রাশিয়ার ভ্যাকসিন নিয়ে কিছু কথা

লে. কর্ণেল নাসির উদ্দিন আহমদ

কোভিড-১৯ এর দ্বিতীয় ঢেউয়ে বিপর্যস্ত বিশ্বের অনেক দেশ। হাসপাতালে ঠাঁই দিতে পারছে না রোগীদের। অক্সিজেন সঙ্কটে ভয়ানক মৃত্যু ধেয়ে আসছে। কবরে ভিড়, শ্মশানে চিতার আগুন নিভছে না এক মুহূর্তও। চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা অনেক দেশে। লড়াই চলছে জীবাণু আর মানব জাতির। এ লড়াই-এ মোক্ষম প্রতিরোধ দেয়াল হলো ভ্যাকসিন। শুধু চিকিৎসা করে মহামারী সামাল দেওয়া অসম্ভব ব্যাপার। আর তাই বিশ্ব এখন ঝুঁকে পড়ছে ভ্যাকসিনের দিকে—প্রতিরোধের দিকে। কিন্ত উৎপাদন আর চাহিদার মাঝে বিশাল ফারাক থাকার কারণে বিভিন্ন দেশ এখন একাধিক উৎস থেকে এটি সংগ্রহের জন্য জোর তৎপরতা শুরু করেছে। আমাদের দেশও এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। আমরা এখন রাশিয়া এবং চীনের ভ্যাকসিন প্রাপ্তির জন্য অনেকদূর এগিয়ে গেছি।

স্পুটনিক ভি- রাশিয়ার ভ্যাক্সিন। এটি কোভিড-১৯ মহামারীর বিরুদ্ধে বৈশ্বিক লড়াই-এ সর্বপ্রথম আবির্ভূত ভ্যাকসিন। ১৯৫৭ সালে মহাকাশে সর্বপ্রথম স্পুটনিক- ১ নামক কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠিয়ে বিশ্বে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলো সোভিয়েত ইউনিয়ন। সেটি ছিলো মহাকাশ দখলের লড়াই। সে লড়াই-এ রাশিয়া আমেরিকাকে টেক্কা দিতে পেরেছিলো। এবার মানব সভ্যতাকে বাঁচানোর লড়াই। সে লড়াই-এও রাশিয়া প্রথম।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ২০২০ সালের ১১ আগস্ট যখন গর্বের সাথে ঘোষণা করলেন তার দেশ কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন উৎপাদনে বিশ্বে প্রথম স্থান দখল করতে যাচ্ছে তখন স্পুটনিক ভি ভ্যাকসিনের জন্য অভিবাদন অতটা উষ্ণ ছিলো না। বরং বলা যায় অনেকেই এটি নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। কারণ অবশ্য ছিলো। তার মাঝে অন্যতম কারণ হিসেবে কেউ কেউ বলছিলো এটি মানুষের মাঝে চূড়ান্ত ট্রায়াল দেওয়াই তো শেষ করেনি।

এখন অবশ্য দৃশ্যপট বদলে গেছে। মহামারী আক্রান্ত শঙ্কিত বিশ্ব বেশ বুঝতে পারছে স্পুটনিক ভি ভ্যাকসিনটি ছাড়া উপায় নেই-ই নেই। কেননা বিশ্বখ্যাত চিকিৎসা বিষয়ক জার্নাল ল্যানসেটে সম্প্রতি প্রকাশিত একটি গবেষণা বলছে এটি কোভিড-১৯ প্রতিরোধে প্রথম তিনটি ভ্যাকসিনের মাঝে অন্যতম। এটির কার্যকারিতার হার ৯১.৬%। বলা যায় অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনের চেয়ে কার্যকারিতায় এটি ঢের এগিয়ে। অবশ্য এই ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান গ্যামালিয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব এপিডেমিওলোজি ও মাইক্রোবায়োলজি বলেছে এটির কার্যকারিতা ৯৭.৬%।

আরো সুবিধা রয়েছে ভ্যাকসিনটির। এটি বেশ সস্তা। তৃতীয় বিশ্বের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার নাগালের ভিতরে এর অবস্থান। এটি বহন করাও সহজসাধ্য। এমনকি এটি ঘরের সাধারণ ফ্রিজে সংরক্ষণ করে রাখা যাবে। এই ভ্যাকসিনের খুব বড় কোন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া এখনো হয়নি।

তিন সপ্তাহ অন্তর এটি দুটো ডোজে দিতে হয়। ২৮-৪২ দিনের মাঝে তৈরী হয়ে যায় ইমিউনিটি বা রোগ প্রতিরোধক দেয়াল। এটির দুটো ডোজে ব্যবহার করা হয়েছে দুই ধরণের এডেনো ভাইরাস ফলে ইমিউনিটি পোক্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশী।

বিশ্বে অনেক ভ্যাকসিন নিয়ে বিরূপ কান্ড ঘটেছে। জনসন এন্ড জনসনের প্রায় পনেরো মিলিয়ন ডোজ খারিজ করে দেয়া হয়েছে ফ্যাক্টরীর ভুলের কারণে। মার্কিন মুল্লুকে এমনটি ঘটেছে। অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন ত্রিশোর্ধ বয়সীদের প্রয়োগের ক্ষেত্রে বাঁধ সেধেছে ইংল্যান্ড। অস্ট্রেলিয়াও সেই পথে। নরওয়ে এবং ডেনমার্ক এই ভ্যাকসিন প্রয়োগে প্রায় নেতিবাচক অবস্থানে চলে গিয়েছে।

এখন ফাইজারের জয়জয়কার। কিন্ত তারা কূলিয়ে উঠতে পারছে না বৈশ্বিক চাহিদা মেটাতে। ফলে বিশ্ব এখন মুখ তুলে চেয়ে আছে রাশিয়ার পানে। ভারতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের আঘাত ভয়াবহ রূপ নেওয়ায় মার্চ থেকে কার্যত ভ্যাকসিন রপ্তানী বন্ধই করে দিয়েছে। তারা বরং তৃতীয় ভ্যাকসিন হিসেবে এখন স্পুটনিক ভি কে সাধুবাদ জানাচ্ছে। ইতিমধ্যে ভারতের ভারকো বায়োটেক বছরে ২০০ মিলিয়ন ডোজ ভ্যাকসিন উৎপাদনের জন্য রাশিয়ার সাথে চুক্তি করেছে। আর চীনের হুয়ালান বায়োলজিক্যাল ব্যাকটেরিন বছরে ১০০ মিলিয়ন ডোজ উৎপাদনের কাজে অনেকদূর এগিয়ে গেছে। বিশ্বের ৬০টি দেশ স্পুটনিক ভি ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে।

স্পুটনিক বলতে আমরা কৃত্রিম উপগ্রহ বুঝলেও এর আসল অর্থ হলো ভ্রমণ সঙ্গী। বিশ্ব এখন স্থবির হয়ে আছে। ডানা মেলে উড়তে পারছে না এ প্রান্ত থেকে সে-প্রান্তে। অবরুদ্ধ বিশ্ব ভ্রমণে বেরুতে চায়। মুক্ত বিহঙ্গের মতো ভ্রমণে স্পুটনিক হয়ে উঠুক সত্যিকার সঙ্গী। আর বিশ্বমানব মুক্ত হোক মহামারীর ভয়ানক থাবা থেকে। কোভিড-১৯ মুক্ত বিশ্বে আমরা সবাই বুক ভরে নি:শ্বাস নিই।

লে. কর্ণেল নাসির উদ্দিন আহমদ
ক্লাসিফাইড মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট
সিএমএইচ, ঢাকা।
ই-মেইল nasir_amc@yahoo.com

অনুলিখন: জ,ই বু্লবুল।

Print Friendly

Related Posts