ডেঙ্গুর মৌসুম অন্তত গত বছরের মতো দীর্ঘ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে যা আগামী নভেম্বর পর্যন্ত হতে পারে, বলেছেন স্থপতি ইকবাল হাবিব।
তিনি বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)’র উদ্যোগে “পরিবেশ ও সামাজিক অভিঘাতের প্রেক্ষিতে ডেংগুর প্রসার”-শীর্ষক এক আলোচনা সভায় মূল প্রবন্ধে এ কথা বলেন।
রোববার (৬ আগস্ট) সকাল ১০.৩০ মিনিটে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি’র সাগররুনি-মিলনায়তন, সেগুনবাগিচা, ঢাকায় বাপা’র সভাপতি অধ্যাপক নুর মোহাম্মদ তালুকদার এর সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবির এর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাপা’র সহ-সভাপতি স্থপতি ইকবাল হাবিব।
স্থপতি ইকবাল হাবিব তার মূল প্রবন্ধে বলেন, ডেঙ্গু জ্বর একটি মশাবাহিত ভাইরাল সংক্রমণ। এটি সাধারণত বিশ্বের গ্রীষ্মমন্ডলীয় এবং উপক্রান্তীয় অঞ্চলে দেখা যায়। এডিস প্রজাতির স্ত্রী মশার কামড়ে এটি হয়ে থাকে। এটি তখনই ঘটে যখন মশা একটি সংক্রমিত ব্যক্তিকে কামড় দেয় এবং তারপর ভাইরাস বহন করার সময় একটি অ-সংক্রমিত ব্যক্তিকে কামড় দেয়। পৃথিবীতে প্রায় ৩,৫০০ প্রজাতির মশার ২৫% হচ্ছে এডিস। বাংলাদেশে প্রাপ্ত ১২৬ প্রজাতির মশার মধ্যে ২৬টি এডিস যার দুটি প্রজাতি-এডিস ইজিপ্টি ও এডিস অ্যালবোপিকটাস ডেঙ্গু ভাইরাসের প্রধান বাহক। ডেঙ্গুর চারটি ধরণ, ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩ এবং ডেন-৪ এর মধ্যে কয়েক বছর ধরে দেশে ডেন-২ ও ডেন-৩-এর প্রাদুর্ভাব বেশি। ৮ জুলাই ২০২৩ তারিখ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যুসংখ্যা ছিল ৬৭। তিনি আরো বলেন ১৬ জুলাই ২০২৩ পর্যন্ত, সামগ্রিকভাবে, হাসপাতালে ভর্তি মোট ডেঙ্গু আক্রান্ত সংখ্যা ২০,৮৭৮ এবং মারা গেছেন মোট ১০৬ জন রোগী ডেঙ্গু। বাংলাদেশে এ বছর মশাবাহিত রোগে মোট মৃত্যুর সংখ্যা ১১৪, যা ২০২২ সালের তুলনায় ৫ গুণ বেশি। ডিজিএইচএসের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর ১৭ জুলাই পর্যন্ত মোট সরকারি মৃত্যুর সংখ্যা ১১৪, ঢাকা শহরে ৮৭ জন, চট্টগ্রামে ১৭ জন, ময়মনসিংহে ৩ জন, রাজশাহী ও খুলনায় ২ জন এবং রংপুর ও বরিশাল বিভাগে ১ জন করে মৃত্যু হয়েছে। ২০২১ সালে মৃত্যু হয়েছিল ১০৫ জনের । ২০২২ সালে দেশে সর্বোচ্চ ২৮১ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার তথ্য জানানো হলেও চলতি বছরের শুধুমাত্র জুলাই মাসেই মারা গেছেন ২০৪ জন।(সুত্রঃ দৈনিক ইত্তেফাক, ৩ আগস্ট ২০২৩)। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি অনুসারে এ বছর (২০২৩) ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা ৫ আগস্ট পর্যন্ত ৩০৩ জন। ডেঙ্গুতে মোট আক্রান্ত ৬৩,৯৬৮ জন; ঢাকায় ৩৪,৫২৩ এবং ঢাকার বাইরে ২৯,৪৪৫ জন। (সুত্রঃ প্রথম আলো, ৫ আগস্ট ২০২৩)।
অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইনস্টিটিউট অব এপিডেমিওলজি, ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চ (আইইডিসিআর) এর অন্যতম উপদেষ্টা, ডা. মুশতাক হোসেন, ডক্টরস ফর হেলথ এন্ড এনভায়রনমেন্ট এর সভাপতি অধ্যাপক ড. এম আবু সাঈদ, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী এবং বিশিষ্ট কীটতত্ত্ববিদ, অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার।
এতে উপস্থিত ছিলেন বাপা’র কোষাধ্যক্ষ জাকির হোসেন, যুগ্ম সম্পাদক হুমায়ুন কবির সুমন, ফরিদুল ইসলাম ফরিদ, নূর আলম শেখ এবং বাপা জাতীয় কমিটির সদস্য নাজিম উদ্দীন, হাজী শেখ আনছার আলী, ফাহমিদা নাজনিন তিতলি, আব্দুস সামাদ প্রধান, শাকিল কবিরসহ বাপা অন্যান্য কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ এব বিভিন্ন পরিবেশবাদী ও সামাজিক আন্দোলনের প্রতিনিধিবৃন্দ।
সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক নুর মোহাম্মদ তালুকদার বলেন, ষাটের দশকে দেশ থেকে ম্যালেরিয়া নির্মুল হয়েছিল কিন্তু এখন আবার সেই ম্যালেরিয়ার প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে’ যেটা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে। দেশে সরকারসহ সকল স্তরে সচেতনতা কর্মকার্ড পরিচালনা, নিয়োমিত তদারকি ও সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহনই ডেঙ্গু রোধে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে বলে তিনি মনে করেন।
ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ডেঙ্গু এখন আর শহরে রোগ না বরং এটি এখন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। তাই সরকার ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়োমিত ব্রিফিং এর মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে দ্রুত ও কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহনের আব্হবান জানান। দেশের প্রতিটি ওয়ার্ডে প্রতিটি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ডেঙ্গু পরীক্ষা কেন্দ্র চালু করতে হবে। যারা পজিটি হবেন তাদেরকে বিশেষ চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিটি কেন্দ্রে মশা প্রতিরোধক নেট ব্যবহারের আয়তায় আনতে হবে। তিনি বলেন ডেঙ্গু সম্পূর্ণ মৃত্যু প্রতিরোধযোগ্য রোগ সুতরাং দেশে এর জন্য উন্নত গবেষণা করে টিকা আবিস্কার ও তা প্রদানের দাবী জানান। বছর ব্যাপী সচেতনতামূলক কর্মকান্ডের পাশাপাশি প্রশিক্ষণ প্রদানের আহ্বান জানান।
অধ্যাপক ড. এম আবু সাঈদ বলেন, দেশে অপরিকল্পিত নগরায়ন ও ডি-ফরেষ্টেশনের ফলে জলবায়ুর পরিবর্তন। এই জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্ব ব্যাপী বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিনি দেশের পরিবেশ রক্ষায় সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন সংশ্লিষ্ট কতৃপেক্ষের মশা নিধনে দৃঃশ্যত তেমন কোন উল্লেখযোগ্য ও কার্যকর পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। ডেঙ্গু আক্রান্ত বেশীরভাগ রোগীর কোন উপসর্গ লক্ষ্য করা যায় না। সে কারনে দেশে প্রকৃত আক্রান্ত ও মৃত্যুর তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। যে সংখ্যা প্রকাশ করা হচ্ছে প্রকৃত পক্ষে তার চেয়ে অনেক বেশী আক্রান্ত মৃত্যু বরণ করছে। আক্রান্তের তুলনায় পরীক্ষা কেন্দ্র খুবই সামান্য। দেশে এতোদিন ধরে হাজার হাজার মানুষ মারা গেল অথচ এ রোগ নিয়ে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য গবেষণা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। তিনি দেশে জনস্বাস্থ্যগত জরুরী অবস্থা জারী করার প্রস্তাব করেন। একই সাথে দ্রুত ভ্যাকসিন সংগ্রহ ও প্রদানের দাবী জানান।
অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে লক্ষ্য করা যায় বহুতল ভবনের গাড়ীর গ্যারেজ, গাড়ী পরিস্কারের স্থানে পানি জমে মশার সৃষ্টি হয। কিন্তু এসকল বহুতল ভবনে অনেক সচেতন মানুষ বসবাস করেন। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অনেজ জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় এসকল স্থানে পানি নিস্কাশনের উপযুক্ত ব্যবস্থা না থাকায় মশার বিস্তার লাভ করে। তিনি সরকারের পাশাপাশি নিজ নিজ উদ্যোগে মশার বিস্তার ও জন্ম নেয় এসকল স্থান নিয়োমিতভাবে নিজেদের পরিস্কার করার আহ্বান জানান।
আলমগীর কবির বলেন, সরকারের দায়িত্বশীল সংস্থা ও ব্যক্তি ডেঙ্গু নির্মূলে তাদের দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে। তারা যদি সারাদেশের এডিস মশার প্রজননগুলো সময়মত ধ্বংস করতো তা হলে এ মশার বংশ বিস্তার নষ্ট হয়ে যেতো। তিনি দেশে পলিও খাওয়ানোর আদলে দেশে ডেঙ্গু নিধনের কীট ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরবরাহের ব্যবস্থা গ্রহণের আহবান জানান।
সভা থেকে ডেঙ্গু প্রতিরোধে নিম্মোক্ত প্রস্তাবনাসমূহ তুলে ধরা হয়ঃ
ক. প্রাধিকারযুক্তিতায় এখনি করণীয়ঃ
১. ডেঙ্গু প্রতিরোধে সকল সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাসমূহের সমন্বিত ও কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
২. অনতিবিলম্বে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রণীত ইন্টিগ্রেটেড ভেক্টর ম্যানেজমেন্ট গাইডলাইন বাস্তবায়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
৩. স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সিটি করপোরেশনের প্রতিটি ওয়ার্ডকে ১০টি উপ-অঞ্চলে ভাগ করতে হবে এবং প্রতিটিতে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে সম্পৃক্ত করে কমিটি গঠন নিশ্চিত করতে হবে।
৪. ডেঙ্গু প্রতিরোধে ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরি এবং সকলের অংশগ্রহণে কর্মসূচী বাস্তবায়নকল্পে প্রয়োজনীয় বাড়তি বিনিয়োগ ও কর্মোদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
খ. প্রাধিকারযুক্তিতায় এখনি করণীয়ঃ
৫. ডেঙ্গুর নজরদারি পদ্ধতি জাতীয় স্বাস্থ্যগত তথ্য ব্যবস্থার একটি অংশ হওয়া উচিত এবং স্বাস্থ্য প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরকে এই ডেঙ্গু নজরদারি ব্যবস্থার আওতায় সম্পৃক্ত করতে হবে।
৬. ডেঙ্গু আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যা হ্রাসকরণে সমন্বিত ও কার্যকরী ভেক্টর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রণয়ন এবং সঠিকভাবে তার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
৭. ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য অন্যান্য কৌশলের পাশাপাশি টিকাদান প্রক্রিয়া কার্যকরণে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
৮. ঢাকাসহ সকল সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভায় কীটতত্ত্ববিদ নিয়োগ এবং ডেঙ্গু প্রতিরোধ সংক্রান্ত গবেষণায় পর্যাপ্ত বিনিয়োগ প্রদান।
৯. দীর্ঘসূত্রিতা রোধকল্পে এডিস মশা নির্মূলে প্রয়োজনীয় রাসায়নিক/ কীটনাশক আমদানীর অনুমোদন কৃষি বিভাগের কীট তত্ত্ব বিভাগের পরিবর্তে স্বাস্থ্য বিভাগের নিকট হস্তান্তর উচিত।
গ. ধারাবাহিকভাবে করণীয়ঃ
১. বাংলাদেশকে তার নীতিগুলি পুনর্বিবেচনা করতে হবে এবং পরিচ্ছন্নতার দিকে আরও বেশি মনোযোগ দিতে হবে।
২. বিটিআই ও Wolbachia পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে এডিস মশার মাধ্যমে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ক্ষমতা হ্রাস করা উদ্যোগ বিবেচনা করতে হবে ।
৩. জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণতার অভিঘাতসমূহ নিরসনে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন।
৪. নগর পরিকল্পনায় জনস্বাস্থ্যের বিষয়ে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখা এবং পরিকল্পনার বিদ্যমান ত্রূটিসমূহ দূরীকরণে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ।
৫. বিদ্যমান জলাধার ও খালসমূহকে নানাবিধ দূষণ হতে রক্ষা করা এবং উক্ত খালসমূহে পানির সলল প্রবাহের অবিচ্ছিন্ন নেটওয়ার্ক নিশ্চিতকরণ আশু উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে ।
৬. কঠিন ও তরল বর্জ্য পরিকল্পিতভাবে নিঃশেষ করা যাতে করে তা মশার প্রজনন ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতে না পারে, সেই উদ্যোগ নিতে হবে ।
সূত্র : আলমগীর কবির সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)