মো. রুবেল হোসেন
পিতৃহারা, মা থেকেও নেই। এমনি এক পরিবারের সন্তান আমি। ‘মা থেকেও নেই’ এই কথাটা বিস্মিত হওয়ার কিছুই নেই, কারণ আমার মা কানে শুনতে পায়না আবার কথাও বলতে পারে না। এটা জেনেও আমার বাবা আমার মাকে বিয়ে করে। কিন্তু যত দিন যেতে লাগলো আমার মায়ের উপর অত্যাচারের মাত্রা বাড়তেই লাগলো। এমতাবস্থায় আমার পাষাণ হৃদয়ের বাবা আমার মাকে ছেড়ে চলে গেলো। তখন থেকেই শুরু হলো আমাদের সংগ্রাম। তার তিন চার মাস পরেই জন্ম হয় আমার। জন্মের পর পরেই ঘটে আমার সাথে নানা কিছু। কিন্তু আমার মা দমে যাননি। উদ্যম, প্রচেষ্টা এবং দৃঢ় আত্মবিশ্বাসের ফলেই আমার দুঃখ কষ্টকে করেছেন লাঘব।
আমার জন্ম ২০০৩ সালের ১৬ জানুয়ারি। বর্তমান ঠিকানা: বিশাল ধনী দালানের পাদদেশে সরু গলিতে, গরীবি আস্তানা, কাঁঠাল বাগান । স্থায়ী ঠিকানাঃ, গ্রামঃ চর সন্তোষপুর, পোঃ বাংলা বাজার, থানাঃ কাজীর হাট। জেলাঃ বরিশাল। পিতা মৃত: মোঃ দেলোয়ার হোসেন।
এখন আপনাদের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে যে আমি কি করে জানলাম যে পিতা মৃত। আসলে ঐ ছাড়াছাড়ির ঘটনা জানার পর থেকেই আমি আমার পিতাকে মৃত হিসেবে ধরে নিয়েছি। তাছাড়া যদি আমি এটা না করতে পারি তাহলে হয়তো বা আমি আমার জীবনের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য পূরণ করতেই সক্ষম হতাম না।
মা পারভীন বেগম। আমার মা ছিলেন সর্বগুণে গুণান্বিতা। মহান আল্লাহতায়ালা তাকে সকল কাজে নিপুণ করে তুললেও তার যে মুখের ভাষাই ছিল না, এসব কারণে তিনি আমাকে বা আমাদেরকে অনেক কথা বলার চেষ্টা করলেও সেটা বলে উঠতে পারতেন না। এই কারণে তিনি অনেক সময় অনেক দুঃখ-কষ্ট তার নিজের মধ্যেই রাখতেন, কিছুই করতে পারতেন না। তবুও তিনি ভেঙে পড়েননি। তার সকল কথা আমাদের ইশারায় বুঝিয়ে দিতেন। অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে তাকে আমার জন্য। তার জন্য আমি খুবই দুঃখিত-মা।
‘শৈশব’ এই কথাটির পিছনে জড়িয়ে থাকে হাজারো স্মৃতি। কিন্তু আমার বোধ হয় সেই ভাগ্য হয়ে উঠেনি। যে বয়সটা ছিল সকলের আবদারের, কোনো কিছু চাওয়া-পাওয়া আরোও কতো কি ! কিন্তু সেই চাওয়াটা অনেক সময় অপূর্ণই থেকে যেতো। কেননা আমার তো সেই মানুষটাই ছিল না যে, যার কাছে আমি কোনো একটা জিনিস চাইবো। আমি ছোট বেলা থেকেই আমার নানা-নানুর কাছে থেকে লালিত-পালিত হচ্ছি। সুতরাং তারা আমার মনের অবস্থা বুঝে, আমার সকল চাওয়াই পূরণ করতে চাইতেন। কিন্তু ভাগ্যদোষে পারতেন না।
আমার নানু নাজমা বেগম এবং আমার নানা আজিজ সরদার। আমার নানা আমাদের বাসার পাশেই বসে সবজি বিক্রি করতেন এবং আমার নানু বাসায় কাজ করতেন। তখন সেই টাকার উপর ভিত্তি করে আমরা একটি টিন শেড বাসায় থাকতাম। ভূমি মালিক সুবিশাল একটি জায়গার মধ্যে একচালা টিন শেডে টিনের বেড়া দিয়ে ত্রিশটি রুম গড়ে তোলে। প্রতিটি রুমে গড়ে ৩ জন করে মোট ৯০ জন লোক বসবাস করি একত্রে। পুরুষদের জন্য একটি এবং মহিলাদের জন্য একটি আলাদা সেমিপাকা বাথরুম রয়েছে। গোসল খানা একটি, সেখানে সকালে সিরিয়াল। আলাদা সময়ে ছেলে মেয়ে গোসল করে থাকি এবং খাবার পানি সেই চাপকল থেকেই নেওয়া হয়। ৩ রুমের ভাড়াটিয়া মিলে ১ টি চুলা বরাদ্দ। সকালে তাদের সুবিধা মত যে যার মতো রান্না করে। নানু ভাড়া দেয় ৭ হাজার টাকা। তাদের দুজনের টাকা দিয়েই আমাদের সকলের থাকা-খাওয়ার খরচ চলতো। হঠাৎ করে বলতে বলতে কয়েকটা বছর এইভাবেই কেটে গেলো। আমাকে একটি এনজিও’র মতো স্কুলে ২০ টাকা বেতনে পড়াশুনা করানো শুরু হলো। তখন আমাদের খরচ আরো বাড়তে লাগলো। সেটাও আমার জন্য।
ছোট বেলা থেকেই আমি পড়াশুনার প্রতি অনেক আগ্রহী ছিলাম। ধারে কাছে যদি কোন খবরের কাগজ, কোন খাতা বা টিকেট পেতাম তাহলে সেটা বানান করে পড়ার চেষ্টা করতাম। এ দেখে আমার নানু একদিন বলে উঠলো, ‘তুই যতটুক পড়তে চাস না কেন আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করবো তোকে পড়ানোর’। একথা শুনে আমার আগ্রহ আরও দ্বিগুণ হতে শুরু করলো। আল্লাহর অশেষ রহমতে আমি একটা পড়া বেশ কিছুক্ষণ পড়লেই খুব সহজেই বুঝতে পারতাম। এমন করতে করতে আরও কয়েক বছর কেটে গেলে। পর পর ভালো নম্বর পেয়েই আমি এক শ্রেণী থেকে অন্য শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হতাম। যখন আমি পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ি তখন অনেক ভালো নম্বর পাই। এ দেখে ‘ওয়াই ডব্লিউ সিএ ফ্রি স্কুল’ Young Women Christian Association থেকে একটি বৃত্তি প্রদান করে। সেই বৃত্তির টাকাকে কেন্দ্র করেই শহরের বেশ নামি দামী একটা স্কুলে ভর্তি করানো হলো। যার নাম বিসিএসআইআর- Bangladesh Council of Scientific and Industrial Research উচ্চ বিদ্যালয় স্কুলের যেমন নাম ডাক ঠিক তেমনি ছিল তার উচ্চ ধরনের বা ব্যয় বহুল খরচ। কিন্তু তবুও নানু তার হাল ছেড়ে দেননি।
যেহেতু স্কুলটা ছিল উচ্চ ধরনের সুতরাং আমাকেও এমনভাবে চলতে হতো। যাতে করে কেউ বুঝতে না পারে যে, আমি কি ধরনের পরিবার থেকে আসছি। কোন Family belong করে আসছি। এমতবস্থায় তাদের সাথে অনেক সময় অনেক কথা ভেবে চিন্তে করে বলতে হতো যে, আমি তার জবাব বা প্রতি উত্তর দিতে পারবো কিনা। তখন থেকেই নানুর শুরু হলো আরেক সংগ্রাম। আমাকে ঠিকঠাকভাবে পড়ানোর জন্যই তিনি তার কাজের সময় বাড়িয়ে দিলো। কিন্তু সেটা আমাদের কিছুতেই বুঝতে দিতো না। বাবা-মায়ের সাথে তার সন্তান কত কথাই না বলে, কিভাবে কি করলে ভালো হয়। কোন সমস্যা হলে সেটাকে কিভাবে প্রতিরোধ করা যায়। তাছাড়া কোথাও ঘুরতে যাওয়া-তার কিছুই আমি পেতাম না। একটা সময় মনে হলো যেন আমি Depression এ চলে যাচ্ছি। তখন থেকেই নানু যত কিছুই হোক না কেন বা যত দেরী হোক, নানু আমার সাথে সকল কথা বলতে শুরু করে। স্কুলে কি হয়েছিল, ঠিকঠাকভাবে খাওয়া-দাওয়া করি কিনা ? কিংবা কোন সমস্যা হয়েছে কিনা তখন থেকেই আমি ধীরে ধীরে ঠিক হতে লাগলাম। নানু আমার বড় মামীকে বলে দিয়েছিল যাতে আমার খোঁজ খবর রাখেন। আমার বড় মামী (মাজেদা বেগম) আমাকে নিজের ছেলের মতো করেই আগলে রাখতেন।
অনেক কষ্টের মধ্য দিয়ে যেমন আমি আমার পড়াশুনা চালু রেখেছি। ঠিক তার পাশাপাশি সৃষ্টি হয়েছে নানা বাধা বিপত্তি। নানু তার কাজের সময় বাড়িয়ে দিলেও হঠাৎ করে নানার বিরাট বড় একটা Accident হয়। প্রথমে তার পা ভেঙে যায়। সেটার ডাক্তার দেখাতে গিয়ে অনেক টাকার প্রয়োজন হয়। নানু কোন কুল-কিনার খুঁজে পাচ্ছিল না। তখন নানুকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন ডা. রাজিয়া বেগম। যেখানে কিনা নানু কাজ করতেন। আমার পড়াশুনা প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। তখনও নানুর খালাম্মা অর্থাৎ ডাঃ রাজিয়া বেগম নানুকে অণুপ্রেরণা দেন। তাছাড়াও তার স্বামী এএইচএম নোমান আর্থিক দিক দিয়ে অনেক সাহায্য করেছিলেন। এমন করে অনেক বার এরূপ বাধার সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু তারা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই সাহস দিয়েছেন। তারা আমার পড়াশুনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং এভাবেই আমি অনেক বাধা বিপত্তির মধ্য দিয়েও জেএসসি পরীক্ষায় খুব ভালো result করি। চলে আসে আমার জীবনের আরেকটি নতুন অধ্যায়। যখন কিনা আমি নতুন নবম শ্রেণীতে ভর্তি হবো। যে কোনো সমস্যাই হোক না কেন সব সময়ই তারা পাশে ছিলেন (ডা. রাজিয়া বেগম ও এএইচএম নোমান)। তাদের মন ছিল অনেকটাই উদার। আমার জামা কাপড়ের টাকা ছাড়াও স্কুলের বা কোচিংয়ের বেতন তিনি দিতেন। এসব কারণে আমি তার কাছে ছিলাম কৃতজ্ঞ। তার এই অনুদানের কথা বলে শেষ করা যাবে না। কিন্তু তিনি কখনো এটা নিয়ে দম্ভ করেননি বরং সকলের কাছে বলতে নিষেধ করেন। তাছাড়াও তিনি আমার মাকেও কাজে রাখেন। যাতে পরিবারের উপর কোন সমস্যা না দেখা দেয়। তারা আমার মাকে এবং নানুকে অনেক ভালোবাসেন।
পরোপকার বলতে পরের উপকারকে বোঝায় অর্থাৎ উপকারীর উপকার স্বীকার করাকে বোঝায়। আর্থিকভাবে না পারলেও এমন অনেকেই রয়েছেন যারা কিনা তাদের সবটুকু দিয়েই চেষ্টা করেছেন। আমাকে সাহায্য কেউ করেছে উপদেশ দিয়ে, কেউবা কোন আদেশের মাধ্যমে। তন্মধ্যে কয়েকজন শিক্ষক শিক্ষিকা যাদের নাম উল্লেখ না করলেই নয়- ১. নাথ বীনা পানি পাপিয়া ২. সাম্মী আক্তার ৩. জাফর উল্লাহ ৪. শাহ মাসুদ রানা অপু ৫. সালাম স্যার ৬. গোলাম মোস্তফা। পাপিয়া ম্যাডামের সাহায্যের হাতটা অনেকাংশ বেশি ছিল। তিনি সব সময় আমাকে আগলে রেখেছেন, আর্থিকভাবেও সাহায্য করার চেষ্টা করেছেন। সাম্মী আক্তার মাম ও জাফর উল্লাহ স্যার অনেক সময় যদি পড়া না বুঝতাম তাদের মতো করে কেউ এত ভাবে বুঝিয়ে দিত না। জিএম স্যার এবং সালাম স্যার তাদের উক্তিমূলক আলোচনা দিয়ে পড়ার মান বাড়িয়ে দিয়েছেন। একদিকে স্কুলের সকলে যেমন আমাকে support দিতে লাগলো। ঠিক তেমনি বাসায় আমার মামী মাজেদা বেগম সব সময় আমার খাওয়া-দাওয়া, জামা কাপড় গোছানো থেকে শুরু করে ঠিক ঠাক ভাবে পড়তে বসানো এ সকল কিছুই করতেন আমার বড় মামী, তিনি অসামান্য ভূমিকা রেখেছেন আমার জীবনে। আচ্ছা, আমার নানু কিন্তু আমার মা’র খালা, আমার আপন নানু মারা গেলে নানা, তার ছোট বোনকে বিয়ে করে।
নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ভাবনা: প্রত্যেক ব্যক্তির একটা করে নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা বা লক্ষ্য থাকে। সে রকম আমারও আছে। ব্যাংকার হওয়ার ইচ্ছার কারণেই আমি ব্যবসা বিভাগ নিয়েছি। ব্যবসা শিক্ষায় যাতে আমার ব্যবসা করার সময় আসলেও কোন সমস্যার সম্মুখীন হতে না হয়। কিন্তু হঠাৎ করেই আবির্ভাব হলো আমার সেই পাষান হৃদয়ের বাবা এবং এক ফুফুর। তারা প্রায়ই আমার সাথে দেখা করতে চাইতো বা কথা বলতে চাইতো। কিন্তু আমার মুখ থেকে একটি কথাও বের হতো না। কেননা যখন আমরা এত কষ্টে ছিলাম তখন তারা আমাদের দেখতে আসেনি। আমরা এখন যদি আল্লাহ চান, সুখের মুখ দেখবো। তাই এখন আমার তাদের কোন প্রয়োজন নেই বলে মনে করি। তাই তাদের আসতে বারণ করেছি। বর্তমানে আমি এসএসসি পাশ করে ভাল একটি-কবি নজরুল সরকারি কলেজে চান্স পেয়েছি। সকলের কাছে দোয়া প্রার্থী যাতে আমি আমার লক্ষ্যে ঠিকভাবে পৌঁছাতে পারি।
দুঃখ যেমনি রয়েছে ঠিক তেমনি রয়েছে আনন্দ। চিন্তা করার কিছুই নাই। যদি দৃঢ় মনোবল এবং আত্মবিশ্বাস থাকে মনে, তাহলে একদিন সফল হওয়া যাবে এটা নিশ্চিত। কিন্তু সেই সফলতার জন্য প্রয়োজন অনেক সাধনা এবং কঠোর পরিশ্রম। ‘জ্ঞানই আলো’ যদি আমি জ্ঞান অর্জন করে আলোর দিশা খুঁজে পাই তবেই হতে পারবো সফল ব্যক্তি।
নোমান নানা আজিমপুর সমাজ কল্যাণ পরিষদের সভাপতি ছিলেন। তার যোগসূত্রে মা পারভীন, সরকার থেকে প্রতিবন্ধী ভাতা পেতে থাকেন। এতিমখানা থেকে মাত্র অস্টম ক্লাশ পর্যন্ত পড়া, বাসায় কাজের বুয়ার কাজ করা মা’র ছেলে কবি বশিরুজ্জামান বশিরের জন্মদিন পুস্তিকা পড়ার সুযোগ পেয়ে আমি লিখার অনুপ্রেরণা পেয়ে তার জীবন মিছিলে যোগ দিলাম। চলার পথে জীবনের হাতে লিখা-প্রথম টাইপ-যদি ছাপা হয় – আহ্ ভাবতেই কি খুশী তা-ও সেই অনুপ্রেরণাকারী নোমান নানা। আল্লাহ তাদের হায়াত বৃদ্ধি করুন। আর আমি থাকতে চাই আমার গ্রাম, ঠিকানা সন্তোষপুরেরই রুবেল। লিখাটি শেষ করছি এ উত্তর খুঁজার ইচ্ছায় যে, আমার জীবন যুদ্ধে, মা না নানু কে বড় ?
মো. রুবেল হোসেন: শিক্ষার্থী, ব্যবসা শিক্ষা বিভাগ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, ঢাকা
মোবাইলঃ ০১৩১৩৮০০০৬৮