মুজিব জন্ম শতবর্ষ ॥ বঙ্গবন্ধুর সাথে স্মরণে

এএইচএম নোমান

মুক্তিযুদ্ধ পূর্বাপর ও স্বাধীন বাংলায় বঙ্গবন্ধুর ‘স্বেচ্ছাশ্রম উৎপাদন গ্রামোন্নয়ন’ ডাক নিয়ে কথা উঠল এক বৈঠকে। উপস্থিত এক তরুন সাংবাদিক আমাকে বল্লেন, স্যার, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আপনার কোন সরাসরি সাক্ষাৎ বৈঠক বা সভা এমন কিছু ঘটনা কি আছে? যা আমি যে ডকুমেন্টেশন করব সেখানে যুক্ত করতে পারি।

এভাবে এ ধরণের কোন প্রশ্ন চাহিদা বা ইচ্ছা সাংবাদিক বা কোন তরফ থেকে কখনও আসে নাই এবং আমিও চিন্তা করি নাই। যাক মাথা ঘামাতে ও খুঁজতে গিয়ে বের করলাম বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ৪টি বিরল মূহুর্ত ১. কথোপকথন, ২. পথসভা, ৩. ঐতিহাসিক কর্মযোগ ও ৪. সাক্ষাৎ।

নভেম্বর ১৯৭০ এর ১৫ কি ১৬ তারিখ। স্থান ছিল তৎকালীন ভোলা মহকুমার দৌলৎখাঁ থানার হাজীপুর ইউনিয়নের জগাপাতা ঘোলপাড় নদী নৌকা ঘাট। বঙ্গবন্ধু লঞ্চযোগে ১৯৭০ এর ১২ নভেম্বর জলোচ্ছাসে বিধ্বস্তদের জন্য ত্রাণ সামগ্রীসহ সাহায্য সাহস ও সুখ দুঃখ দূর্দশা ভাগাভাগি করার জন্য বন্যা কবলিত দূর্গত মানুষের কাছে মানবিকতা নিয়ে এসেছেন। সঙ্গে চেনা মুখের মধ্যে তৎকালিন ছাত্রনেতা ভোলা তথা দেশ গৌরব তোফায়েল আহমেদ, তোফায়েল ভাই। আমি একটা ছোট্ট লেদার বক্সসহ নদী ঘাটে এসেছি। নদীর পূর্বপার আলেকজান্ডার (রামগতি, নোয়াখালী) বন্যা পরবর্তী অবস্থা দেখার জন্য যাব। তৎকালে নদী পারাপারের জন্য ইঞ্জিন নৌকা বা লঞ্চ ছিল না। নৌকা লগি-বৈঠা, দাড় ও পালে চলত। ঘাটে বঙ্গবন্ধুকে দেখে আকুলভাবে আবেগে কাছে এগিয়ে গেলাম।

১. কথোপকথন

আসসালামু আলাইকুম,
আমি নোমান,
ছাত্রলীগ করতাম,
সিএ পড়ি,
এখানে আমার বাড়ী-জন্মভূমি,
তাই বন্যা পরিস্থিতি দেখতে এলাম।

বঙ্গবন্ধু- ও তুই নোমান!
জি হ্যাঁ।
কেমন দেখলি অবস্থা?
এক কথায় ভয়াবহ।
এখন এখানে কি?
ওপার যাব-সেখানে আমার পিত্রালয়, আব্বা আম্মা থাকেন ও বন্যা পরিস্থিতি দেখতে যাব।
বঙ্গবন্ধু, যা-যা দেখ কি করা যায়। ঠিক আছে, কাজে লেগে যা- কাজে লেগে যা।
এই তোফায়েল দেখ, তোমারই এলাকার ছেলে। ভাল, এদেরকে দিয়ে কাজ হবে। ভাল ভাল।
তোফায়েল ভাইর মনে থাকার কথা না। এ ছাড়া পূর্ব পরিচিত নই। তবে চাহনিতে কাছে নিয়েছে বুঝা গেল।

২. পথসভা

৭০’র বন্যা পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রচারণায় বঙ্গবন্ধুর আলেকজান্ডার (রামগতি) গমন। বাজারের বড় পুকুরের উত্তর পশ্চিম কোণার রাস্তার পাশে বিশাল বটতলায় পথসভা। হ্যান্ড মাইক দিয়ে বঙ্গবন্ধু বক্তব্য দিচ্ছেন, পন্ডিত বাড়ীর তাজুল ইসলাম চাচা (তাজল ওসি নামে পরিচিত) বঙ্গবন্ধুর কাঁধের নিচ থেকে হাত দিয়ে উঁচিয়ে রেখেছেন, আমি হ্যান্ড মাইক ধরে রেখেছিলাম। আওয়ামী লীগ থানা সেক্রেটারি মো. অজিউল্লাহ মিয়া বঙ্গবন্ধুর পাশে ছিলেন। সফর সঙ্গী মোশারেফ ভাই (পরে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ও এমপি) তিনি রাস্তার পশ্চিম পাশে ধীরেন বাবুর চা দোকান সামনে দাঁড়ানো ছিলেন। প্রার্থী সিরাজুল ইসলাম এমপিও ছিলেন।
বক্তব্য শেষে মাইক ছেড়ে দিতে দিতে বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন,
‘কি নোমান, তুমি এখন এখানে কি কর?’
আমি বললাম, ‘কৃষি ও মৎস্যজীবিদেরকে নিয়ে সমবায় সমিতির মাধ্যমে কাজ করছি। ‘এই পুকুরের দক্ষিণ পাড়েই আমাদের বাসা-বাড়ী।’
‘তা ভালো। ভোটের কাজ করনা?’
‘জ্বি, তাতো করি-ই।’
‘কি সিরাজ, নোমান ভোটের কাজ করে না?’
সিরাজ ভাই হাসতে হাসতে উত্তর দিলেন, ‘জ্বি, অবশ্যই করেন।’
বঙ্গবন্ধু বললেন, ’আচ্ছা, ঠিক আছে। সমিতিও করো, ভোটও করো।
এরপর জীপ গাড়ীতে ওঠার আগে যতটুকু মনে পড়ে মোশারেফ ভাইর হাতে কিছু টাকা দিলেন। পরে তাজল ওসি চাচাসহ গুনে দেখলেন ২ হাজার টাকা। বন্যা পরবর্তী ত্রাণ বা হয়ত নির্বাচন কাজে প্রাসঙ্গিক খরচের জন্য।

৩. ঐতিহাসিক কর্মযোগ

হায়ানা পাকিস্তান কারাগার থেকে প্রত্যাবর্তনের পর বঙ্গবন্ধু সর্ব প্রথম যে চর-গ্রামে যান ‘স্বেচ্ছাশ্রম-উৎপাদন গ্রামোন্নয়ন’র ডাক দেন, সেই গ্রামের নাম চর পোড়াগাছা, ইউনিয়ন চর বাদাম, থানা রামগতি, জেলা তৎকালীন নোয়াখালী, বর্তমান লক্ষীপুর। রামগতি আমার মা-বাবা পরিবার বসবাস জীবন যৌবন কর্ম এলাকা।

২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২। বঙ্গবন্ধু এই দিনে কোদাল দিয়ে মাটি কেটে ঝুড়িতে ফেলে সড়ক নির্মাণের ঐতিহাসিক স্বেচ্ছাশ্রমের কাজ উদ্বোধন করেন। ভাষণে তিনি উৎপাদনের ডাক দেন, গ্রামোন্নয়নের ডাক দেন। আমি সেদিন বুকে অ-আ-ক-খ লাগিয়ে ৭/৮ হাজার সমবায়ী উৎপাদন যোদ্ধাসহ স্বেচ্ছাশ্রম কাজে অংশ নেই। স্থানটি এখন বঙ্গবন্ধু শেখের কিল্লা নামে খ্যাত। সেদিনেও প্রিয় নেতা তোফায়েল ভাই সফর সঙ্গী ছিলেন। এটা ছিল বঙ্গবন্ধুকে আমার মন দেয়া কর্ম যোগ। এই কর্মযোগকে ধারণ করে ‘বঙ্গবন্ধু শেখের কিল্লা স্বপ্ন স্মৃতি কমপ্লেক্স’ নির্মাণ লক্ষ্যে তখন থেকেই কাজ করে যাচ্ছি-হাতড়িয়ে চলছি। গত ২০১৩-তে বঙ্গবন্ধুর গমনস্থলে ডরপ এর উদ্যোগে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা বিশিষ্ট একটি মাইল স্টোন স্থাপন করা হয়েছে। পত্রিকায়/মিডিয়ায় লেখালেখি চলছে। দীর্ঘ ৪৮ বছর পর এখনও তা বাস্তবায়নের অপেক্ষায়। বঙ্গবন্ধু শেখের কিল্লা পাদদেশ থেকেই মাতৃত্বকালীন ভাতা ও স্বপ্ন প্যাকেজ উৎসারিত হয়। এ রামগতি থেকেই দেশের প্রথম বিশ্বগ্রাম-গুচ্ছগ্রাম প্রতিষ্ঠিত হয়। স্থানটি নিয়ে মহল বিশেষের বিতর্কিত করে রাখা স্বার্থজনিত কারণে অসত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার এক কাল হাত কাজ করছে। আল্লাহ্ মাফ করুক।

৪। সাক্ষাৎ

১৯৭৩ এপ্রিল মাস। বঙ্গবন্ধু তখন শের-ই-বাংলা নগরস্থ কার্যালয়ে বসেন। রামগতি থানা কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতির বার্ষিক সাধারণ সভা ও নির্বাচন। রামগতি সমবায়ের আমি প্রতিষ্ঠাতা ও সেক্রেটারি। ১৯৭০’র ১২ নভেম্বর ভয়াবহ জলোচ্ছাস ও অগণিত মানুষের প্রানহানি ও ক্ষতি ফলশ্রুতিতে দ্বি-স্তর বিশিষ্ট কৃষি-মৎস্য সমবায়ের সৃষ্টি ও জন্ম।
সমবায় নির্বাচন উপলক্ষ্যে কর্মগতি ধারা ও বাস্তবায়ন নীতি নিয়ে আমার সঙ্গে স্থানীয় ২/১ আওয়ামী লীগ নেতার মত পার্থক্য ও প্রতিদ্বন্ধিতা হয়। তৎকালীন এমপি জনাব সিরাজুল ইসলাম আমার পূর্বাপর স-ব সমবায়-উন্নয়ন কার্যক্রম জানেন। ত্রাণ, পূনর্বাসন, উৎপাদন উন্নয়ন সকল গতিধারা একত্রেই করেছি। পরিস্থিতি মোকাবেলায় এমপি সাহেব আমাকেসহ ঢাকায় আসলেন। সঙ্গে তৎকালীন মুক্তিযোদ্ধা ও সমবায়ী আবদুল ওয়াহেদ মুরাদকে (বর্তমানে উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি) নিয়ে আসেন। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা শফিক কমান্ডারকে (চর লরেন্স) পরিস্থিতি মোকাবেলা ও পর্যবেক্ষণে রেখে আসেন। তারিখ মনে নেই। এমপি সিরাজ ভাই, মুরাদ ভাইসহ আমাকে নিয়ে গণ ভবনে গেলেন। গণ ভবনে গেইট পার হয়ে ভেতরে কতটুকু গেলেই দেখি বিশালকায় আমাদের জাতির পিতা তোফায়েল ভাইকে পাশে নিয়ে বীর শিরে ধীর হেঁটে ডান দিকের বিল্ডিং থেকে আর এক কক্ষের দিকে যাচ্ছেন।

বঙ্গবন্ধু সিরাজ ভাইকে দেখে-
কিরে সিরাজ!
ভাই, আসছিলাম নোমান সাহেবকে নিয়ে।
নোমানকে নিয়ে? কি হয়েছে?
আমাদের ওখানে সমবায় নির্বাচন। ফজলু মিয়া ওনার বিপক্ষে প্রতিযোগিতা করতে চায়।
বঙ্গবন্ধু, তা সে (ফজলু মিয়া) রাজনীতি করে। নোমান সমবায় কাজ কর্ম করে। ফজলু এখানে কেন?
‘এই তোফায়েল, দেখ, নোমানের এটা ঠিক করে দাও।’
এরপর আর কি থাকে! বঙ্গবন্ধুর ঐ যে ‘নোমানের এটা ঠিক করে দাও বলা। আমার পাথেয় ও জীবন প্রাপ্তি। দিক বাতলিয়ে দেয়া। আজ পর্যন্ত সব উদ্যোগ প্রচেষ্টা কর্মক্রিয়া, বঙ্গবন্ধুর দর্শণে মন-প্রাণ দিয়ে চালিয়ে যাচ্ছি। বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক মুক্তির স্বপ্নের অনুসারী হয়ে। ধারক ও বাহক হয়ে এবং চলবে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত। আল্লাহ সহায় হোন।

সেই তরুন সাংবাদিক ইমরানের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে এতক্ষণ যা লিখলাম- তা তার কোন কাজে লাগবে কিনা জানিনা। তবে আমি প্রচুর লাভবান হয়েছি। এজন্য যে বঙ্গবন্ধু-জাতির পিতাকে আমার মধ্যে মহা সমুদ্রের এক বিন্দু জল পরিমাণ হলেও রপ্ত করে চলেছি ও চলব। এই আত্ম প্রত্যয়ে।

এএইচএম নোমান: আহবায়ক, ৬৯’ এর গণঅভ্যুত্থান কালে পূর্ব পাকিস্তান চার্টার্ড একাউন্টেন্স স্টুডেন্টস এ্যাকশান কমিটি।
Email: nouman@dorpbd.org

Print Friendly

Related Posts