গুলশানের ১৪ তলা ভবনের আগুন, প্রাণ হারালেন যারা

ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের উদ্ধার কার্যক্রম ও নিহত আনোয়ার হোসেন

রাজধানীর গুলশান-২ নম্বরে মানারাত ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের পাশের ১৪ তলা ভবনের আগুন রাত ১১টায় ফায়ার সার্ভিসের ১৯টি ইউনিটের প্রচেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রাণ বাঁচাতে সাততলা থেকে লাফিয়ে পড়েন অনেকে। তার মধ্যে আনোয়ার হোসেন (৩০) ও মো. রাজু (৩৮) নামে দুজনের মৃত্যু হয়েছে।

আনোয়ারের গ্রামের বাড়ি ভোলার দৌলতখানের দিদারুল্লা গ্রামে। পিতার নাম মো. নুর ইসলাম। তিনি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) পরিচালক ফাহিম সিনহার বাসায় বাবুর্চি হিসেবে কাজ করতেন। পাঁচ ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। আনোয়ারের স্ত্রী আমেনা বেগম গ্রামে থাকেন। তিনি অন্তঃসত্ত্বা। অগ্নিকাণ্ডে স্বামীর মৃত্যুর খবর শুনে পাগলপ্রায় তিনি। অনাগত সন্তানের মুখটাও যে দেখে যেতে পারলেন না তার স্বামী।

রোববার (১৯ ফেব্রুয়ারি) রাতে আগুন লাগলে ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে আনোয়ার। পরে রক্তাক্ত অবস্থায় আনোয়ারকে দ্রুত উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে জুলহাস গিয়ে রাত ২টার দিকে ভাইয়ের মরদেহ শনাক্ত করে।

আনোয়ারের ভাই জুলহাস গণমাধ্যমকে বলেন, ‘টিভিতে আগুন লাগার খবর দেখে ঘটনাস্থলে যাই। সেখান থেকে জানতে পারি, আমার ভাই লাফিয়ে নিচে পড়ে আহত হয়েছেন। তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। পরে আমি ও আমার বোন হাসপাতালে ছুটে যায়। সেখানে গিয়ে ভাইকে আর জীবিত পাইনি। ভাই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।’

তিনি বলেন, ‘ভাই বিবিসির পরিচালক ফাহিম সিনহার বাসায় বাবুর্চির কাজ করতেন। বাসার বাজার করতেন। ভাবি আমেনা বেগম গ্রামে আছেন। তিনি অন্তঃসত্ত্বা। সন্তানের মুখও দেখে যেতে পারলেন না ভাই।’

এদিকে গুলশানের ওই ভবনটির ১২তলায় থাকতেন ফাহিম সিনহা ও তার স্ত্রী শামা রহমান সিনহা। স্বামী-স্ত্রী ছাড়াও তাদের ১ ছেলে ও ২ মেয়ে এবং ফাহিমের মা নাগিনা আফজাল সিনহা থাকতেন।

আগুন লাগার পর শামা তার তিন সন্তান এবং শাশুড়িকে লিফটে করে নিচে নামিয়ে দেন। এরপর ওই লিফট আবার ১২ তলায় ওঠার পর তিনি নিজে আবার লিফটে করে নামার চেষ্টা করেন। এ সময় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়ায় সপ্তম তলায় গিয়ে তিনি আটকা পড়েন। তখন কৌশলে লিফট থেকে বের হয়ে সাততলার বেলকনির পাশে গিয়ে দাঁড়ান। সেখানে আগুনের লেলিহান শিখা বাড়তে থাকলে সেখান থেকে ভবনের নিচে সুইমিংপুলে লাফিয়ে পড়েন।

বর্তমানে তিনি শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন। সেখানে আরও চারজন চিকিৎসাধীন। এর মধ্যে দুজনের অবস্থা গুরুতর। অন্যদিকে আগুনের ঘটনায় আনোয়ার হোসেন ছাড়াও মো. রাজু মারা গেছেন।

রাজুর ছোট ভাই সজিব জানান, রাজু ভবনের ১২ তলায় কাজ করতেন। আগুন লাগার পর তিনি ওপর থেকে লাফ দেন। আহত অবস্থায় তাকে জয়নুল হক সিকদার ওমেন্স মেডিক‌্যাল কলেজ হাসপাতালের সিসিইউতে ভর্তি করা হয়।

সোমবার (২০ ফেব্রুয়ারি) সকালে সিকদার মেডিক‌্যালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. আখতারুজ্জামান জানান, ভবন থেকে লাফ দেওয়ায় রাজুর শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ভেঙে যায় এবং গুরুতর জখম হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় রোববার (১৯ ফেব্রুয়ারি) রাত ৩টার দিকে তিনি মারা যান। ভোরে রাজুর মরদেহ গাজীপুর কালিগঞ্জে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। রাজুর দুই সন্তান। বড় মেয়ে বয়স ১৩, ছোট ছেলে বয়স ৯ বছর। তিনি একমি কোম্পানির এক কর্মকর্তার বাসায় দুই বছর ধরে বাবুর্চির কাজ করছিলেন।

রোববার সন্ধ্যা ৬টা ৫৯ মিনিটের দিকে গুলশান-২ নম্বরের ১০৪ নম্বর রোডের বহুতল ভবনে আগুন লাগে। খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে যান ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। প্রথমে ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করে। পরে ক্রমান্বয়ে ইউনিট বাড়ানো হয়।

সর্বশেষ ফায়ার সার্ভিসের ১৯টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। আগুন নিয়ন্ত্রণ ও উদ্ধারে যোগ দেন সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, পুলিশ, র‍্যাব ও স্বেচ্ছাসেবক সদস্যরাও। দীর্ঘ চার ঘণ্টা পর রাত ১১টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়। আগুন লাগা ভবনের কয়েকটি ফ্লোর থেকে নারী শিশুসহ ২৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করেছেন ফায়ার ফাইটাররা।

Print Friendly

Related Posts