‘অনেক বৃষ্টি ঝরে তুমি এলে যেন এক মুঠো রোদ্দুর আমার দু’চোখ ভরে’

আবু হেনা মোস্তফা কামালের ৩৪তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ

শাহ মতিন টিপু

‘অনেক বৃষ্টি ঝরে/তুমি এলে যেন এক মুঠো রোদ্দুর/আমার দু’চোখ ভরে’ কিংবা ‘নদীর মাঝি বলে এসো নবীন/ মাঠের কবি বলে এসো নবীন/দেখেছি দূরে ওই সোনালি দিন’-চিরায়ত হওয়া এই গানের কথাগুলোর স্রষ্টা আবু হেনা মোস্তফা কামাল।

‘সেই চম্পা নদীর তীরে/দেখা হবে আবার যদি/ফাল্গুন আসে গো ফিরে’, ‘তুমি যে আমার কবিতা, আমার বাঁশির রাগিনী’, ‘পথে যেতে দেখি আমি যারে’, ‘এই পৃথিবীর পান্থশালায় গাইতে গেলে গান’, ‘তোমার কাজল কেশ ছড়ালো বলে/এই রাত এমন মধুর/তোমার হাসির রঙ লাগল বলে/দোলে ঐ মনের মুকুর’-চমৎকার এই গানের কথাগুলোও আবু হেনা মোস্তফা কামালের।

তিনি কেবল গীতিকারই নন একাধারে কবি, শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, গবেষক ও সমালোচক। আর সবগুলো শাখাতেই তিনি ছিলেন সফল।

এই বরেণ্য শিক্ষাবিদের ৩৪তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি ১৯৮৯ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।

১৯৩৬ সালের ১৩ মার্চ পাবনা থানার গোবিন্দা গ্রামে জন্ম। বাবা এম. শাহজাহান আলী ছিলেন স্কুল শিক্ষক। আবু হেনা মোস্তফা কামালরা তিন ভাইবোন। সবার বড় বোন সাবেরা খাতুন শামসুন আরা। সাবেরা খাতুনের স্বামী খ্যাতিমান সাংবাদিক কেজি মুস্তাফা। সাবেরা মুস্তাফা অধ্যাপক এবং মঞ্চ ও বেতারের অভিনেত্রী ছিলেন। তার পরে আবু হেনা মোস্তফা কামাল। ভাইবোনদের মধ্যে ছোট আবুল হায়াৎ মোহাম্মদ কামাল। গীতিকার হিসেবে তিনি সুপরিচিত।

বাংলা বিভাগের অধ্যাপনা সূত্রে আবু হেনা মোস্তফা কামাল প্রবন্ধ সাহিত্য ও সমালোচনা সাহিত্যের একটি আলাদা ধারা তৈরি করেন, যা রেফারেন্স হিসেবে ছাত্রছাত্রী ও গবেষকরা ব্যবহার করেন। তিনি দেশের একজন শক্তিমান কবি ও গীতিকার। এত জনপ্রিয় গান তিনি লিখেছেন যে, তিনি আর কিছু না করে শুধু গানই লিখতেন চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকতেন।

আবু হেনার কর্মজীবন বর্ণাঢ্য ও বৈচিত্র্যময়। তার কর্মজীবন শুরু করেন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে শিক্ষকতা দিয়ে। পরবর্তী সময় চাঁপাইনবাবগঞ্জ সরকারি কলেজ, রাজশাহী সরকারি কলেজ এবং গণসংযোগ পরিদপ্তরে কাজ করেন। ১৯৬২ সালে তিনি জনসংযোগ পরিদপ্তরে সহকারী পরিচালক পদে যোগদান করেন। ১৯৬৩ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে লেকচারার হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬৫ সালে তিনি বাংলা বিভাগের সিনিয়র লেকচারার হয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। তিনি ১৯৬৬ সালে কমনওয়লথ বৃত্তি নিয়ে উচ্চতর গবেষণার জন্য লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। ১৯৭৩ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক পদে যোগ দেন। ১৯৭৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগে অধ্যাপক পদে যোগদান করেন। ১৯৮৪ সালে তিনি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক এবং ১৯৮৬ সালে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক নিযুক্ত হন।

আপন যৌবন বৈরী (১৯৭৪), যেহেতু জন্মান্ধ (১৯৮৪) ও আক্রান্ত গজল (১৯৮৮) প্রকাশিত মাত্র এই তিনটি গ্রন্থের মাধ্যমেই শক্তিমান কবি হিসেবে বাংলা কবিতার ইতিহাসে স্থান নিশ্চিত করে নিয়েছেন আবু হেনা মোস্তফা কামাল।

বলা হয়, আবু হেনা মোস্তফা কামালের কবি খ্যাতিকে ছাপিয়ে গিয়েছিল তার গীতিকবির খ্যাতি। বাংলা সংগীত ভান্ডারে তিনি যোগ করেছিলেন অসাধারণ সব গান। আবু হেনা দুই হাজারের বেশি গান লিখেছেন। ১৯৯৫ সালে তার ২০৭টি গানের সংকলন প্রকাশ পায় ‘আমি সাগরের নীল’ নামে। এই গীতি সংকলনের ভূমিকা লিখতে গিয়ে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, ‘আবু হেনা মোস্তফা কামালের সর্বাধিক সাফল্য প্রেমের গানে, কিন্তু নিসর্গ ও স্বদেশ, গণচেতনা ও উৎসব-বিষয়ের তিনি যে উৎকৃষ্ট গান লিখেছিলেন, তা আমাদের অজানা নয়।’

তার সংগীতপ্রেম শুধু গীত রচনাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, গায়ক হিসেবেও তিনি নিজেকে প্রকাশ করেছিলেন। তিনি সংগীতশিল্পী হিসেবে পরিচিতি ও গীত রচয়িতা হিসেবে বিশেষ খ্যাতি পেয়েছিলেন।

১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ টেলিভিশনের যাত্রা শুরু হয়েছিল ফেরদৌসী রহমানের গাওয়া আবু হেনা মোস্তফা কামালের গান দিয়ে। গানের কথা ছিল, ‘ওই যে আকাশ নীল হলো, সে শুধু তোমার প্রেমে।’ চলচ্চিত্রের জন্যও অনেক গান লিখেছেন।

 

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts