আতাতুর্ক পাশা
গত কয়েক দশকের মধ্যে তেলের মূল্য সবচেয়ে বেশি পড়ে যায় ২০১৩ সালের মে মাসে। এ সময় বিশ্বের বৃহত্তম তেল উৎপাদনকারী দেশ সৌদি আরব ও ইরান অপরিশোধিত তেল ব্যারেলপ্রতি ৩৬ থেকে ৪৬ ডলারে বিক্রি করেছিল। এরই কয়েক মাস আগে অপরিশোধিত তেলের ব্যারেলপ্রতি বাজার মূল্য ছিল ১৫৬ ডলার।
এর পর বিশ্বব্যাপী করোনার কারণে দেশে দেশে জাহাজ ও ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যাবার জন্য উৎপাদনকারী দেশগুলো তাদের উৎপাদিত তেল বিক্রি করতে ব্যর্থ হচ্ছিল। গত এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহের দিকে এমনকি খোদ যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলো তার তেল ভান্ডার খালি করবার জন্য অপরিশোধিত তেলের মূল্য কয়েক ঘণ্টার জন্য ব্যারেলপ্রতি মাইনাস ৩৭ দশমিক ৬৩ ডলারে নামিয়ে আনে। মাইনাস ৩৭ দশমিক ৬৩ বলতে যারা এই তেল ক্রয় করবে, তাদের তো কোন মূল্য দিতে হবে না বরং বিক্রেতা ক্রয়কারীকে ব্যারেলপ্রতি আরো ৩৭ দশমিক ৬৩ ডলার বহন খরচ দেবে। (তথ্য : ইত্তেফাক ২২০৫২০২০)। তবে পরদিন মঙ্গলবার অবশ্য মূল্য চাঙ্গা হয়ে ব্যারেলপ্রতি ১ দশমিক ৩৭ ডলারে বিক্রি হতে থাকে। এখনো বিশ্ববাজারে তেলের তেমন চাহিদা নেই। কারণ অনেক কারখানা এবং পরিবহন ব্যবস্থা সংকুচিত হয়েছে করোনার জন্য।
২০১৩ সালে বিশ্বের বাজারে তেলের মূল্য কমে গেলেও আমাদের দেশে তেলের মূল্য তেমন একটা কমেনি এবং সরকার থেকে বলা হয়েছিল যে, যেহেতু সরকার অনেকদিন থেকেই বেশি মূল্যে তেল এনে কম মূল্যে দেশে বিক্রি করছে এবং বিশাল অংকের টাকা ভর্তুকি দিয়েছে, সে টাকা উঠে আসলেই মূল্য কমিয়ে দেয়া হবে। কিন্তু এসব সুদিন আর আসেনি। দু’একবার পেট্রলের লিটারে দুই-তিন টাকা কমিয়ে দেয়া হয়েছিল মাত্র যা আন্তর্জাতিক বাজার মূল্যের চেয়েও অনেক বেশি। তারপর সে অবস্থাতেই মূল্য বিরাজ করছে। তবে এর পর সরকার কয়েক দফায় বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি করেছে।
সারা বিশ্বে এখন করোনার কারণে পরিশোধিত ও অপরিশোধিত তেলের মূল্য অনেক কম। গত ১ জুন আন্তর্জাতিক বাজারে কমন স্টার্ন্ডাড তেলের ব্যারেল ছিল ৩৪ দশমিক ৮৪ ডলার যা আগের দিনের চেয়ে দশমিক ৬৫ ডলার কম। (তথ্যসূত্র : ইন্টারনেট)। এ অবস্থায় দেশে সীমিত লকডাউনে বাস, ট্রেন ও জাহাজ চলাচল শুরু হলে যাত্রীদের কাছ থেকে কেন বর্ধিত ভাড়া আদায় করা হবে ?
ধরুন ছোট্ট একটি পরিচিত রুটের ভাড়ার কথা বলছি। মিরপুর ৬০ ফিটে টেম্পো চলাচল করে মিরপুর-২ থেকে রেডিও পর্যন্ত। প্রায় ২ কিলোমিটার সড়ক, কিন্তু বাঁধানো। এখানে লকডাউন ও করোনার আগে নেয়া হত মিরপুর-২ থেকে রেডিও পর্যন্ত জনপ্রতি ১২ টাকা। গত ৩০ মে থেকে নেয়া হচ্ছে জনপ্রতি ২০ টাকা করে। এক চালক আমায় বললেন, আগে তারা ১১ জন যাত্রি নিতেন। বর্তমানে করোনার কারণে তাদের ৭ জন নিতে হবে। করোনার কারণে ফাঁকা রাখতে হয় যাত্রিদের মাঝখানের স্থান। কিন্তু তাদের তেল খরচ ও রক্ষণাবেক্ষন খরচ তো আগের মতোই থাকছে, তাই তারা জনপ্রতি ভাড়া বেশি নিচ্ছে। তারা তো পরিস্থিতির শিকার।
জুন মাসের প্রথম দিন থেকে রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে নতুন করে সীমিত আকারে বাস চলাচল করা শুরু করেছে। যাত্রীরাও বিভিন্ন গন্তব্যে বের হয়েছে। কিন্তু লকডাউনের আগেকার তুলনায় এখন বেশি ভাড়া নেয়া শুরু হয়েছে। বিভিন্ন অজুহাত দেখানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে লকডাউন শেষ হয়ে গেলে ভাড়া আবারো পূর্বের মতো কম নেয়া হবে। কিন্তু আমাদের দেশে কোন জিনিসের মূল্য একবার বেড়ে গেলে তা কমার কোন ইতিহাস দেখা যায় না। বাস, মিনিবাস, টেম্পোগুলোর মালিকরা বলছেন, আগে যেখানে একটি আসনে দু’জন যাত্রী নেয়া হতো সেখানে এখন মাত্র একজনকে নেয়া হবে, তাই, একজন যাত্রীকে দু’জনের ভাড়া দিতে হবে, কিন্তু তবুও আমরা দু’টি টিকিটের বদলে মাত্র ৮০% ভাড়া নিচ্ছি। আরো নানা ধরণের অজুহাত। কিন্তু এভাবে ভাড়া আদায় হতে থাকলে যাত্রীদের দুর্ভোগের অন্ত থাকবে না।
সরকার প্রতিবছর বাজেটে বিভিন্ন দ্রব্যের কর বাড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু লবণের মূল্য বাড়লে পরিশেষে তা ক্রেতাদেরই বহন করতে হয়। বিত্তবানদের গাড়ি আমদানীর কর কমিয়ে নিত্যপণ্যের কর বাড়ানো হয়, এমন বাজেটের উদাহরণও রয়েছে। বিত্তবানরা বর্ধিত কর নিজেদের উকিল ধরে আয়কর অফিস থেকে ওকালতির মারপ্যাঁচে কমিয়ে নিচ্ছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের পক্ষে কেউ থাকে না। না উকিল, না আইন, না সরকার।
সম্প্রতি সচিব পর্যায়ে বাস ও মিনিবাস মালিক সমিতি কর্তৃক উত্থাপিত একটি প্রস্তাবনায় ৮০%-এর স্থলে ৬০% বর্ধিত ভাড়া অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এর আদৌ কোন প্রয়োজন ছিল না যদি সরকার একটু সদয় হতেন। কারণ বিশ^ব্যাপী তেলের মূল্য এখন সর্বনিম্ন পর্যায়ে। আমাদের দেশেও একজন সরকারপ্রধান আছেন এবং রাষ্ট্র নিয়োজিত প্রশাসকবৃন্দ আছেন। এর পরও জনগণের ভোগান্তি বেড়ে চলছে কেন! সরকার ইচ্ছে করলেই বর্তমান বাজার মূল্যের কম দরে তেল বিক্রি করে বর্ধিত ভাড়া রোধ করতে পারে।
লেখক: সাহিত্যিক ও কলামিস্ট