মোতাহার হোসেন
আমাদের দেশে আইন-শৃংখলা বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে নানা রকম ধারণা, ভ্রান্ত ধারণা, মতবাদ প্রচলিত আছে। অবশ্য শুধু বাংলাদেশ কেন পুরো বিশ্বেই আইন-শৃংখলা বাহিনী নিয়ে মানুষের ধারণা সুখকর নয়। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশ কর্তৃক একজন কৃষাঙ্গ নাগরিক হত্যার পর শুধু মার্কিন যুক্ত রাষ্ট্র নয়, একই সঙ্গে পুরো বিশ্বকে চরমভাবে নাড়া দিয়েছিল।
তবে করোনাকালে আমাদের দেশের পুলিশ বাহিনীর ভূমিকা সম্পর্কে বিশ্বের প্রচার মাধ্যম সমূহে ব্যাপক প্রশংসা করা হয়েছে। বিশেষ করে করোনাকালে পুলিশের মানবিক এই ভূমিকায় পুলিশ বাহিনীর বীর সদস্যদের স্যালুট জানাই। পাশাপাশি পুলিশের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে আগামি দিনেও মানুষের সুখে-দুখে পাশে থাকবেন এই প্রত্যাশা দেশের আপামর মানুষের।
করোনর এই বৈশ্বিক মহামারিতে পুলিশ তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি করোনায় বিপদগ্রস্ত,গরীব-দুখি মানুষের পাশে মানবতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে ত্রাণ, রোজায় ইফতার সামগ্রী বিতরণ করেছেন দেশব্যাপী। একই ভাবে করোনায় আক্রান্তদের হাসপাতালে নেয়া, চিকিৎসা, ওষুধপথ্যের ব্যবস্থা করা, করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণকারীদের লাশ দাফন, আক্রান্তদের হাসপাতালে নিয়ে আসার মানবিক দায়িত্ব পালন করেছেন পুলিশ।
পুলিশ বাহিনীর কর্মকান্ড কখনো কখনো সমাজের একটি অংশকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে, করে অনুপ্রাণিত। কারণ কখনো গরীবের বা কোন ভূক্তভোগীর তাৎক্ষণিক প্রতিকারের জন্য, সমস্যা সমাধানের জন্য, জীবনসম্পদ রক্ষায় পুলিশের দ্বারস্থ’ হতে হয়। এসব ক্ষেত্রে এখনো পুলিশই নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের একমাত্র ভরসার ও আশ্রয়ের জায়গা। পুলিশের অতীত কর্মকান্ড দিয়ে তাই প্রমাণ দিয়েছে। অবশ্য এখানে একটি কথা বলা জরুরি যে, এবার জাতিরজনক বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে পুলিশের শ্লোগান ছিল ‘মুজিব বর্ষের অঙ্গীকার, পুলিশ হবে জনতার’। পুলিশের এই শ্লোগানের যথার্থ প্রমাণ মেলে এই করোনাকালে তাদের দায়িত্বের বাইরে গিয়ে মানবিক ভূমিকা পালন।
জঙ্গীবাদের বিস্তার রোধে পুলিশের গৌরবোজ্জল ভূমিকা দেশে বিদেশে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। প্রাণঘাতী করোনার এই বৈশ্বিক দুর্যোগে, টানা লকডাউনে গরীব, সহায় সম্বলহীন, অসহায় দরিদ্র মানুষের মধ্যে খাদ্য সহায়তা, রোজায় ইফতার,ঈদ সামগ্রী সহায়তা দিতে ‘কুইক রেসপন্স টিম’ দক্ষ,চৌকষ,কর্মঠ নিষ্ঠাবান পুলিশ সদস্যদের নিয়ে গঠন করা হয়েছে। এই টিমের কর্মকান্ড সার্বক্ষণিক তদারকি, মনিটর করা ও প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিতে বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তারা দায়িত্বরত আছেন। তবে এসব কর্মকান্ড সামগ্রীকভাবে সর্বক্ষণ ও নিয়মিত তদারকি করছেন স্বয়ং মহাপুলিশ পরিদর্শক বেনজির আহমদ। পাশাপাশি মেট্রোপলিটন এলাকায় মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার, বিভাগীয় পর্যায়ে ডিআইজি, জেলা পর্যায়ে জেলা পুলিশ সুপার, থানা পর্যায়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তথা ওসি দায়িত্ব পালন করছেন।
কখনো কখনো কিছু সংখ্যংক পুলিশ সদস্যের কর্মকান্ড, ভূমিকা মানুষের মধ্যে সন্দেহ, বিতর্ক, অসন্তোষের জন্ম দিয়েছে। কিন্তু এই অসংগতি পুলিশ বাহিনীর মহান ত্যাগ, গৌরব অর্জনকে ম্লান করতে পারেনা। কারণ বাঙ্গালীর মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের পুলিশ বাহিনীর গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা জাতির ইতিহাসে, মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্বর্নাক্ষরে লিপিবদ্ধ রয়েছে। পুলিশের নাম জানা-অজানা বহু সদস্য মহান মুক্তিযুদ্ধে অকাতরে দেশ মাতৃকার স্বাধীনতার জন্য সম্মুখসারির যোদ্ধা হিসেবে শত্রুকে ঘায়েল করতে বা পরাস্ত করতে আত্মাহুতি দিয়েছেন অনেকেই। মহান মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের শহীদ সদস্যদের মধ্যে কিছু নাম পদবী সম্বলিত একটি নাম ফলক সংরক্ষিত আছে রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইনে। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানেও বিচ্ছিন্নভাবে বেশ কিছু শহীদ পুলিশ সদস্যের কবর রয়েছে।
এবার করোনাকালে পুলিশের মানবিক ব্যাপক ভূমিকার কিছু বিক্ষিপ্ত ভূমিকার প্রতি দৃষ্টি দিতে চাই। ঢাকার ধামরাইয়ে করোনা ভাইরাসের উপসর্গে মারা যাওয়া পাখি মণ্ডলের মৃতদেহের কাছে কোনো স্বজন আসেননি। অনেকটা সময় তার মৃতদেহ পড়ে ছিল। পরে ধামরাই থানা পুলিশের সহায়তায় কায়েতপাড়া শ্মশানে তাঁকে সৎকার করা হয়। সেদিন পুলিশের এই মানবিক ভূমিকার প্রশংসা ভেসে বেড়ায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের টঙ্গী পূর্ব থানার উপপরিদর্শক (এসআই) শুভ মলিক নিজের জন্মদিনে অসহায় পরিবারের হাতে খাদ্যসামগ্রী তুলে দেন। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে মধ্যরাতে এক করোনা রোগীকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন বাড়িওয়ালা। গভীর রাতে পুলিশ তাকে বাড়িতে তুলে দিয়ে আসেন। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সন্দেহে সাভারের আশরাফুজ্জামানকে একা ফেলে বাসা থেকে চলে যান তাঁর স্ত্রী ও সন্তান। নিরুপায় হয়ে তিনি একটি গাড়ি ভাড়া করে গ্রামে ঝিনাইদহে গিয়েও বাড়িতে উঠতে পারেনি। সেখানে জনপ্রতিনিধিরা তাঁকে ঠাঁই দেননি। খবর পেয়ে ঝিনাইদহ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মিজানুর রহমান তার বসবাসের বন্দোবস্ত করে দেন। করোনাকালে সারা দেশেই পুলিশের সামাজিক দায়বদ্ধতা বা মানবিকতার এমন টুকরো টুকরো অনেক ঘটনা আছে।
সংক্রমণ ঠেকাতে লকডাউন ব্যবস্থাপনা ও জননিরাপত্তার দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি অসহায় মানুষদের খাদ্যসাহায্যেও হাত বাড়িয়ে দিয়েছে পুলিশ। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সংক্রমণের শিকার হয়েছে; মারাও গেছেন। করোনাকালে পুলিশের জনকল্যাণকর ভূমিকা মানুষের প্রশংসা পাচ্ছে। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ৬০ সদস্য মারা গেছেন।সোয়া লাখের পুলিশ বাহিনীতে এখন পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ১১ হাজারের বেশি সদস্য। পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড.বেনজীর আহমেদ বললেন, করোনায় পুলিশের যে সদস্যরা মারা গেছেন, মানুষের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে গিয়েই তারা প্রাণ দিয়েছেন। তাদের অবদান জাতি ভুলবে না।
করোনাকালে পুলিশের মতো র্যাবও বিভিন্ন স্থানে অভাবী মানুষের মধ্যে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করছে, নানাভাবে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে র্যাবের প্রায় ১৬শ সদস্য আক্রান্ত হয়েছেন। আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীতে আক্রান্ত ৪৮০ জন। করোনার এই দুর্যোগে দায়িত্ব পালন করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও। তারা রুটিন দায়িত্বের বাইরে গিয়ে মানবিক ভূমিকা পালন করছেন। তারাও ত্রাণ সহায়তা, চিকিৎসা সেবায় সাহার্য্যের হাতি বাড়িয়ে দিয়েছেন।
সব মিলিয়ে করোনার এই দুর্যোগে পুলিশের এক নতুন মানবিক ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছে। মানুষের প্রত্যাশা ভবিষ্যতেও দেশের ও মানুষের বিপদে মানবিক ভূমিকায় এগিয়ে আসবে পুলিশসহ আইন-শংখলায় নিয়োজিত অন্যান্য সংস্থার সদস্যবৃন্দ। করোনার এই বৈশ্বিক দুর্যোগকালে পুলিশসহ অন্যান্য আইন-শৃংখলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বাহিনীর সকল সদস্যদের আন্তরিক ভাবে অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা জানাই। একই সাথে করোনার এই যুদ্ধের সম্মুখসারির যোদ্ধা হিসেবে ইতোমধ্যে যেসব পুলিশ সদস্য-সদস্যা করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। আর যারা আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন তাদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করছি। স্যালুট জানাই বীরপুলিশ সদস্যদের। আগামি দিনেও পুলিশ জাতির ক্রান্তিকালে এরকম মানবিক ভূমিকায় নিয়োজিত হবেন সেই প্রত্যাশা থাকলো।
মোতাহার হোসেন: সাধারণ সম্পাদক-বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম।
motaherbd123@gmail.com