জ.ই বুলবুল
দেশে হঠাৎ-ই স্ট্রোকে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে গেছে। যুবকরাও স্ট্রোক করে মারা যাচ্ছেন। আক্রান্তদের ৪০ শতাংশ মারা যান এবং পক্ষাঘাতগ্রস্ত হন ৩০ শতাংশ। করোনা ভাইরাসে আক্রান্তদের রক্ত জমাটবাঁধাও স্ট্রোকে মৃত্যুর একটি কারণ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।
তারা বলছেন, করোনায় যারা আক্রান্ত হয় তাদের রক্ত জমাটবাঁধার একটা প্রবণতা রয়েছে। রক্ত জমাট বাঁধলে স্ট্রোক হয়। করোনা রোগীরা দুশ্চিন্তায় ভোগেন বিধায় তাদের রক্তচাপ বেড়ে যায়। রক্তচাপ বেড়ে গেলে রক্তবাহী নালি ছিঁড়ে যায়। এতে রক্তক্ষরণ হয়ে হেমোরেজিক স্ট্রোক হয়। এই দুই কারণে বর্তমানে স্ট্রোকের রোগী বেড়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, স্ট্রোক দুই ধরনের। একটি হচ্ছে ইসচেমিক (রক্তনালির ভেতরে চলাচলের সময় রক্ত জমাট বেঁধে বাধা সৃষ্টি); অপরটি হচ্ছে মস্তিষ্কের ভেতরে কোনো রক্তনালি ফেটে রক্তক্ষরণ হওয়া। বিশ্বে প্রতি ৬ জনে একজন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে থাকে। উচ্চ রক্তচাপ, কোলেস্টেরল, ডায়াবেটিস, ধূমপান, স্থূলতা, মদ্যপান ও বংশগত কারণগুলো স্ট্রোকের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। স্ট্রোক প্রতিরোধের উপায়ে বলা হয়েছে, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ, ধূমপান বর্জন, ব্যায়াম ও স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ।
দেশে প্রায় ২০ লাখ স্ট্রোকের রোগী আছেন। প্রতি হাজার মানুষে ৩-৫ জন স্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছে। বাংলাদেশে মৃত্যুর প্রধান ১০টি রোগের মধ্যে শীর্ষে আছে স্ট্রোক। স্ট্রোক এখন যে কোনো বয়সে হতে পারে। জীবনযাত্রার পরিবর্তনের পাশাপাশি এই রোগ সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়ানো গেলে স্ট্রোকের ঘটনা কমে যাবে। এ রোগের ৮০ শতাংশই প্রতিরোধ করা সম্ভব বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।
বিশেষজ্ঞরা চিকিৎসকরা আরো বলছেন, স্ট্রোক মস্তিষ্কের একটি ভয়ানক ব্যাধি। হঠাৎই বেড়েছে এই রোগে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। অসংক্রামক ব্যাধির মধ্যে মৃত্যুর অন্যতম কারণ হচ্ছে স্ট্রোক। স্ট্রোকের কারণে শরীরের অংশবিশেষ দুর্বল বা অবশ হয়ে যায়, মুখ বেঁকে যায়, কথায় জড়তা আসে বা দৃষ্টিশক্তি লোপ পায়। স্ট্রোকে আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যুর হার বেশি। যাদের মৃত্যু হয় না, তাদের একটি বড় অংশ প্রতিবন্ধী হয়ে পড়ে। স্ট্রোকে আক্রান্তদের মধ্যে ৪০ শতাংশ মারা যায়। আর ৩০ শতাংশ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েন, তারা বেঁচে থেকেও পঙ্গুত্ববরণ করে দুর্বিষহ জীবনযাপন করেন।
নিউরোস্পাইন সোসাইটি অব বাংলাদেশের সভাপতি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোসার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ হোসেন বলেন, দেশে করোনাকালীন স্ট্রোকের রোগী বেড়েছে। স্ট্রোক হওয়ার কারণ আমরা এখনো জানি না। এটি এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। তবে উচ্চ রক্তচাপ স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। করোনাকালীন স্ট্রোকের রোগী বেড়েছে। কারণ করোনায় মানুষ দুশ্চিন্তায় থাকছে, বাইরে যেতে পারছে না। এতে দুশ্চিন্তার কারণে রক্তচাপ বেড়ে যাচ্ছে, রাতে ঘুম হচ্ছে না, তাতেও রক্তচাপ বেড়ে যাচ্ছে। এসব কারণে স্ট্রোক একটু বেড়েছে। পাশাপাশি মানুষ সোশ্যাল অ্যাকটিভিটি করতে পারছে না, নরমাল অ্যাকটিভিটি করতে পারছে না, এতে রক্তচাপ ঠিক না থাকায় স্ট্রোক হচ্ছে।
অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ হোসেন বলেন, আরেকটি কারণ হচ্ছে করোনায় যারা আক্রান্ত হয় তাদের রক্ত জমাটবাঁধার একটা প্রবণতা হয়। রক্ত জমাট বাঁধলেও স্ট্রোক হয়। আবার করোনা রোগী দুশ্চিন্তায় ভোগে তখন তাদের রক্তচাপ বেড়ে যায়, রক্তচাপ বেড়ে গেলে রক্তবাহী নালি ছিঁড়ে যায়। এতে রক্তক্ষরণ হয়ে হেমোরেজিক স্ট্রোক হয়। এই দুই কারণে বর্তমানে স্ট্রোকের সংখ্যা বেড়েছে। মানুষের মনোবল ঠিক রাখা, সময়মতো খাওয়া, সময়মতো ঘুমানো, দুশ্চিন্তা না করলে স্ট্রোক প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, প্রতি হাজারে ৩-৫ জন স্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছেন। সাধারণত ৫০ বছরের বেশি বয়সীদের স্ট্রোকে আক্রান্তের হার বেশি লক্ষ করা গেলেও যে কোনো বয়সেই তা হতে পারে। এখন অল্প বয়সীরাও স্ট্রোক করছে। তবে যাদের উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস রয়েছে তাদের স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকি বেশি। এ ছাড়া ধূমপান ও তামাক সেবন, বেশি ওজন, কর্মক্ষেত্রে চাপ, টেনশন ও নিয়মিত হাঁটাচলা করে না তাদের স্ট্রোকের ঝুঁকি রয়েছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বে প্রতি ছয় সেকেন্ডে একজন স্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছেন। বছরে আক্রান্ত হচ্ছে ৬ কোটি এবং মারা যাচ্ছে ২ কোটি মানুষ। স্ট্রোকের কারণে দেড় কোটি লোক পঙ্গু হচ্ছে। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ বা স্ট্রোক যেমন ব্যক্তিগত, সামাজিক ও পারিবারিক সমস্যা, একই সঙ্গে অনেক মানুষ হারাচ্ছে তাদের কর্মদক্ষতা। চিকিৎসায় প্রচুর অর্থ ব্যয় হচ্ছে। স্ট্রোক জাতীয় ও বিশ্বজনীন সমস্যা।
জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান (নিপোর্ট) বলছে, দেশে বিভিন্ন রোগে প্রতি বছর প্রায় সাড়ে ৮ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে ১৬ শতাংশ লোক মস্তিষ্কের রক্তনালির রোগে মারা গেছে। অর্থাৎ ১ লাখ ৩৫ হাজারের মতো মানুষের মৃত্যু হয় মস্তিষ্কের রক্তনালির রোগে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেছেন, এক সময় হৃদরোগে বেশি মানুষের মৃত্যু হতো। দেশে মানুষের মস্তিষ্কের রক্তনালির রোগ বাড়ার কারণে মৃত্যুর হারও বেড়েছে। কিন্তু সেই তুলনায় চিকিৎসা ব্যবস্থা পর্যাপ্ত নয়। এই রোগ চিকিৎসার জন্য কমপক্ষে ৫০০ চিকিৎসক দরকার। কিন্তু দেশে চিকিৎসক আছেন প্রায় ১৫০ জনের মতো। প্রশিক্ষিত নার্সের অভাব আছে। রোগ শনাক্ত করার জন্য সিটিস্ক্যান ও এমআরআই যন্ত্র খুবই দরকার। দেশের সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলোয় এই রোগের চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা থাকলেও জেলা-উপজেলা পর্যায়ে যন্ত্রপাতির অভাব।
চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্য সাময়িকী ল্যানসেটের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে মৃত্যুর প্রধান ১০টি কারণের শীর্ষে আছে স্ট্রোক। ৫৩ শতাংশ মানুষ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে। ২১ শতাংশ মানুষ ধূমপান করে, ১০ শতাংশের রক্তে প্রয়োজনের অতিরিক্ত শর্করা (অর্থাৎ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত) ইত্যাদি।
আসুন আমরা আরো সচেতন থাকি ; সুস্হ্য ও সুন্দর জীবন গড়ি।
লেখক : স্বাস্থ্য বিষয়ক নিবন্ধকার ও সাংবাদিক
bulbulbd12@yahoo.com