পবিত্র হজের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছে। সৌদি আরবের তাঁবুর শহরখ্যাত মিনায় অবস্থানের মধ্য দিয়ে গতকাল রোববার থেকে হজ পালনের পাঁচ দিনব্যাপী এই আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়।
বাংলাদেশসহ ১৬০টি দেশের ২০ লক্ষাধিক ধর্মপ্রাণ মুসলমান এই আনুষ্ঠানিকতায় অংশ নিচ্ছেন।
হজ পালনের উদ্দেশ্যে হজযাত্রীরা আগামী ১২ জিলহজ পর্যন্ত (সৌদি আরবের সময় অনুযায়ী) পর্যায়ক্রমে মিনা, আরাফাত ময়দান, মুজদালিফা ও মক্কায় অবস্থান করবেন। তাঁদের মুখে উচ্চারিত হবে ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হাম্দা, ওয়ান নি’মাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা শারিকা লাক’ ধ্বনি। অর্থাৎ ‘আমি উপস্থিত হয়েছি হে আল্লাহ। আমি উপস্থিত হয়েছি তোমার সমীপে। তোমার কোনো শরিক নেই। ফের আমি উপস্থিত হয়েছি। নিশ্চয়ই সব প্রশংসা ও সব নিয়ামত শুধু তোমারই জন্য। সব সাম্রাজ্যও তোমার এবং তোমার কোনো শরিক নেই।’
পবিত্র হজ পালনের প্রথম আনুষ্ঠানিকতার অংশ হিসেবে হজযাত্রীরা আজ (সোমবার) সারাদিন মক্কার মসজিদুল হারাম (কাবা শরিফ) থেকে পূর্ব দিকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে দু’দিকে পাহাড় পরিবেষ্টিত এলাকা মিনায় অবস্থান করবেন। মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় জিকিরে মশগুল থাকবেন। মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর নামে গুঞ্জরিত হবে পুরো মিনা এলাকা। হজযাত্রীরা সেখানে যাঁর যাঁর তাঁবুতে (সুউচ্চ ফায়ার প্রুফ ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত) অবস্থান করে আজ জোহর থেকে আগামীকাল ফজরসহ মোট পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করার পাশাপাশি অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল থাকবেন। কেউ কেউ আজ মিনায় এসে ফজরের নামাজ আদায় করেছেন। এদিন রাতে মিনায় অবস্থান করা সুন্নত।
মিনায় আসার আগে গতকাল রোববার পবিত্র নগরী মক্কায় জোহরের নামাজ আদায় করেছেন হজযাত্রীদের অনেকে। এর পর তারা পবিত্র নগরী মক্কায় কাবা শরিফ তাওয়াফ করেছেন। তাওয়াফ করার পর হজযাত্রীরা দলে দলে বিভক্ত হয়ে মিনায় জড়ো হতে শুরু করেন। তাদের মধ্যে পুরুষরা হজের প্রথম রুকন ইহরাম (শরীরের নিচের অংশে আড়াই হাত বহরের আড়াই গজের এক টুকরা কাপড় আর গায়ে জড়িয়ে নেওয়ার জন্য একই বহরের তিন গজের এক টুকরা সেলাইবিহীন সাদা কাপড়) পরিধান করেছিলেন। নারীরা ছিলেন পর্দায় আচ্ছাদিত। তাঁরা ইহরামের নিয়তে দুই রাকাত নামাজ আদায়ের পর মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা ও রহমত চেয়ে অঝোরে কান্নাকাটি করেন। সারাক্ষণ জিকিরে মশগুল ছিলেন।
মিনা থেকে আরাফাত ময়দানে
আগামীকাল ৯ জিলহজ (সৌদি সময়) পবিত্র হজ। পাঁচ দিনব্যাপী হজের এটাই প্রধান আনুষ্ঠানিকতা। পবিত্র হজ পালনের জন্য সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহর দরবারে হাজিরা দিতে সৌদি আরবে আসা মুসলমানরা হজের দ্বিতীয় রুকন আদায়ের জন্য ৯ জিলহজ সূর্যোদয়ের পর মিনা থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে আরাফাতের ময়দানে সমবেত হবেন। সূর্যাস্ত পর্যন্ত এই ময়দানের চারদিকে হলুদ বোর্ড দিয়ে চিহ্নিত এলাকার ভেতরে অবস্থান করবেন সারাবিশ্ব থেকে আসা লাখ লাখ মুসলমান। এখানেই হজের মূল আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা হবে।
আরাফাত ময়দান হলো বিদায় হজের স্মৃতিবিজড়িত এলাকা। মঙ্গলবার এই ময়দান প্রকম্পিত হবে লাখ লাখ হজযাত্রীর প্রায় সার্বক্ষণিক জিকিরে। তাদের তালবিয়া, অর্থাৎ ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক… লা শারিকা লাক’ ধ্বনিতে গোটা আরাফাত ময়দান প্রকম্পিত হবে।
১৪০০ বছরের বেশি সময় আগে এই আরাফাত ময়দানেই বিদায় হজের খুতবা দিয়েছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত হজরত মুহাম্মদ (সা.)। এ কারণে আরাফাত ময়দানে উপস্থিত না হলে হজের আনুষ্ঠানিকতা পূর্ণাঙ্গ হয় না। তাই ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ রুকন পবিত্র হজ পালনের জন্য সৌদি আরবে আসার পর যাঁরা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নেন, তাঁদেরও অ্যাম্বুলেন্সে করে আরাফাতের ময়দানে আনার ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। কেউ কেউ হুইলচেয়ারে করে এই ময়দানে আসেন।
আরাফাত ময়দানের মসজিদে নামিরা থেকে জোহরের নামাজের আগে মিম্বরে দাঁড়িয়ে আরবি ভাষায় হজের খুতবা পাঠ করা হবে। এবার খুতবা দেবেন শায়খ ড. ইউসুফ বিন মোহাম্মদ। তিনি নামাজের ইমামতিও করবেন। হজের খুতবা বাংলাসহ প্রায় ১৪টি ভাষায় অনুবাদ করে শোনানোর প্রস্তুতি রয়েছে। এই খুতবা বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ সারাবিশ্বের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার করা হবে। হজযাত্রীরা হজের খুতবা শুনবেন।
পবিত্র হজের খুতবার পর মসজিদে নামিরায় সমবেত মুসলমানরা এক আজান এবং দুই ইকামতে জোহর ও আসরের নামাজ একসঙ্গে জামাতে আদায় করবেন। কারও অবস্থান মসজিদে নামিরা থেকে দূরে থাকলে তিনি নিজের তাঁবুতে জোহর এবং আসরের নামাজ আলাদাভাবে আদায় করবেন। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্তের পর কিছু সময় পর্যন্ত হজযাত্রীরা আরাফাতের ময়দানেই অবস্থান করবেন। সূর্যাস্তের পর কিছু সময় পর্যন্ত এই ময়দানে অবস্থান করাটা ওয়াজিব।
আরাফাত ময়দান থেকে মুজদালিফায়
৯ জিলহজ (সৌদি আরবে মঙ্গলবার) সূর্য অস্ত যাওয়ার কিছু সময় পরে মাগরিবের নামাজ আদায় না করেই আরাফাত ময়দান থেকে হজযাত্রীরা প্রায় আট কিলোমিটার দূরে মুজদালিফার উদ্দেশে রওনা দেবেন। মুজদালিফায় গিয়ে এশার নামাজের সময় একসঙ্গে মাগরিব ও এশার নামাজ আদায়ের পর তাঁরা সেখানেই খোলা আকাশের নিচে বিস্তীর্ণ খোলা মাঠে রাত যাপন করবেন। রাতে প্রতীকী শয়তানের উদ্দেশে নিক্ষেপের জন্য সেখান থেকে ৭০টি পাথর সংগ্রহ করবেন। সুবহে সাদিক পর্যন্ত মুজদালিফায় অবস্থান করাটা সুন্নতে মুআক্কাদাহ।
মুজদালিফা থেকে মিনায়
১০ জিলহজ ফজরের নামাজ আদায়ের পর সূর্যোদয়ের আগে কিছু সময় অবশ্যই মুজদালিফায় অবস্থান করবেন হজযাত্রীরা। এর পর তারা ট্রেনে, গাড়িতে অথবা হেঁটে মুজদালিফা থেকে মিনায় যাবেন। সেখানে মিনার জামারায় (শয়তানের উদ্দেশে পাথর ছোড়ার স্থান) বড় শয়তানের উদ্দেশে প্রতীকী সাতটি পাথর নিক্ষেপ শেষে পশু কোরবানি এবং রাসুলুল্লাহর (সা.) আদর্শ অনুসরণে পুরুষরা মাথা মুণ্ডন ও গোসল করবেন। নারীরা চুলের অগ্রভাগ থেকে প্রায় এক ইঞ্চি পরিমাণ চুল কাটবেন। এর পর হাজিরা সেলাইবিহীন ইহরাম খুলে ফিরবেন স্বাভাবিক পোশাকে।
১০ জিলহজ বুধবার সৌদি আরবে পবিত্র ঈদুল আজহা। হাজিদের কেউ কেউ নিজে কিংবা বিশ্বস্ত কাউকে দিয়ে মুস্তাহালাকায় (কোরবানির পশুর হাট ও জবাই করার জায়গা) গিয়ে কোরবানি দেন। কেউ কেউ কোরবানি দেন সৌদি আরব সরকারের বেঁধে দেওয়া ৮১০ সৌদি রিয়াল ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকে জমা দিয়ে।