মো. সাখাওয়াত হোসেন
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও বিএনপির শুভানুধ্যায়ী হিসেবে পরিচিত জাফরুল্লাহ চৌধুরী বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘লন্ডনে বসে “ওহি” পাঠাবেন না। স্কাইপের মাধ্যমে দল পরিচালনা করবেন না।’ তিনি তারেককে লন্ডনে বসে দুই বছর মাস্টার্স বা এমফিলে পড়াশোনা করার পরামর্শ দিয়েছেন। নিজের ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যদের বয়সের কথা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘দুই ঘণ্টা দাঁড়াতে পারে না, এদের দিয়ে হবে না। আমাদের সময় শেষ হয়ে আসছে। আমাদের দিয়ে হবে না। বিএনপিতে অনেক দক্ষ ও চৌকস নেতা আছেন। তাঁদের দায়িত্ব দিতে হবে। তাঁরাই খালেদা জিয়াকে মুক্ত করবেন।’ তিনি আরও বলেন, লন্ডনে বসে এটা হবে না। অর্থাৎ তিনি যে বিষয়গুলোর অবতারণা করেছেন তার মধ্যে দুটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; একটি হচ্ছে বিএনপিতে নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে হবে এবং অন্যটি হচ্ছে লন্ডনে বসে দল পরিচালনা করা যাবে না। বিএনপি কি আদৌ জাফরুল্লাহ চৌধুরীর আহবান বাস্তবে প্রতিফলন করতে সক্ষম হয়েছে। এ প্রশ্নটি বিএনপি সমর্থক ও তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মধ্যে বারবার ঘুরে ফিরে সামনে আসছে।
লন্ডন থেকে তারেকের দল পরিচালনা নিয়ে সমালোচনা করেছেন দলের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মোরশেদ খানও। চট্টগ্রামের উপনির্বাচনে দলের মনোনয়ন চেয়ে পাননি; স্থানীয় পর্যায়ের অনেক নেতাও বিভিন্ন ইস্যুতে তারেক রহমানের সমালোচনা করছেন। বিএনপির অনেক জ্যেষ্ঠ নেতার সঙ্গে তারেকের বিরোধ স্পষ্ট হলেও কেউ পদপদবি হারানোর ভয়ে মুখ খুলছেন না। এ সংক্রান্তে দলের মধ্যে একটি ভয় ও আতংকের সৃষ্টি হয়েছে। বিএনপির সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল, তবে দল এতটাই এলোমেলো যে নেতারা সম্মেলন করার সাহস পাননি। বিগত বছরগুলোতে দেখা গেছে; বিএনপির সহযোগী ছাত্রদল, যুবদলসহ যেসব সংগঠনের কমিটি গঠন করা হয়েছে, তা নিয়ে হাঙ্গামা হয়েছে, কমিটি নিয়ে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে, দলের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে। দলীয় অফিসের সামনে কর্মীরা বিক্ষোভ ও ভাঙচুর করেছেন। নেতাদের অবরুদ্ধ রেখেছেন। জ্যেষ্ঠ নেতাদের অনেকে জানেন না কীভাবে এসব কমিটি হয়, কীভাবে কারা কমিটির নেতৃত্বে আসেন। অথচ দায় এসে পড়ে তাঁদের ওপরই। অর্থাৎ দলের মধ্যে জ্যেষ্ঠ নেতারা অসহায় এবং দল পরিচালনায় তাদের নিজেদের মতামতের তুলনায় স্কাইপি মতামত গুরুত্ব পায়।
গণমাধ্যমের কল্যাণে বর্তমানে কোন কিছুই আর গোপন রাখার সুযোগ নেই। গণমাধ্যম মারফত জানা যায়, গত জাতীয় নির্বাচনে তারেক রহমানের পরস্পরবিরোধী অবস্থান দলকে বেশ বেকায়দায় ফেলেছিল। তাঁর প্রথম কৌশল ছিল আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়া এবং বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলা। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের অধীনেই নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। অন্যদিকে দলের প্রার্থী কারা হবেন, সেটি নিয়েও দেনদরবার চলতে থাকে। বিএনপির স্থায়ী কমিটি যে তালিকাই করুক না কেন, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এসেছে লন্ডন থেকে। নির্বাচনে বিএনপির বিরুদ্ধে যে ব্যাপক মনোনয়ন-বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছিল, তার মূলে ছিল লন্ডনি হস্তক্ষেপ। কাজেই আসন্ন নির্বাচনেও বিএনপির প্রার্থী মনোনয়নের সিদ্ধান্ত লন্ডন বার্তা থেকে আসার সম্ভাবনা জেনেই দলীয় নেতাকর্মীরা আন্দোলন সংগ্রামে স্বত:স্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকছে। রাজনীতিতে ত্যাগকে মূল্য দিতে হয়, গুরুত্ব প্রদান করতে হয়, না হলে ত্যাগী কর্মীরা ঝরে যায় এবং দলকে দীর্ঘমেয়াদী ভিত্তিতে খেসারত দিতে হয়।
নির্বাচনের পরও প্রথমে বিএনপি সংসদে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় ছিল। পরে হঠাৎ লন্ডন থেকে বার্তা আসে, সংসদে যেতে হবে। বিএনপি যদি সংসদেই যাবে, তাহলে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করানো হলো কেন? এ ব্যাপারটিও বিএনপির সাধারণ কর্মীরা ভালভাবে গ্রহণ করেনি। কেননা এক বিষয়ে দু ধরনের সিদ্ধান্ত হঠকারিতার শামিল। তাছাড়া সংসদে মির্জা ফখরুল থাকলে বিএনপির অন্যান্য সাংসদরা অনুপ্রাণিত হতেন, যৌক্তিক বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনার সুযোগ পেতেন। বিএনপিতে এমন কথাও চালু আছে যে স্থায়ী কমিটির ভূমিকা হলো ডাকবাক্সের মতো। লন্ডন থেকে যে নির্দেশ আসে, সেটাতেই তাদের অনুমোদন দিতে হয়। বিদেশ থেকে ‘ওহি’ নিয়ে বিএনপি যে রাজপথের আন্দোলনে সুবিধা করতে পারবে না, সেটি দলের সাধারণ কর্মীরাও জানেন। তবু জাফরুল্লাহ চৌধুরী সাহস করে বলেছেন। তাঁর এই ‘সদুপদেশ’ বিএনপির নেতৃত্ব এখনো আমলে নিতে পারেনি।
তৃণমূলের কর্মীদের মধ্যে একটি ক্ষোভ দীর্ঘদিন ধরে রয়েছে। তারা মনে করেন, রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রেক্ষাপট বিবেচনায় জেল জুলুম ও রাজপথের আন্দোলন নেতৃত্বকে সমৃদ্ধ করে, পরিশীলিত করে, কর্মীদের মধ্যে নেতাকে প্রবল জনপ্রিয় করে তোলে। নেতাদের আহবানে এখনো অনেকেই রাজপথে সরব, তবে বিএনপি তাদের সকল কর্মীকে এখনো রাজপথে নামাতে পারেনি। কর্মীরা মনে করেন, দলীয় যত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় সকল সিদ্ধান্ত আসে লন্ডনের বার্তা থেকে। যেখানে দলের সিনিয়র নেতাদের মতামতকেও অগ্রাহ্য করা হয়। অথচ সিনিয়র নেতারা দলের নেতাকর্মীদের নিয়ে এখনো রাজপথে সরব। এই ধরনের বিষয়গুলো সাধারণত নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে দল নিয়ে অনিহা তৈরি করে এবং অনিহার কারণেই দলীয় আহবানে তৃণমূল সাড়া দিচ্ছে না। এই বিষয়গুলো বিএনপির যারা শুভাকাঙ্খী তারা বিভিন্নভাবে আকারে ইঙ্গিতে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তেমন ফল আসছে না উল্টো তারা রোষানলে পড়ছেন।
সে কারণেই দল নিয়ে বিএনপিতে যারা দীর্ঘদিন ধরে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের মধ্যে এক ধরনের অসাড়তা চলে এসেছে। আবার যারা তরুণ প্রজন্মের কর্মী সমর্থক তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী দলে নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি হচ্ছে না। নতুন নেতৃত্ব তৈরি করা যে কোন দলের জন্য একটি স্বাভাবিক রেওয়াজ, সময়ের পরিবর্তনে পর্যায়ক্রমে দলের কাউন্সিল যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হবে এবং দলে নতুন মুখ তৈরি হবে। নতুন মুখ তৈরি হলে তরুণদের মধ্যে একটি আগ্রহের সৃষ্টি হয়, পরবর্তীতে যারা নেতৃত্বে আসবে তাদের মধ্যেও একটি প্রত্যাশার সম্মিলন তৈরি হয়। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে কাউন্সিল না হওয়ায় পুরনো নেতৃত্বের উপর ভর করে একটি রাজনৈতিক দল প্রকৃতঅর্থে সমসাময়িক বিবেচনাতে চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলা করতে পারে না। এ বিষয়গুলোতে বিএনপি দল হিসেবে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারেনি।
বিএনপিতে বিশেষ করে মনোনয়ন বাণিজ্যের কথা ব্যাপকভাবে আলোচনায় রয়েছে। বিশেষ করে দেখা যায়, বিএনপি ঘোষিত কর্মসূচিতে রাজপথে যাদের কোনরূপ উপস্থিতি নাই কিংবা থাকলেও সেটি তেমন প্রোঅ্যাকটিভ নয় তাদের মনোনয়ন প্রাপ্তি মূলত বিএনপিকে সাংগঠনিকভাবে দাঁড় করাতে পারছে না। আর এর জন্য মূলত লন্ডন থেকে প্রাপ্ত বার্তার কারণে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যরাও সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না। পরিবেশ, পরিস্থিতি, বাস্তবতা, সরকারের অবস্থান ইত্যাদির উপর নির্ভর করেই মূলত বিএনপিকে কর্মসূচি প্রদান করতে হয়। কর্মসূচিতে কি কি বিষয় রাখা যাবে, কি রাখা যাবে না, কোথায় অবস্থান নিলে দলের কর্মী সমর্থকদের জন্য ভাল হয়; এ ব্যাপারগুলোতে বাংলাদেশে অবস্থান গ্রহণ করে যতটা ফলপ্রসূ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায় লন্ডন থেকে বার্তাভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ মাঠের পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে এবং সেটিই হয়ে থাকে। যার কারণে কর্মসূচি প্রদান করে বিএনপি ততটা সফলতা পাচ্ছে না। আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে লন্ডন থেকে প্রদত্ত বার্তার মাধ্যমে দল পরিচালিত হলে কর্মসূচির মাধ্যমে প্রাপ্ত ফলাফল ততটা সুখকর হবে না।
কাজেই ব্নিপির হাইকমান্ডের উচিত লন্ডনী বার্তা থেকে বের হয়ে আসার সংস্কৃতি সৃষ্টি করা। তৃণমূল মনে করে মূলত এ সকল কিছুর কারণে তাদের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলন ত্বরান্বিত হয়নি কিংবা কার্যকর কোন প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। সুতরাং আসন্ন নির্বাচনের ডামাডোলে বিএনপিকে আরও ইতিবাচক ও তৃণমূলের প্রত্যাশাকে বাস্তবে রূপদান করার মানসিকতায় দল পরিচালনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।
লেখক-চেয়ারম্যান, ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।