকেই স্বপ্ন দেখতাম গ্লোবাল অফিসে  যাবার। জাপানের ইয়ুথ সদস্যদের সঙ্গে সরাসরি কাজ করার। স্বপ্নের স্বার্থকতা আসে এবছরের আগস্টে। ২০-২৮ আগস্ট  গ্লোবাল ইয়ুথ কনফারেন্স ২০১৫ তে আমার অংশগ্রহণের মাধ্যমে।

 যখন বাংলাদেশ থেকে আমাকে নির্বাচন করা হলো, চোখ বন্ধ করে আল্লাহকে স্মরণ করে প্রিয় মানুষগুলোর মুখ এবং ইয়ুথ এগেইনস্ট হাঙ্গারের সঙ্গে কাটানো পেছনের ১০ বছরের কথা মনে করলাম। বাংলাদেশ, উগান্ডা, বেনিন, ব্রুখিনা-ফাসোসহ জাপানের বিভিন্ন প্রদেশর  মোট ৩০ জন ইয়ুথ সদস্য অংশগ্রহণ করেছিল এবারের কনফারেন্সে।

গ্লোবাল ইয়ুথ কনফারেন্স দুই বছর পরপর হয়। যেখানে ইয়ুথ এগেইনস্ট  হাঙ্গারের সবদেশের ইয়ুথ প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করে। আর তার আয়োজন করে হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ড জাপান অফিস। এবারের কনফারেন্সের আলোচ্যসূচি ছিল- activity report from all country, seminar on current trends of international cooperation, program for raising awareness on eradication of hunger and poverty, workshop on methodology of effective program implementation, pre-event for world food day 2015 at jica, School visit in Fukushima.

১৮ আগস্ট দুপুরে রওনা হয়ে পরদিন সকালে জাপানের নারিতা এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেখি বাংলাদেশ অফিস ইনচার্জ এরিকো সান আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। আতিথেয়তার শুরু এখান থেকেই। থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল টোকিও সেন্ট্রাল ইয়ুথ হোস্টেলে। এয়ারপোর্ট থেকে হোস্টেলে পৌঁছে ব্যাগ রেখে এরিকো সানের সঙ্গে সরাসরি চলে গেলাম হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ডের হেড অফিসে। আমিই সর্বপ্রথম পৌঁছে ছিলাম। অফিসের সবার সঙ্গে পরিচিতি পর্ব শেষে স্বপ্ন পূরণের আশায় নিজে থেকেই কনফারেন্সের প্রস্তুতিমূলক কাজে লেগে গেলাম জাপানের ইয়ুথ সদস্যদের সঙ্গে। একপর্যায়ে আমাকে একটা পোস্টার তৈরি করতে বলা হলো বিভিন্ন রঙের কলম ব্যবহার করে। আমি বললাম কম্পিউটারে কম্পোজ করে প্রিন্ট দিলেইতো ভাল হয়। কিন্তু জবাব আসলো কম্পিউটারে করলে সময় লাগবে বেশি। হাতে অল্প সময়ে হয়ে যাবে। প্রমাণ পেলাম সময়নিষ্ঠার। তারপর হাতে করার পর দেখলাম ২ মিনিটে শেষ এবং পোস্টারটা বেশি সুন্দর লাগছে। প্রথমদিন দূপুরে খেতে গিয়ে একটু বিপাকেই পড়তে হলো। সব জাপানি খাবার। কিন্তু আমি বাঙালি খাবারে অভ্যস্ত। পরে জাপানি বন্ধুদের সহায়তায় চপস্টিক ব্যবহার করে জাপানি নুডুলসের মাধ্যমে জাপানি খাবার খাওয়া শুরু হলো। নতুন কিছু খেতে বা শিখতে বরাবর আমার আগ্রহটা একটু বেশি। জাপান ট্যুরের পুরো সময়টাতে জাপানি নুডুলস, পিজা, পাসটা, রাইচবল, শুসি, সবজি, সুপ, সি-ফুডসহ বিভিন্ন ধরনের জাপানি খাবার খাওয়ার চেষ্টা করছি চপস্টিক ব্যবহার করে। আরো কিছু প্রস্তুতিমূলক কাজের মাধ্যমে সারাদিন কাটালাম। বিভিন্ন নতুন উপায়ে কাজের মধ্যে ঘুম বা ক্লান্তি জিনিসটা কি ভুলেই গিয়েছিলাম। চার ঘণ্টার বেশি কোনোদিনই ঘুমায়নি।

২০ আগস্ট দুপুরের মধ্যেই সবদেশের অংশগ্রহণকারীরা উপস্থিত হয়। লাঞ্চের পর অভ্যর্থনার  মাধ্যমে সবার সঙ্গে পরিচিতি এবং কনফারেন্সের বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়। ২১ অগাস্ট থেকে মূল কনফারেন্স শুরু হয়।

ইয়ুথ এগেইনস্ট হাঙ্গার বাংলাদেশের উপস্থাপনা করার আগেই বিভিন্ন দোভাষি ও কর্মকর্তাদের কাছ থেকে উৎসাহ এবং প্রশংসা পেলাম। কারণ ই-মেইলের মাধ্যমে সব কিছু আগেই পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। বাংলাদেশ থেকে আমি একা গেলেও ভিডিও ডক্যুমেন্টারির মাধ্যমে সবার অংশগ্রহণ রেখেছিলাম এবং সুন্দরভাবে ইয়ুথ এগেইনস্ট হাঙ্গার বাংলাদেশকে তুলে ধরেছিলাম। এছাড়া জাইকা, স্কুল পরিদর্শন, গ্রুপ কার্যক্রমসহ অন্যান্য সেশনে সমাজের উন্নয়নে যুবকদের ভূমিকা, বাংলাদেশে যুবকদের উপর ক্ষুধা-দারিদ্র্যের প্রভাব, ক্ষুধা-দারিদ্র্যের সমস্যা ও সমাধান এবং ক্ষুধা-দারিদ্র্য দূরীকরণে ইয়ুথ এগেইনস্ট হাঙ্গার বাংলাদেশের কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা করেছি।

প্রতিটা সেশন এবং গ্রুপ কার্যক্রমে আমি অবদান রাখার চেষ্টা করেছি। সেশন শুরু হবার আগে আব্বু-আম্মুসহ  দেশে কথা দিয়ে যাওয়া কিছু মানুষ বিশেষ করে আমার ইউনিভার্সিটির চেয়ারম্যান সবুর খান  স্যার, উপাচার্য ড. ইউসুফ এম ইসলাম স্যার, প্রিয় ফারহানা ম্যাম এবং হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ড এর কান্ট্রি ডিরেক্টর মিটন ভাইয়া ও প্রোগ্রাম ডিরেক্টর আঞ্জু আপুর কথা মনে করতাম। মনে মনে বলতাম কথা দিয়ে এসেছি এবং দেশের সম্মান যেহেতু আমার হাতে সুতরাং আমাকে ভাল করতেই হবে। প্রতিটা সেশনে আমার মতামত গ্রহণযোগ্যতা পেত। বিদায় অনুষ্ঠানে আমার বলা কথাগুলো উল্লেখ করে যখন আমন্ত্রিত অতিথিরা কথা বলল এবং ধন্যবাদ দিল আমাকে। অনুষ্ঠানের শেষে ই- মেইল এবং ফেসবুক বার্তার মাধ্যমে অনেকে আমার সঙ্গে আরো কথা বলার আগ্রহ দেখাল এবং শুভ কামনা জানালো। তখন মনে হলো দেশে যে মানুষগুলোকে কথা দিয়ে গিয়েছিলাম সেটা রাখতে পেরেছি।

২৫ ও ২৬ আগস্ট ক্যাজুয়াল সেশন ছিল। ওই দুইদিন টোকিও সহ বেশ কিছু জায়গায় গেছি। আকিহাবারা, কাশুয়া, আছাকাছা, শিবুয়া, টোকিও স্কাই ট্রি। আতিথেয়তা ও আন্তরিকতার দিক থেকে কোনো অংশে বাংলাদেশের থেকে কম নয় জাপান।

অন্যরা যখন তাদের দেশের কথা  বলছিল আমি তখন ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা বর্ণনা করেছি। কিভাবে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করছি, ছবি তোলার সময় একা বাঙালি হয়েও আমার দেশের পতাকা সবাই একসঙ্গে উঠিয়ে ছবি তুলেছি। লাল-সবুজের ব্যাখ্যা দিয়েছি। ওরা যখন ওদের ঋতুর কথা বলছিল, তখম আমার দেশের ছয় ঋতুর বৈশিষ্ট্যসহ বর্ণনা করেছি। ওরা যখন ওদের দর্শনীয় স্থানের বর্ণনা করছিল, আমি তখন Beautiful Bangladeshয সহ অন্য Video Documentary এর মাধ্যমে পুরো বাংলাদেশকে সবার সামনে গর্বের সঙ্গে উপস্থাপন করেছি। বিদায় অনুষ্ঠানের দিন সবাইকে বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যাওয়া আমসত্ত, বিস্কুট ও পাটের তৈরি স্মারক উপহার দিয়েছি এবং ব্যাখ্যা করেছি। এছাড়া আমার ইউনিভার্সিটির পক্ষ্য থেকে ইউনিভার্সিটির স্মারক উপহার সব দেশের প্রতিনিধিদের দিয়ে আমার দেশ, সংগঠন ও বিশ্ববিদ্যালয়কে গর্বের সঙ্গে তুলে ধরেছি এবং গর্বের সঙ্গে বলেছি  ‘আমি গর্বিত আমি বাংলাদেশি’।

জাপানি বন্ধুগুলো যখন একে একে হোস্টেল ত্যাগ করছিল বুকটা খাঁ খাঁ করে উঠছিল। ২৯ তারিখ সকালের ফ্লাইট ধরে বাংলাদেশে ফিরে আসলাম। সভ্যতার দিক থেকে এখনো আমরা অনেকে পিছিয়ে, অনেক কিছু শেখার আছে আমাদের। সবগুলো সেশন এবং স্থান থেকে কিছু না কিছু শিখেছি। সেগুলো আমি আমার দেশে এবং যুবসমাজের মধ্যে প্রয়োগ করতে চায়। ইতিমধ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছি।

আমি বিশ্বাস করি আমাদের দেশের যুবসমাজের মধ্যে অনেক সম্ভাবনা আছে এবং আমরাও অনেক কিছু করতে পারি। অনেকে বলে যুবসমাজ ভবিষ্যৎ নেতা। কিন্তু আমি মনে করি আমরা বর্তমানের নেতা। এখন যদি আমরা ভাল না করতে পারি তাহলে ভবিষ্যতে ভাল করব কিভাবে?  আমরাও পারি ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত বিশ্ব গড়ার স্বপ্ন দেখতে। আমরা স্বপ্ন দেখতে পারি, স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারি। এজন্য আমাদের জন্য সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। একা কোনো কিছুই সফলভাবে করা সম্ভব না। আমাদের সবাইকে একসঙ্গে চিন্তা করতে হবে এবং একসঙ্গে কাজ করতে হবে। তাহলে আমরাই পারব সুন্দর একটি বিশ্ব গড়তে। যেখানে থাকবে না ক্ষুধা, দারিদ্র, হানাহানি।

 

 

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts