সেক্সুয়াল অব্জেক্টিফিকেশন ও কিশোরী মুক্তি বর্মণ

আজিজুর রহমান আসাদ 

কিশোরী মুক্তি বর্মণকে হত্যার জন্য, ছামসু মিয়াঁর ছেলে কাউছার দায়ী। আপনেরা দায়ী নন? কাউছারের যে বিশ্বাস, সেটি আপনার বিশ্বাস নয়? কাউছার যে সমাজে ও রাষ্ট্রে তথা ব্যবস্থায় বেড়ে উঠেছে, সেই ব্যবস্থাটি আপনি সমর্থন করছেন না? আপনি কাউছার, কাউছার আপনি।

মুক্তি বর্মণ, তনু, সুমি কিংবা তুমাচিং মার্মাদের হত্যার পটভূমি রয়েছে। কয়েকটি বিষয় মিলে এই পটভূমি তৈরি হয়। কাউছাররা জন্মায়।

প্রথমটি ব্যাটাবাদী বিশ্বাস, পুরুষশ্রেষ্ঠত্ববাদ। এটি মূলত মৌলবাদ ভালভাবে শিক্ষা দিতে পারে ব্যাটাছেলেদের, ধর্মের নামে। যেমনটা, কয়েকদিন আগে কাদের সিদ্দিকী নারীদের ভূমিকা বাতলে দিয়েছেন। ব্যাটারা যা পারে, নারীরা তা পারেনা, বা করা উচিৎ না। কারণ প্রথম ব্যাটার পাঁজরের হাড় থেকে প্রথম নারীর জন্ম, এই বিশ্বাসে।

এই ব্যাটাবাদী বিশ্বাসের নাম পিতৃতন্ত্র। একটি সিস্টেম। যা মাদ্রাসায়, ছেলেশিশুও বলাৎকার করে। যা বাংলাদেশে সমতাভিত্তিক নারীনীতির বিরোধিতা করে। যা বিবর্তনবাদের বিরোধিতা করে, কারণ নারী ও পুরুষের শারীরিক পার্থক্য বুঝলে পুরুষ শ্রেষ্ঠত্ববাদ একটি কুসংস্কার। নারী পুরুষের যে দৃশ্যমান পার্থক্য, তা মূলত ক্রোমোজোমের (XX, এবং XY) দৈর্ঘ্যের কারণে। গুগোল ঘেঁটে যদি দেখেন, দেখবেন, পুরুষের ক্রোমজম আসলে একটু খাটো, এক পা নেই। না, এটা দিয়ে বুদ্ধি বা মূল্যবোধ নির্ধারিত হয় না, নির্ধারিত হয় শারীরিক গঠন। অধিকাংশ পুরুষ যে ব্যাটাবাদী ইতর তার কারণ কিন্তু ক্রোমোজোম না, পিতৃতান্ত্রিক সামাজিকায়ন, শিক্ষা। শিশুকাল থেকেই শুরু হয় পরিবারে, আমাদের দেশে প্রধানতঃ ধর্মশিক্ষায়। আমেরিকায় পুঁজিবাদের শিক্ষায়, নারীকে ‘যৌনবস্ত’ হিসেবে বিজ্ঞাপনে।

এই যে সেক্সুয়াল অবজেক্টিফিকেশন বা নারীকে যৌনবস্তু’ হিসেবে ভাবা, এটির বাংলা নাম, ‘তেঁতুল তত্ত্ব’। তেঁতুল তত্ত্বের আগে রাজাকার সাঈদীর ছিল ‘ছেলা কলা’ তত্ত্ব। এই তত্ত্বে এদের মা, বোন, চাচী, মামি, কিছু নেই, আছে ‘নারীর শরীর’ যা দেখলে ব্যাটাদের লালা ঝড়ে। ব্যাটারা এদের কাছে একটি আত্মনিয়ন্ত্রণহীন যৌনলোলুপ পশু।

এদের হাতে থাকা শ্রেষ্ঠবিজ্ঞান বইতে লেখা আছে সমাধান, নারীকে পর্দায় রাখো, যৌনলোলুপ পশুদের চোখের আড়ালে। নারীর শরীর ঢাকো, ঢাকো, ঢাকতেই থাকো। এই যে বস্তাবন্দী করা, কেন? যাতে যৌনলোলুপ পশুরা নারীদের শরীর দেখতে না পারে। কিন্তু এই যৌন লোলুপ পশুদের মনশ্চক্ষু থেকে নারীদের রক্ষার বিধান এই শ্রেষ্ঠবিজ্ঞান বইতে নেই। বস্তাবন্দী নারীকেও এই যৌনলোলুপ পশুরা যে দিগম্বর করে থাকে, যৌনবাদী মনশ্চক্ষে, এর সমাধান কি?

(এক আলেম মহাজ্ঞানীর মতে, নারীর জুতোর শব্দে বা নাম শুনলে এদের যৌনঅনুভূতি দাঁড়িয়ে যায়।)

এই ব্যাটাবাদী ইতরদের চোখে নারী মানেই ‘যৌনবস্তু’। ইংরেজিতে এটাকে বলে সেক্সুয়াল অব্জেক্টিফিকেশন। দুই সমাজে দুই ভাবে চলে এই সেক্সুয়াল অবজেক্টিফিকেশন, বাংলাদেশে একরকম আর আমেরিকায় আরেক রকম। মানে, এখানে অপ্রয়োজনে ঢেকে দেয়া, আর ওখানে অপ্রয়োজনে উদলা করা। যেমন আমেরিকায় বিশালবক্ষা নারী বিয়ারের বোতল খুলে ফেলে দুই স্তনের চাপে, বিয়ারের বিজ্ঞাপনে। এখানে আবার তিন বছরের মেয়েশিশুকে বোরখায় ঢেকে রাখা হয়। ঢেকে রাখা আর উদলা করার পেছনে ঐ একই দর্শন, সেক্সুয়াল অব্জেক্টিফিকেশন।

(সেক্সুয়াল অব্জেক্টিফিকেশন না বুঝলে গুগোল করেন।)

ব্যাটাবাদী বিশ্বাসের আরেকটি দিক হচ্ছে, নারী মানে সম্পত্তি, প্রপার্টি। বাংলায় ‘মাল’। ব্যাটাবাদী ইতরেরা মেয়েদের ‘মাল’ বলেই চেনে। এই মাল আবার ‘মালে গনিমত’ হয়ে যায় যদি এই নারী হিন্দু হয়। হিন্দুর জমি, হিন্দুর মেয়ে, এই সব সম্পত্তি জবর দখল করা তুলনামূলক সহজ। পিতৃতন্ত্রের এই ‘মাল’ বা ‘সম্পত্তি’ ধারনা, পুঁজিবাদে বেশ সমর্থিত, ব্যক্তিমালিকানার ধারনার সাথে মিলে যায়।

বাংলাদেশে এই হিন্দু বা আদিবাসী মালের মালিকানা পেলে দুই ধরনের লাভ আছে, তাঁকে ‘মুসলমান’ বানানোর মধ্য দিয়ে পরকালের বেহেশত ফ্রী, চৌদ্দ গুষ্ঠি সহ।

দ্বিতীয়টি, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও আইনি বিচার ব্যবস্থা। শিক্ষাব্যবস্থায় নারী বা পুরুষ শরীর নিয়ে বৈজ্ঞানিক শিক্ষাকে নিরুৎসাহিত, নিষিদ্ধ করা হয়েছে। শরীর বুঝতে হলে প্রাথমিক বায়োলজির ধারনা দিতে হবে। সেজন্য বিবর্তনবাদ প্রয়োজন। কেন ছেলেটির শিশ্ন আর মেয়েটির যোনি, এই বিবর্তনের বায়োলজিক্যাল ব্যাখ্যা দিতে হবে। কিন্তু যেই দেশে এই বিজ্ঞান শিক্ষাকে ‘যৌনতা’ ভাবা হয়, সেখানে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের সাথে সমাজবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞান শিক্ষাও ঐ ভাবেই দেখা হয়।

শরীরের বায়োলজি যেমন বোঝা দরকার, শরীরের রাজনীতিও বোঝা দরকার। শিশুটি শরীরের রাজনীতি কিভাবে বুঝবে? বুঝবে, তার শরীরের স্বাধীনতা ও ব্যক্তি অধিকার, “ব্যাড টাচ গুড টাচ” দিয়ে। এটি শরীরের রাজনীতির প্রাথমিক শিক্ষা। তোমার শরীর, প্রাইভেট পার্টস, ব্যক্তিগত অঙ্গ, তোমার নিজের। এখানে কেউ আগ্রাসন করতে পারেনা। সেটা অন্যায় ও অনৈতিক। এই স্বাধীনতা ও অধিকার বোধের শিক্ষা।

(বাঙালীদের অবশ্য ‘প্রাইভেট পার্টস’ নেই, আছে লজ্জাস্থান ও যৌনঅঙ্গ। ভাষাটাই যৌনবাদী)।

আইনি ব্যবস্থায় হিন্দুর জমি ও হিন্দুর মেয়ে দখল করা সহজ, সে উচ্চবিত্ত হলেও। ক্ষুদ্র জমির মালিক গরিব কৃষক, আদিবাসীদের সাথে এখানে হিন্দুদের মিল আছে। বিচার ব্যবস্থায় এরা দীর্ঘসূত্রিতার শিকার হয় কেবল ঘুষের কারণে না, রাজনৈতিক আনুকূল্যও এরা পায় না। এরা ক্ষমতাকাঠামোর ‘মুসলমান’ সাম্প্রদায়িক জাতীয় চেতনার কাছে পরাজিত হতে থাকে।

তৃতীয় বিষয়টি, মনোবিকলনের। ধর্ষকামীতার। স্যাডিজমের। ব্যাটাবাদী সকল ইতরেরা ধর্ষকামীতার রেডলাইন অতিক্রম করতে পারেনা। বিশ্বাস আছে নারীকে মাল বানিয়ে ভোগের ও ব্যক্তিমালিকানার, কিন্তু সেই সাহস নেই, কিংবা বিকৃতি এমন পর্যায়ে যায়নি যে রাস্তায় বা বাসে গায়ে হাত দিবে, কিংবা প্রত্যাখাত হলে খুন করে ফেলবে।

আপনারা কাউছার কেন? কারণ আপনারা সবাই মিলে এই ব্যবস্থাটি টিকিয়ে রাখছেন, পুনরুৎপাদন করছন, মৌলিক পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থাটি আড়াল করছেন, নিজেরাই যৌনবাদী দৃষ্টিভঙ্গী শিক্ষা দিচ্ছেন, আচরণ ও পোশাকের মাধ্যমে। এবং কাউছারদের গড়ে তুলছেন। আপনাদের হয়ে কাউছাররা মুক্তিদের দিনে দুপুরে খুন করছে।

আপনার ছেলেটিকে বাঁচান। তাঁকে যৌনলোলুপ পশুর বদলে মানুষ হওয়ার শিক্ষা দিন, পরিবারেই। বিজ্ঞান শিক্ষা দিন। শরীর নিয়ে, যৌনতা নিয়ে, স্বাধীনতা ও অধিকার নিয়ে, ভালোবাসা নিয়ে। আপনার মেয়েটিকেও একই শিক্ষা দিন, যাতে সে এই ব্যাটাবাদী ইতরদের মোকাবেলা করতে পারে। এবং সারভাইভাল স্ট্রাটেজি হিসেবে যৌনবাদী দৃষ্টিভঙ্গীকে যেন গ্রহণ না করে, বডি শেমিং এর ধারনায় নিজেকে যেন বস্তাবন্দী না করে।

লেখক: বার্লিন প্রবাসী

Print Friendly

Related Posts