শাহ মতিন টিপু: একাধারে তিনি প্রথিতযশা সাংবাদিক, সাহিত্যিক, কলাম লেখক। আবার রাজনীতিকও বলা যায় তাকে। অগাধ পাণ্ডিত্বের অধিকারী সন্তোষ গুপ্তের ৯৬তম জন্মদিন আজ।
১৯২৫ সালের ৯ জানুয়ারি ঝালকাঠি জেলার রুনসী গ্রামে তার জন্ম। তিনি ছিলেন বাবা-মার একমাত্র সন্তান।
মেট্রিক পর্যন্ত পড়ালেখাও ঝালকাঠির পিকে ইনস্টিটিউটে। পরে কলকাতা সিটি কলেজে। ইন্ডিয়ান পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যোগ দেন কলকাতায় রাইটার্স বিল্ডিংয়ে আইজি প্রিজন অফিসে। রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার কারণে চাকরি চলে যায়।
তখন তিনি তাঁতীবাজার থাকতেন। তখন নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টির বড় বড় নেতাদের গোপন বৈঠক বসে তার বাসায়। যথারীতি পুলিশ হানা দেয়। অনেকেই পালিয়ে যায়। যারা ধরা পড়েন তাদের মধ্যে ছিলেন জেল কর্মকর্তা সন্তোষ গুপ্তও। এই ঘটনার পরই তিনি সরকারি চাকরি হারান। এরপরে তিনি যোগ দেন সাংবাদিকতায়।
দৈনিক সংবাদে সহসম্পাদক হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু হয়। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি সংবাদের সিনিয়র সহকারী সম্পাদক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। মাঝখানে কিছুদিন দৈনিক আজাদ পত্রিকায় কাজ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবনগর সরকারের তথ্য বিভাগে সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। সাপ্তাহিক জয় বাংলায় কাজ করেছেন।
সন্তোষ গুপ্ত দীর্ঘ পাঁচ দশকের সাংবাদিকতা জীবনে বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। দেশের প্রধান প্রধান জাতীয় দৈনিকে তার বিভিন্ন বিষয়ে লেখা প্রবন্ধ, কলাম ও সমালোচনামূলক নিবন্ধ ছাপা হতো। পাঠক মহলে সমাদৃত ছিল সন্তোষ গুপ্তের লেখা ‘অনিরুদ্ধের কলাম’। দীর্ঘ কর্মজীবনে রাজনীতি, সাংবাদিকতা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও লেখালেখির মাধ্যমে জীবদ্দশাতেই তিনি আপোষহীন এক কীর্তিমান পুরুষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
দর্শন, রাজনীতি, লোককথা, চিত্রকলা, নাট্যকলা- সবই ছিল তার নখদর্পণে। তিনি সুস্থ ও স্বচ্ছ চিন্তার অধিকারী একজন সহজ-সরল মানুষ ছিলেন। কোনো লোভ বা মোহের কাছে কখনো নিজেকে সমর্পণ করেননি। ক্ষমতা, টাকা, নামযশ, খ্যাতির উর্ধ্বে থেকে নীরবে-নিভৃতে কাজ করে গেছেন বৃহত্তর মানুষের কল্যাণে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বিশ্বাসে অবিচল থেকেছেন, নীতির ক্ষেত্রেও অটল থেকেছেন।
কবিতা, শিল্পকলা, চিত্রকলা, রাজনীতি, সাহিত্যসহ বিভিন্ন বিষয়ে তিনি ১৪টি বই লিখেছেন। ‘অনুত্তম বক্তব্য’ তার প্রথম প্রকাশিত প্রবন্ধগ্রন্থ। অন্য বইয়ের মধ্যে আছে ‘স্মৃতি বিস্মৃতির অতলে’ (১৯৯৭), ‘ইতিহাসের ছায়াচ্ছন্ন প্রহর ও বঙ্গবন্ধু’ (১৯৯৭), ‘ইতিহাস আমাদের দিকে’ (১৯৯৮), ‘একুশের চেতনা ও আজকের বাংলাদেশ’ (১৯৯৮), ‘বাংলাদেশের চিত্রশিল্প স্বরূপের সন্ধান’ (১৯৯৮), ‘অসমাপ্ত কবিতা’ (১৯৯৯), ‘সমাজতন্ত্রের অন্য ইতিহাস (২০০০), ‘রক্তমাখা বুকজুড়ে স্বদেশের ছবি’ প্রভৃতি।
শেক্সপিয়রের সনেট অনুবাদ করে তিনি মুগ্ধ করেছিলেন এ দেশের কাব্যরসিকদের। সাংবাদিকতা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য একুশে পদক, বঙ্গবন্ধু পুরস্কার, জহুর হোসেন স্মৃতি পদকসহ বিভিন্ন সম্মানে তিনি ভূষিত হয়েছেন। ২০০৪ সালের ৬ আগস্ট ৮০ বছর বয়সে তিনি প্রয়াত হন।
সন্তোষ গুপ্ত আজীবন ছিলেন প্রগতিশীল চিন্তাকে ধারণ করেছেন। আশির দশকের শেষের দিকে বিশ্বে সমাজতন্ত্রের পতনের সেই সময়ে মানুষের বিশ্বাসের জগত যখন ভেঙে পড়েছিল সন্তোষ গুপ্ত তখনও দাঁড়িয়ে ছিলেন মানবতাবাদ, গণতন্ত্র ও উদারনীতির পক্ষে।
তার মৃত্যুর পর মেয়ে অদিতি গুপ্ত লিখেছেন- ‘বাবা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বলে এসেছেন, ‘স্বাধীনতা বিরোধীরা এখন দেশে মাথা উঁচু করে চলে, এদের বিচার না করা পর্যন্ত দেশে গণতন্ত্র কখনও আসবে না।’