গণতন্ত্র ও দূতাবাসতন্ত্র

মো. সাখাওয়াত হোসেন

 

গণতন্ত্র স্বাভাবিকভাবে একটি দর্শনের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত যেখানে জনগণকে প্রাধান্য দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হয় এবং গণতন্ত্রের দর্শন সেই সাক্ষ্য বহন করে। অর্থাৎ রাষ্ট্রের সকল কিছুর পরিচালনা জনগণের মধ্য দিয়ে তথা জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে সুসম্পন্ন হয়ে থাকে এবং জনগণের চাহিদার উপর ভিত্তি করে রাষ্ট্রটি পরিচালিত হয়। এ বিষয়টি গণতন্ত্রের সৌন্দর্য ও বৈশিষ্ট্য, গণতন্ত্রকে পরিচালনা করতে হবে জনগণকে উপজীব্য করে অর্থাৎ জনগণের মতামতের উপর ভিত্তি করে। জনগণের সমর্থন ও সহায়তা থাকলে রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব টিকে থাকে এবং সহায়তাহীন হয়ে গেলে রাজনৈতিক দলের বিলুপ্তি ঘটে থাকে। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে রাজনৈতিক দলগুলো সময়, পরিবেশ, পরিস্থিতি ও প্রতিবেশের উপর নির্ভর করে রাজনৈতিক কর্মসূচি প্রণয়ন করে থাকে। জনগণ ব্যতিরেকে ঘোষিত রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি কোনদিনই আলোর মুখ দেখে না এটি চিরন্তন সত্য।

রাজনৈতিক দলগুলো দেশের স্বার্থ রক্ষার্থে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকে সেখানে দেশের অর্থনীতি, কূটনীতি ও অন্যান্য বিষয়াদি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে উপস্থাপিত হয়ে থাকে। রাজনীতির অন্দরমহলের খবরাখবরে দেখা যায়, বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে সহযোগিতা, সম্প্রীতি ও আন্ত:সম্পর্কের কারণে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার সম্পর্কও সাবলীল ও সহনীয় পর্যায়ে থাকে। কিন্তু বর্তমান সময়ে দেখা যায়, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অরাজনৈতিক পরিবেশের পাশাপাশি বৈরিতা সৃষ্টি হয়েছে, দেখা দিয়েছে অসহনীয় আচরণের বহি:প্রকাশ। শুধু তাই নয়, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার বৈরী পরিবেশের কারণে দলীয় সংঘাত ও পারস্পারিক ভেদাভেদ এবং বিদ্বেষ দেখা দিচ্ছে। দেখা দিয়েছে অস্থিরতা, সামান্য বিষয় নিয়ে শলাপরামর্শ করে নিজেদের মধ্যে মধ্যস্থতা করতে ব্যর্থ হওয়ার অসংখ্য নজির বাংলাদেশে দেখা দিচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের অতীত ইতিহাস ঘেটে দেখা যায়, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ থাকলেও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে পারস্পারিক সহযোগিতার ভিত্তিতে অনেক সমস্যার সমাধান হয়েছে। কিন্তু বর্তমান সময়ের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে সহযোগিতার দ্বৈরথ তেমন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। একসাথে সংলাপে বসা বা আলোচনায় বসার মতো ধৈর্য ও সক্ষমতা নেতাদের মধ্যে লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।

অথচ রাজনীতির টেবিলে আলোচনা তথা সংলাপের মধ্যে অনেক অমীমাংসিত ইস্যুতে সমাধানে নিয়ে আসা যায়। কিন্তু রাজনীতিতে এমন একটি সংস্কৃতি চালু হয়েছে যেখানে দেখা যায়, রাজনীতির মাঠে কোন কিছু ঘটলে নিজেদের মধ্যে আলোচনা না করে বিদেশী বন্ধুদের কাছে অভিযোগ দায়েরের যে নমুনায়ন দেখা যাচ্ছে তা ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য সুখকর নয়। বিদেশী বন্ধুরা আমাদের পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করতে পারে, তাদের দেশের সঙ্গে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যায়নের লক্ষ্যে চুক্তি সম্পাদনে ভূমিকা রাখতে পারে, বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে নিয়োগকৃত দেশের নিকট পত্র লিখে তাদের অভিমত জানাতে পারে কিন্তু কোনভাবেই তাদের মতামত আমাদের উপর চাপিয়ে দিতে পারেন না। কিংবা প্রকাশ্যে এ দেশের রাজনীতির প্রেক্ষাপট ও পরিস্থিতি নিয়ে অসংলগ্ন কথা বলার সুযোগ নেই। এটা কোনভাবেই কূটনীতির ভাষা হতে পারে না, কূটনীতির ভাষা হবে কূটনৈতিক পদ্ধতিতে। ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী কোন দেশের কূটনৈতিক অন্য দেশের অভ্যন্তরীন বিষয়ের উপর হস্তক্ষেপ করতে পারে না। এটাই কূটনীতির ভাষা, কিন্তু অভ্যন্তরীন সংস্কৃতিতে দেখা যায়, দেশের রাজনীতিকেরা আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচনের নানাবিধ বিষয়াদি নিয়ে কূটনীতিকদের দ্বারস্থ হচ্ছে। বিষয়টা কোনভাবেই শোভনীয় নয় আমাদের দেশের রাজনীতিকদের জন্য তথা রাজনীতির জন্য। একটু লক্ষ্য করলে দেখা যায়, বাংলাদেশে অন্য দেশের কূটনীতিকদের যেভাবে মূল্যায়ন করা হয়, গুরুত্ব দেওয়া হয়, কোন কিছু হলেই রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ পাল্লা দিয়ে কূটনীতিকদের সাথে সাক্ষাত করে সেটি মূলত আমাদের দেশের রাজনীতির দেউলিয়াত্ব ব্যতিরেকে আর কিছু নয়।

বাংলাদেশের কতিপয় রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিবিদেরা জনগণকে সঙ্গে নিয়ে, যৌক্তিক দাবি উপস্থাপনের প্রয়াসে রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায়ের চেয়ে বিদেশীদের নিকট ধরণা দেওয়াকে প্রাধান্য দিচ্ছে মনে হয়। এ জাতীয় রাজনীতিবিদদের গণতন্ত্রের তুলনায় দূতাবাসপ্রীতির বিষয়ে বেশ কিছু কারণকে দায়ী করা যেতে পারে। প্রথমত হচ্ছে, জনগণের সঙ্গে তাদের একটি অঘোষিত দূরত্ব অর্থাৎ জনগণের সাথে বেশ কিছু রাজনৈতিক দলের দীর্ঘদিনের দূরত্ব তৈরি হওয়ায় দলের আহবানে সাধারণ জনতা সাড়া না দেওয়ার ফলশ্রুতিতে দলগুলোর অন্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যেমনভাবে দূরত্ব তৈরি হয়েছে ঠিক তেমনিভাবে দেশের প্রচলিত নিয়ম কানুন ও বিধি বিধানের প্রতি দায়বদ্ধতা কমে যাওয়ার ফলস্বরূপ দলের নেতারা গণতন্ত্রমূখী না হয়ে দূতাবাসমুখী হয়ে উঠছে।

দ্বিতীয়ত: রাজনৈতিক দল হিসেবে তেমন সমৃদ্ধ নয় এমন দলগুলোই মূলত জনগণকে পাশ কাটিয়ে বিদেশীদের নিকট অভিযোগে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। আবার কতিপয় দেশের দূতাবাসে দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের আচরণে মনে হচ্ছে তারা কূটনীতির শিষ্টাচার ভুলে এদেশের অভ্যন্তরীন রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করার জন্যই এসেছে। এসব কোনভাবেই কাম্য নয়। কেননা কূটনীতিকদের নিকট হতে শোভন আচরণ জরুরী এবং কূটনীতির ভাষা নিয়ে কারোর কোনরূপ অভিযোগ দাখিলের সুযোগ থাকার কথা নয়। কিন্তু এ দেশে দায়িত্বপ্রাপ্তরা মনে হয় ভিয়েনা কনভেনশনের কথা ভুলে বাংলাদেশে রাজনীতিতে নেমেছে শিষ্টাচার বহির্ভূত আচরণের মধ্য দিয়ে।

তৃতীয়ত: নেতাকর্মীরা দলের প্রতি অনুগত নয় বিধায় রাজনৈতিক দলগুলো জনগণ থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। সে কারণেই তারা তাদের আন্দোলনের গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছে এবং অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির জন্যই তারা বিদেশী কূটনীতিকদের নিকট বাংলাদেশের অভ্যন্তরীন রাজনীতি নিয়ে অযাথিতভাবে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ সৃষ্টি করেছে।

চতুর্থত: জনগণের প্রতি কমিটমেন্টের জায়গা থেকে রাজনৈতিক দলগুলো সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হওয়ায় জনগণকেন্দ্রিক কোন আন্দোলন রাজপথে না থাকায় কতিপয় রাজনৈতিক দল ষড়যন্ত্রমূলক কর্মকান্ডের পায়তারা থেকে বিদেশী কূটনীতিকদের দ্বারস্থ হচ্ছে এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীন রাজনীতি নিয়ে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ সৃষ্টি করে দিচ্ছে। সে কারণেই দেখা যাচ্ছে, সামান্য বিষয় নিয়েও রাজনৈতিক দলের নেতারা কূটনৈতিক কার্যালয়ে ভিড় করছে।এ ধরনের অশোভনীয় বিষয় রাজনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করেছে এবং রাজনীতিবিদদের থেকে জনগণের একটি অঘোষিত দূরত্বের কার্যক্রমের সূচনা হয়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে, কতিপয় রাজনৈতিক দল রাজনীতির বিষয়ে দলীয়ভাবে আলোচনা না করে, অন্য আদর্শের বিশ্বাসী রাজনৈতিক মতাদর্শের বোদ্ধাদের নিকট আলোচনার টেবিলে না বসে কূটনীতিকদের দ্বারস্থ হচ্ছে, এটি কোনভাবেই সমীচিন নয়। সে কারণেই কূটনীতিকরাও সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে অবৈধভাবে হস্তক্ষেপ করার। রাজনীতিবিদদের বুঝতে হবে এদেশের ভবিষ্যৎ ঠিক করবে এ দেশীয় রাজনীতিবিদেরা। যে কোন সমস্যায় রাজনীতিবিদেরা সংবিধানের আলোকে, আইনগত উপায়ে সমাধানের ব্যাপারে ব্রতী হবেন, কিন্তু কি হীন উদ্দেশ্যে এ দেশের কতিপয় ব্যক্তিবর্গের বিদেশী রাষ্ট্রদূতদের দ্বারস্থ হতে হয় সে বিষয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। তবে এ কথা নিশ্চিতভাবে উল্লেখ করা যায়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীন রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করার মতো সুযোগ, পরিবেশ কিংবা পরিস্থিতি বর্তমানে কোন দেশের নেই। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে তাঁর সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে, বাংলাদেশ বিশ্ব শক্তিশালী অর্থনীতির মধ্যে অন্যতম। করোনা মহামারী বাংলাদেশ চমৎকারভাবে মোকাবেলা করেছে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে। কাজেই বাংলাদেশকে অবমূল্যায়নের সুযোগ নেই, সমসাময়িক বিশ্বে বাংলাদেশ তাঁর সক্ষমতার স্বাক্ষর দেখিয়েছে। পৃথিবীর বহু রাষ্ট্র বাংলাদেশকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে রোল মডেল হিসেবে দেখে থাকে এবং তাদের স্ব স্ব দেশে উন্নয়নের বাংলাদেশ মডেলকে প্রতিপাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা হচ্ছে।

কাজেই মূল্যায়নের মাধ্যমে প্রতীয়মান হয়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীন রাজনৈতিক সমস্যা নিষ্পত্তিতে কূটনৈতিকদের দ্বারস্থ হওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশের জনগণের ব্যাপক আপত্তি রয়েছে এবং বাংলাদেশের মানুষ প্রত্যাশা করে এদেশের রাজনীতিবিদেরা যে কোন সংকটময় পরিস্থিতিতে নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করবে। অতীতে দেখা গেছে আলোচনার টেবিলে বসে রাজনীতিবিদেরা সংকটকে মোকাবেলা করার চেষ্টা করেছেন, সংঘাতময় পরিস্থিতির উত্তরণে কাজ করেছেন। খুবই আক্ষেপের সঙ্গে লক্ষ্য করা যাচ্ছে রাজনীতি থেকে সৌহার্দ, সম্প্রীতি ও মূল্যবোধের জায়গাগুলো প্রতিনিয়ত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এবং এসবের উত্তরণে সকল পক্ষের একত্রে কাজ করা উচিত। উন্নত বাংলাদেশে বিনির্মাণের যে স্বপ্ন আমরা দেখছি তার বাস্তবায়নে আমাদেরকে কাজ করে যেতে হবে, ভিশন ২০৪১ পরিপূর্ণরূপে বাস্তবায়নে আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন এবং আলোচনার টেবিলে রাজনীতিবিদদের বসে দেশের অভ্যন্তরীন সমস্যার নিষ্পত্তি করা প্রয়োজন; সেক্ষেত্রে বিদেশীদের দ্বারস্থ হওয়া কোনভাবেই সমীচিন নয় এবং বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ এ জাতীয় বিষয়গুলোকে চরমভাবে অপছন্দ করেন। আমরা প্রত্যাশা রাখি, আমাদের রাজনীতিবিদেরাও এ দেশীয় জনগণের আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটিয়ে রাজনীতিতে উদ্ভূত সমস্যাগুলোকে সমাধানে ব্রতী হবেন।

লেখক:সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

Print Friendly

Related Posts