বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বৃহস্পতিবার (অক্টোবর ১২) উদযাপিত হয়েছে বিশ্ব দৃষ্টি দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ছিল ‘আপনার চোখকে ভালবাসুন, কর্মস্থলেও’ (Love Your Eyes at Work) ।
দিবসটি উপলক্ষে এদিন সকাল ৯টায় জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল থেকে একটি সচেতনতামূলক শোভাযাত্রা বের হয় এবং সকাল ১০টায় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সরকারের ন্যাশনাল আই কেয়ার কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর ও জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. গোলাম মোস্তফা।
অধ্যাপক ডা. মোস্তফা বলেন, জনগণের চক্ষু রোগের চিকিৎসা এবং এক্ষেত্রে সেবার দুর্ভোগ কমানোর জন্য ন্যাশনাল আই কেয়ার এ পর্যন্ত উপজেলা হাসপাতালগুলোতে ২০০টি কমিউনিটি আই কেয়ার সেন্টার স্থাপন করে চক্ষু সেবার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এক্ষেত্রে চক্ষু সেবার কাজে নিয়োজিত ১০টি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান জনগণের দোরগোড়ায় চক্ষু সেবাকে পৌঁছে দিচ্ছে।
প্রতিবছর অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় বৃহস্পতিবার বিশ্ব দৃষ্টি দিবস উদযাপন করা হয়। এ দিবসের মূল লক্ষ্য হলো অন্ধত্ব, দৃষ্টি প্রতিবন্ধকতা ও চোখের যত্নের বিষয়ে বিশ্ব জনগোষ্ঠীকে সচেতন করে তোলা।
অধ্যাপক ডা. মোস্তফা বলেন, মানবদেহের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ চোখ। কিন্তু এ বিষয়ে সাধারণ মানুষ উদাসীন। মানুষ কেন অন্ধত্ব বা দৃষ্টি প্রতিবন্ধকতার শিকার হচ্ছে সে সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকলে এবং চোখের যত্নের বিষয়ে নিজের কর্মস্থলে করণীয় সম্পর্কে জানা থাকলে বাংলাদেশে অন্ধত্বের হার অনেক কমতে পারে।
জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের রেটিনা বিভাগের প্রধান এবং বাংলাদেশ চক্ষু চিকিৎসক সমিতির মহাসচিব অধ্যাপক ডা. দীপক কুমার নাগ বলেন, একসময় এ দেশে অন্ধত্বের হার ছিল ১ দশমিক ৪৫ শতাংশ। কিন্তু সর্বশেষ জরিপে দেখা গেছে, এ হার কমে শূন্য দশমিক ৬৯ শতাংশে নেমে এসেছে। অর্থাৎ এখন ১০০ জনে ১ জনেরও কম বা ১ হাজার জনে ৭ জন অন্ধত্বের শিকার। সে হিসেবে বর্তমানে দেশে জনসংখ্যার ১২ লাখ মানুষ অন্ধ। অন্যদিকে, ৩ শতাংশ বা ৫১ লাখ মানুষ ক্ষীণদৃষ্টির শিকার।”
সেমিনারে স্বাগত বক্তব্য দেন জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক অফথালমোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক যখায়ের আহমেদ চৌধুরী। তিনি বলেন, বর্তমানে দৃষ্টিজনিত মূল সমস্যা হলো ছানি, গ্লুকোমা ও রেটিনার সমস্যা। তিনি আরও বলেন, “এছাড়া ডায়াবেটিসজনিত চোখে সমস্যা এখন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।
আইএনজিও ফোরামের চেয়ারম্যান এবং অরবিস ইন্টারন্যাশনালের কান্ট্রি ডিরেক্টর ডা. মুনীর আহমেদ বলেন, বাংলাদেশে দৃষ্টি প্রতিবন্ধকতা দূর করার ক্ষেত্রে সরকারের সাথে এনজিও ও বেসরকারি খাত সমন্বিতভাবে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে।
তিনি বলেন, অন্ধত্ব প্রতিরোধের জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থা-আইএপিবি’র স্ট্র্যাটেজিক ভিশন ‘ইনসাইট ২০৩০’কে সামনে রেখে মানবাধিকারের অংশ হিসেবে চোখের চিকিৎসাকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে হবে। চোখের প্রতি যত্নবান হতে উৎসাহিত করতে হবে, সব ক্ষেত্রে।
ডা. মুনীর বলেন, চক্ষু সেবার কার্যক্রমকে সমন্বিত করতে হবে সারা বাংলাদেশে। শুধু জেলা পর্যায়ে নয়, ছড়িয়ে দিতে হবে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত। পেশাভিত্তিক বিভিন্ন শ্রেণী গোষ্ঠী যেমন, গার্মেন্টস, পরিবহন খাত, চা শ্রমিক সবার কাছে চক্ষু সেবা পৌঁছে দিতে হবে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশে চোখ নিয়ে কাজ করা ১০ টি আন্তর্জাতিক এনজিও নিরলস ভাবে সরকারের সাথে কাজ করছে।
সেমিনারে চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎকরা জানান, বাংলাদেশে দৃষ্টি সমস্যা কোনও কোনো ক্ষেত্রে কমেছে, আবার নতুন সমস্যা আসছে। তারা জানান, দেশে ছানি অপারেশন অনেক বেড়েছে, যার কারণে ছানিজনিত অন্ধত্ব কমছে। গ্লুকোমা ও রেটিনাজনিত সমস্যাও কমছে আবার জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশগত সমস্যার কারণে ড্রাই আই বা চোখের শুষ্কতা বাড়ছে; সেই সঙ্গে বাড়ছে কর্নিয়ার সমস্যা।
সেমিনারে আরও বক্তব্য রাখেন জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের কর্নিয়া বিভাগের অধ্যাপক ও অ্যাকাডেমিক কমিটির চেয়ারম্যান ডা. আব্দুল কাদের, দৃষ্টি উন্নয়ন সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা ও ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক ডা. শাহিন রেজা চৌধুরী, ভিট্রো-রেটিনা বিভাগের অধ্যাপক ডা. শামিমা সুলতানা এবং ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার সহকারী অধ্যাপক ডা. উৎপল কুন্ডু। অনুষ্ঠানে দৃষ্টি দিবস নিয়ে রচিত একটি বিশেষ কবিতা আবৃত্তি করেন এসিলর লাকসোটিকার ট্রেনিং ও পার্টনারশিপ বিভাগের প্রধান রূপণ কান্তি দত্ত। সেমিনারটি সঞ্চালনা করেন হেলেন কেলার ইন্টারন্যাশনালের প্রজেক্ট ম্যানেজার ডা. ফাইজা রাহলা।
বাংলাদেশে অন্ধত্ব ও দৃষ্টি স্বল্পতা বা দৃষ্টি প্রতিবন্ধকতা কমিয়ে আনার জন্য সমন্বিতভাবে কাজ করে যাচ্ছে
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, ন্যাশনাল আই কেয়ার এবং চক্ষু সেবায় নিয়োজিত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা আন্ধেরি হিলফি, ব্র্যাক, সিবিএম গ্লোবাল, ফ্রেড হোলোস ফাউন্ডেশন, হার্ট টু হার্ট ফাউন্ডেশর, হেলেন কেলার ইন্টারন্যাশনাল, অরবিস ইন্টারন্যাশনাল, সাইটসেভারস, ভিশন স্প্রিং, এসিলর লাকসোটিকা ।
দিবসটি উপলক্ষে সরকারের পাশাপাশি এসব সংস্থা জাতীয় ও জেলা পর্যায়ে সচেতনতামূলক কর্মসূচির আয়োজন করে এবং বিশেষ চক্ষু সেবার ব্যবস্থা করে।
অন্ধত্ব প্রতিরোধের জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থা-আইএপিবি এবারের বিশ্ব দৃষ্টি দিবসকে সামনে রেখে বছরব্যাপী এক প্রচারণা শুরু করেছে।
এ বছরের প্রতিপাদ্যের মূল বার্তাটি বিশাল জনগোষ্ঠীকে তাদের নিজ নিজ কর্মস্থলে চোখের প্রতি যত্নশীল হওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন বক্তারা।
জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের চিকিৎসকদের দেওয়া তথ্যমতে, প্রতিদিন তিন হাজারের বেশি রোগী চোখের বিভিন্ন সমস্যায় শুধুমাত্র এ প্রতিষ্ঠান থেকে চিকিৎসা নেয়। তাদের তথ্য বলছে, দেশের এক কোটি ৪৩ লাখ লোক দৃষ্টি ত্রুটিতে ভুগছে এবং দিন দিন চোখের রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছোটবেলা থেকে স্মার্টফোন ও ট্যাবে ভিডিও গেমসের আসক্তি শিশুদের চোখের বিভিন্ন ধরনের সমস্যাসহ নানা ধরনের মানসিক সমস্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে পৃথিবীতে প্রায় ২২০ কোটি মানুষ অন্ধত্ব বা দৃষ্টি প্রতিবন্ধকতায় ভুগছে, যার মধ্যে এক বিলিয়ন মানুষের অন্ধত্ব বা দৃষ্টি প্রতিবন্ধকতা প্রতিরোধ ও প্রতিকার করা সম্ভব।
জনগণের চক্ষুরোগ কমানোর জন্য ন্যাশনাল আই কেয়ার এ পর্যন্ত উপজেলা হাসপাতালগুলোতে ২০০টি কমিউনিটি আই কেয়ার সেন্টার স্থাপন করে চক্ষুসেবার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এছাড়া চক্ষুসেবার কাজে নিয়োজিত দশটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান জনগণের দোরগোড়ায় চক্ষুসেবা পৌঁছে দিচ্ছে।
এসআর/ডি