বিডি মেট্রোনিউজ ডেস্ক॥ দু’জনের প্রেম তিন দশকের। এক জন সমাজের সব গ়ঞ্জনা সহ্য করেও বাঁচিয়ে রেখেছেন কৈশোরের প্রেম। অন্য জন সেই প্রেমের জন্যই লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে হয়ে উঠেছেন পুরুষ!
মধ্য চল্লিশে পৌঁছে শেষ পর্যন্ত বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন অসমের মরিগাঁও জেলার বাসিন্দা রূপালি দেবী ওরফে রূপকুমার নাথ এবং রূপরেখা বরা। কিন্তু লিঙ্গ পরিবর্তন করেও শেষ রক্ষা হয়নি। আইনি জটিলতায় আটকে গিয়েছে তাঁদের বিয়ে। এখন বিবাহে স্বীকৃতি চেয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন তাঁরা।
এ দেশে ৩৭৭ ধারায় সমকামী সম্পর্ক ও বিয়েকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। কিন্তু যিনি ইতিমধ্যেই পুরুষ হয়ে গিয়েছেন, তাঁর সঙ্গে অপর এক মহিলার বিয়েতে বাধা কোথায়? এই প্রশ্নটা উঠছে। ব্যাখ্যা দিয়েছেন জাতীয় রূপান্তরকামী (ট্রান্সজেন্ডার) বোর্ডের সদস্য রঞ্জিতা সিংহ। তাঁর কথায়, ‘‘লিঙ্গ পরিবর্তন করে বিয়ের বিষয়টিও ৩৭৭ ধারা বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে মিশে গিয়েছে। সমকামী, রূপান্তরকামী বা রূপান্তরিতদের কিছু অধিকারকে এ দেশের সরকার স্বীকৃতি দিলেও তাঁদের বিয়েতে স্বীকৃতি দেওয়া নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি এখনও। তাই এ ক্ষেত্রে আইনি সমস্যা দেখা দেয়। এই ধরনের অনেক আবেদন জমা পড়ছে। আশা করি শীঘ্রই এ বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’’ তিনি অবশ্য জানিয়েছেন, অস্ত্রোপচার করে পুরোপুরি পুরুষ হওয়ার পরে হলফনামার মাধ্যমে নাম বদল করে সাধারণ প্রক্রিয়ায় ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের কাছে বিয়ের নোটিস দেওয়া যেতেই পারত। কিন্তু রূপালি ও রূপরেখার সমকামিতার ইতিহাস সকলের জানা থাকায় তাঁরা সমস্যায় পড়ছেন।
প্রবীণ আইনজীবী বিশ্বজিৎ দেবও বলেন, ‘‘পুরুষ হয়ে যাওয়ার পরে রূপকুমার স্বাভাবিক নিয়মেই বিয়ে করতে পারতেন। কিন্তু যে হেতু রূপান্তরকামীদের বিষয়টি সুপ্রিম কোর্ট এবং সংসদে ঝুলে রয়েছে, তাই সকলে এ ক্ষেত্রে দায় এড়াতে চাইছে।’’
মরিগাঁওয়ের দন্দুয়া গ্রামের রূপালি আর রূপরেখার আলাপ তিরিশ বছর আগে, স্কুলে। রূপকুমার জানান, রূপারেখাকে ভাল লাগত তাঁর। ১৯৮৭ সালে প্রেমের প্রস্তাব দেন তিনি। আপত্তি করেননি রূপরেখাও। পড়াশোনার পাশাপাশি চলতে থাকে তাঁদের গোপন প্রেম। এতগুলো বছর পরে তাঁরা অবশ্য আর লুকিয়ে থাকতে নারাজ। সমাজের সব ভ্রূকুটি উড়িয়ে সাহসের সঙ্গেই মুখোমুখি হয়েছেন সংবাদমাধ্যমের।
২০১৩ সালে অস্ত্রোপচার করে পুরুষ হন বছর পঁয়তাল্লিশের রূপালি। নতুন নাম নেন রূপকুমার। রূপরেখার বয়স এখন ৪৭। এর মধ্যে দু’জনেই সরকারি স্কুলে চাকরি পেয়েছেন। এক সময় রূপরেখার বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য চাপ দেওয়া শুরু হয়। কিন্তু নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থেকেছেন তিনি। রূপালির কথা বাড়িতে জানান রূপরেখা। মায়ের মৃত্যুর পর একাই থাকা শুরু করেন।
২০১০ সালে লিঙ্গ পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন রূপালি। এখনকার রূপকুমার বললেন, “প্রথমে দিল্লির এক হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগ করি। প্রথম দু’বছর মনোচিকিৎসকের কাছে পুরুষ হয়ে ওঠার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তখন খুব অধৈর্য লাগত। ভাবতাম কবে পুরোপুরি পুরুষ হতে পারব। ২০১৩ সালে সল্টলেকের একটি হাসপাতালে অস্ত্রোপচার পর্ব শুরু হয়। কয়েক দফা অস্ত্রোপচারের পরে এখন আমি অনেকটাই পুরুষ। দাড়ি গজিয়েছে। বদলাচ্ছে গলার স্বর।” কিন্তু স্বর বদলে যাওয়ায় গান গাওয়ায় সমস্যা হচ্ছে তাঁর। স্কুলে ছাত্রছাত্রীরা তাঁকে ‘স্যর’ ডাকবে না ‘ম্যাডাম’, তা নিয়েও চলছে টানাপড়েন। রূপকুমার তাদের শুধু ‘টিচার’ বলে ডাকতে বলেছেন।
রূপকুমারের বোন ও ভগ্নীপতি এই যুগলকে সঙ্গ দিলেও, আত্মীয়দের অনেকেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। কেউ কেউ তো সোজা মুখের উপর বলেই দিয়েছেন, প্রকৃতির বিরুদ্ধে গিয়ে ঘোরতর অন্যায় করছেন তাঁরা। রূপকুমার অবশ্য বলেন, ‘‘বিজ্ঞান তো সামনে এগোতে শেখায়, আমরাও সামনের দিকেই এগিয়েছি।’’ রূপরেখার বক্তব্য, “আমাদের সব সময় লোকে একসঙ্গেই দেখে। অনেকেই মজা করে, কটূক্তি করে। পাত্তা দিই না। শুধু আদালতের অনুমতি পেলেই বাকি জীবনটা সুখী দম্পতি হিসেবে কাটাতে চাই। স্বপ্ন ছিল আমি গান লিখব, রূপালি সুর দেবে। আমরা রেডিওতে গাইব। তা পূরণ হয়নি। জীবনে ভালবাসার অনেক মূল্য চোকাতে হল।” স্বামী হয়ে ওঠার জন্য রূপালি জীবনের সব সঞ্চয় খরচ করার পাশাপাশি ৬ লক্ষ টাকা ঋণও নিয়েছিলেন। এখনও পর্যন্ত অস্ত্রোপচার বাবদ তাঁর খরচ হয়েছে প্রায় ১৪ লক্ষ টাকা।
লিঙ্গ পরিবর্তনের পরে রূপরেখাকে বিয়ে করতে চেয়ে রেজিস্ট্রারের কাছে গিয়েছিলেন রূপকুমাররা। গোলমালের শুরু সেখান থেকেই। রূপকুমারের ইতিহাস জানার পর বেঁকে বসেন রেজিস্ট্রার। তাঁর বক্তব্য, আদালতের কাছ থেকে অনুমতি পেলে তবেই তিনি এই রূপান্তরিত পুরুষের আইনি বিয়ে দিতে পারবেন। অগত্যা এখন বিয়ের অনুমতি চেয়ে আদালতে আবেদন জানিয়েছেন রূপকুমার। তাঁদের আশা, আদালত তাঁদের প্রতি সহানুভূতি দেখাবে।
১৪ লক্ষ টাকা খরচ করে চিকিৎসার পরেও রূপকুমার বাবা হতে পারবেন না বলে চিকিৎসকেরা তাঁকে জানিয়েছেন। তাই বিয়ের পরে তাঁরা সন্তান দত্তক নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। রঞ্জিতাদেবী জানান, এখন সরকারি হাসপাতালেও এই ধরনের অস্ত্রোপচার আইনসিদ্ধ। সেখানে অনেক কম খরচে অস্ত্রোপচার সম্ভব। চিকিৎসার পরে রূপান্তরকামী মহিলা পুরুষের মতো প্রজনন অঙ্গও পেতে পারেন। তাঁর সন্তানও হতে পারে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সম্ভবত বয়স বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সমাজের এত বিধিনিষেধ কাটিয়ে মাঝবয়সে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখা যুগল জানালেন, রাজ্যে কেউ যদি এ বিষয়ে সাহায্য চান, তাঁরা হাত বাড়িয়ে দেবেন।
এবিপি আনন্দ