পরিত্যক্ত টায়ার হতে সাশ্রয়ী মূল্যের গ্রিন অয়েল : সভ্যতার নতুন স্মারক

ড. মোহাম্মদ মহিনুজ্জামান

 

সভ্যতার ক্রমবিকাশের সথে সাথে প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের চাহিদা। সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে মানুষের জীবনের গতি যেমন বেড়েছে তেমনি চাকার (টায়ার) ব্যবহার ও বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে একটা নির্দিষ্ট সময় পরে যখন এই চাকাগুলো পরিত্যক্ত হয়ে যায় তখন সেটার সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে পরিবেশের জন্য এক বড় হুমকি হিসাবে আর্বিভূত হয়।

বর্তমান বিশ্বে কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি অনুসরণ করে বর্জ্যকে সম্পদে পরিণত করা হচ্ছে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি বলতে আবর্জনা সংগ্রহ, পরিবহন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, পূনঃব্যবহার ও নিষ্কাশনের সমন্বিত ব্যবস্থাকে বুঝায়।

কঠিন বর্জ্য পর্দাথের আধুনিক ও নিরাপদ ব্যবস্থাপনার অভাবে বিশেষ করে পরিত্যক্ত টায়ার ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশের অন্যতম পরিবেশগত সমস্যা। পরিত্যক্ত টায়ার সেরকম একটি বর্জ্য যা ৫০০ বছরেও মাটিতে মিশে না । পরিত্যক্ত টায়ারসমূহ যত্রতত্র পড়ে থাকলে উক্ত টায়ার সমূহে বৃষ্টির পানি জমে এডিস মশার বংশ বৃদ্ধি হয়, এর ফলে মশাবাহিত ডেঙ্গু চিকুনগুনিয়ার মত মারাত্মক রোগের সংক্রমণ বেড়ে যায়। পরিত্যক্ত টায়ারগুলো এতদিন শুধুমাত্র ইটের ভাটায় জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার হতো, ইটের ভাটায় পরিত্যক্ত টায়ার সরাসরি পোড়ানোর ফলে বাতাসে বিষাক্ত অ্যামোনিয়া, হাইড্রোজেন সালফাইড এবং সালফার ডাই অক্সাইড সরাসরি নিঃসরিত হয়। জিঙ্ক এবং লেড এর মত ক্ষতিকারক ধাতু বাতাসে নিঃসরিত হয়ে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। যা মানব স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

বর্তমানে আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জ্বালানির উৎস হিসাবে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করি। জীবাশ্ম জ্বালানি হচ্ছে এক ধরনের অনবায়নযোগ্য শক্তির উৎস যা একদিন শেষ হয়ে যাবে। এছাড়া এক সময় শোনা যেত বাংলাদেশ গ্যাসের উপর ভাসছে। কিন্তু বাস্তবে এখন আমরা গ্যাসের অপ্রতুলতা লক্ষ্য করছি। কয়লার ক্ষেত্রে শুধু বড়পুকুরিয়া ছাড়া আর কোন খনি থেকে কয়লা উত্তোলন সম্ভব হয়নি। এ ক্ষেত্রে কয়লাসহ অন্যান্য জ্বালানি আমদানি করতে হচ্ছে। কিন্তু সেই আমদানিতেও ঝুঁকি রয়েছে। কেননা যেসব দেশ থেকে জ্বালানি আমদানি করা হচ্ছে, সেসব দেশ যেকোন সময় তাদের নীতিমালা পরিবর্তন করতে পারে কিংবা জ্বালানি বিক্রি বন্ধ করে দিতে পারে। আবার দামও বাড়িয়ে দিতে পারে। ফলে তা অর্থনীতির জন্য এক হুমকি হিসাবে দেখা দিতে পারে। অপরদিকে জীবাশ্ম জ্বালানি এবং কঠিন বর্জ্য পর্দাথের যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। একই সাথে মাত্রাতিরিক্ত পরিবেশ দূষণের ফলে প্রাকৃতিক দূর্যোগের ভয়াবহতাও দিন দিন বেড়েই চলেছে। জলবায়ুর এই দ্রুত পরিবর্তন পরিবেশের ভারসাম্যের উপর বিশেষত: জীব-বৈচিত্র্য, কৃষি, বন, জলাভূমি, পানি সম্পদ ও জনস্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। জলবায়ু অস্বাভাবিক পরিবর্তন, গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণ বৃদ্ধি, মাত্রাতিরিক্ত বায়ুদূষণ মানুষের জীবন জীবিকার উপর বিরুপ প্রভাব ফেলছে, যা সাম্প্রতিক আম্পান কিংবা আইলার ভয়াবহতা থেকে উপলব্ধি করা যায়।

বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। সময় এসেছে নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস নিয়ে কাজ করার কিংবা বর্জ্য থেকে শক্তির উৎস বের করার। আমাদের দেশে সরকার নবায়নযোগ্য জ্বালানীতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে নানা সময়ে বহুমুখী উদ্যোগ নিয়েছে। জাতিসংঘ টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়নে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনে ১০ ভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

সেই নিরিখে পরিবেশের জন্য ভয়াবহ হুমকি হয়ে ওঠা এই সকল বর্জ্য রাবার বিশেষ করে পরিত্যক্ত টায়ার সমূহ জ্বালানি তেলে রূপান্তরের কৌশল বিশ্বজুড়ে আশার আলো দেখাচ্ছে। দূষণ প্রতিরোধ ও ক্রমবর্ধমান তরল জ্বালানির চাহিদা মেটাতে ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, জার্মানি, ভারতে পরিত্যাক্ত টায়ার থেকে আধুনিক পায়রোলিসিস প্রক্রিয়ায় (বৈজ্ঞানিকভাবে অবাতজারন পদ্ধতি নামক একটি বিশেষ তাপ রাসায়নিক প্রক্রিয়ায়) অক্সিজেনের অনুপস্থিতিতে বিশেষভাবে নির্মিত রি-এ্যাক্টর চেম্বারে বায়ু শূন্য করার মাধ্যমে বিশেষ তাপমাত্রায় পরিত্যক্ত টায়ারগুলোকে গলিয়ে বাষ্পে পরিণত করে এবং উক্ত বাষ্পকে কনডেন্সার বা শীতলীকারক ব্যবহার করে “গ্রিন অয়েল” নামক এক প্রকার টেকসই জ্বালানি উৎপাদন করা হয়, যা সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব আধুনিক রিসাইকিং প্রযুক্তির মাধ্যমে উৎপাদন করা হয় বিধায়, এই প্রক্রিয়ায় কোন প্রকার গ্রিন হাউজ গ্যাস ও বিষাক্ত অক্সাইড গ্যাস বিশেষ করে সালফার ডাই-অক্সাইড তৈরি হয় না। এমনকি উৎপাদিত তেলের মধ্যে সালফারের পরিমাণ ফার্নেস অয়েল হতে অনেক কম।

রাজশাহী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের যন্ত্রকৌশল বিভাগের এক গবেষণায় দেখা গেছে এই তেলের গুণাগুণ গতানুগতিক জ্বালানির মতই কার্যকর। তাই বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পরিত্যক্ত টায়ার হতে আধুনিক পায়রোলিসিস প্রযুক্তির মাধ্যমে “গ্রিন অয়েল” বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত হচ্ছে।

পরিবেশ দূষণকারী এই কঠিন বর্জ্যকে আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে পুনঃপ্রক্রিয়ায় সম্পদে পরিণত করে পরিবেশ রক্ষায় ভূমিকা রাখা সম্ভব। এই প্রযুক্তিটি বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করেছে। উৎপাদিত এই তেলের মান আমদানিকৃত ফার্নেস অয়েলের চেয়ে উন্নত। আমদানিকৃত ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে সাশ্রয়ী মূল্যের নবায়নযোগ্য জ্বালানি “গ্রিন অয়েল” ব্যবহার করে বিদ্যূৎ উৎপাদন খরচ কমানো সম্ভব হবে, সেই সাথে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রাও বাঁচানো সম্ভব হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে “গ্রিন অয়েল” ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। গ্যাস সংকটের কারণে যে সকল কারখানার মালিকগণ উচ্চমূল্যের ফার্নেসঅয়েল ব্যবহার করছেন তারাও এই “গ্রিন অয়েল” নামক সাশ্রয়ী দামে জ্বালানি কিনে তাদের পণ্যের উৎপাদন খরচ কমাতে পারেন। গত দুই যুগের ও বেশি সময় ধরে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে এই প্রযুক্তিটি নিয়ে ব্যাপকভাবে গবেষণা হয়েছে এবং বর্তমানে এটি বিভিন্ন দেশে পরিবেশ সুরক্ষা ও জ্বালানী সংকট মোকাবেলায় বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত হচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা এবং একটি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য জাতিসংঘ ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার পরিবেশবান্ধব ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি শক্তি ব্যবহারে উৎসাহ প্রদান করছে। বাংলাদেশেও ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তা অর্জন করতে হলে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নায়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়ন করতে হলে এই ধরনের পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তিকে উৎসাহিত করতে হবে।

ড. মোহাম্মদ মহিনুজ্জামান: সহকারী অধ্যাপক, পরিবেশ বিজ্ঞান ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
ইমেল- moyeeneshs@gmail.com

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts