ভোট যুদ্ধে টাঙ্গাইলের সিদ্দিকী পরিবারের তিন ভাই

টাঙ্গাইলের তিনটি আসনে প্রভাবশালী সিদ্দিকী পরিবারের তিন ভাই এবারও ভোট যুদ্ধে নেমেছেন। তাদের সাথে মূল প্রতিদ্বন্দিতা হবে নৌকার প্রার্থীদের সাথে। ভোটার ও সাধারণ মানুষ কষছেন নানা হিসেব ও সমীকরণ।

টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতী) আসন থেকে ট্রাক প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন আওয়ামী লীগ থেকে বহিস্কৃত ও সাবেক মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী।

টাঙ্গাইল-৮ (বাসাইল-সখিপুর) আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম (গামছা)।

তাদের ছোট ভাই মুরাদ সিদ্দিকী টাঙ্গাইল-৫ (সদর) আসনে মাথাল প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

১৯৯৯ সালে আওয়ামী লীগে ছেড়ে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ গঠন করেন কাদের সিদ্দিকী। ২০১৪ সালে হজ ও তাবলীগ নিয়ে মন্তব্য করে আওয়ামী লীগ থেকে বহিস্কৃত হন লতিফ সিদ্দিকী। হারান মন্ত্রীত্বও। তাদের ভাই মুরাদ সিদ্দিকীও কয়েক বার সংসদ সদস্য পদে নির্বাচন করে উল্লেখযোগ্য ভোট পেয়ে পরাজিত হন।

২০২২ সালের ২৩ ডিসেম্বর কাদের সিদ্দিকী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে স্বপরিবারে গণভবনে গিয়ে সাক্ষাৎ করেন। তারপর থেকেই রাজনৈতিক মহলে গুঞ্জন রয়েছে তিনি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটে যাচ্ছেন। পাল্টে যায় রাজনৈতিক পরিবেশ। লতিফ সিদ্দিকীকে সাথে নিয়ে বিভিন্ন সভা সমাবেশে বঙ্গবন্ধু, প্রধানমন্ত্রীর ও আওয়ামী লীগের পক্ষে বক্তব্য দেন কাদের সিদ্দিকী। ফলে লতিফ সিদ্দিকীকে দলে ফেরাতে পারেন বলে অনেকের ধারণা ছিলো।

কাদের সিদ্দিকী জানান, বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী কালিহাতীতে নির্বাচন করছেন। তার কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ লতিফ সিদ্দিককে সমর্থন দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন সুষ্ঠু নির্বাচন হবে। ভোট ডাকাতি হবে না। তাই আশা করছি লতিফ ভাই অবশ্যই জয়ী হবে। সখিপুর আসন নিয়ে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন অনুপম শাহজাহান জয়। আমি তার বাবা প্রয়াত শওকত মোমেন শাহজাহানের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছি। আশা করি ভোটের মাধ্যমে আমি বিজয়ী হবো।

আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী- মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। তিনি ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য, ১৯৭৩, ১৯৯৬, ২০০৮ ২০১৪ সালে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে মন্ত্রী হন। ২০১৪ সালে
মন্ত্রীত্ব হারান। আওয়ামী লীগ থেকেও বহিষ্কার হন। ২০১৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতী) আসনে ট্রাক প্রতীকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন। পরে নির্বাচন থেকে সরে যান। এবার নির্বাচনে কয়েক মাস আগে থেকে মাঠে নামেন। কালিহাতীতে রয়েছে তার অসংখ্য ব্যক্তিগত কর্মী, ভক্ত-অনুসারি।

এ আসনে তার মূল প্রতিদ্বন্দী নৌকার প্রার্থী ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মোজহারুল ইসলাম তালুকদার ঠান্ডু এবং স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠক সাবেক মন্ত্রী শাজাহান সিরাজের মেয়ে ব্যারিস্টার সারওয়াত সিরাজ শুক্লা (ঈগল)। মোজহারুল ইসলাম তালুকদার লতিফ সিদ্দিকীর দীর্ঘ দিনের রাজনৈতিক সহযোদ্ধা ছিলেন এবং শুক্লা সিরাজের বাবা শাজাহান সিরাজ ছিলেন বন্ধু।

লতিফ সিদ্দিকী বলেন, আমি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের একজন সৈনিক ও আওয়ামী লীগার। মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। বিএনপি ঘোষণা দিয়েছে, তারা শেখ হাসিনা সরকারকে উৎখাত করবে। আমি মনে করি এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা আমার দায়িত্ব। সেই দায়িত্ববোধ থেকেই আমি নির্বাচনে এসেছি।

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম মুক্তিযুদ্ধের কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান ও কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। তিনি টাঙ্গাইল-৮ আসন থেকে দলীয় প্রতীক গামছা নিয়ে নির্বাচন করছেন। ১৯৯৬ সালে কাদের সিদ্দিকী আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে এ আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৯৯ সালে দল থেকে বেরিয়ে উপ-নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী প্রয়াত শওকত মোমেন শাহজাহানের কাছে পরাজিত হন। ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে এ আসনে কাদের সিদ্দিকী জয়ী হন। ২০০১ সালের নির্বাচনে কালিহাতী আসন থেকেও কাদের সিদ্দিকী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন তার বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী। বিএনপির প্রার্থী ছিলেন শাজাহান সিরাজ। তিনি নির্বাচিত হয়ে জোট সরকারের মন্ত্রিত্ব পান। গত তিনটি নির্বাচনে ঋণ খেলাপির কারণে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর মনোনয়ন বাতিল হয়। ২০১৮ সালে এ আসন থেকে তার মেয়ে কুঁড়ি সিদ্দিকী জোটের হয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়ে হেরে যান।

মুরাদ সিদ্দিকী বড়ভাই বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের মনোনীত প্রার্থী হয়ে ২০০১ ও ২০০৮ সালে টাঙ্গাইল-৫ (সদর) আসনে সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে উল্লেখযোগ্য ভোট পেয়ে হারেন। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর সাথে স্বতন্ত্র নির্বাচন করে সামান্য ভোটে পরাজিত হন। ২০১৪ সাল থেকেই তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যোগদানের চেষ্টা করছেন। সখ্যতা বাড়িয়েছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও জেলার নেতাকর্মীদের সাথে। ২০২২ সালে মুরাদ সিদ্দিকী প্রায় ১০ হাজার কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে যোগদান করেন। মুরাদ সিদ্দিকী আওয়ামী লীগে পদ পাচ্ছেন এ নিয়ে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে নেতাকর্মীরা ছিলেন উৎসাহ উদ্দীপনায়। কিন্তু জেলা আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে মুরাদ সিদ্দিকী স্থান পাননি। তবে আওয়ামী লীগের জেলা কমিটিতে ১ টি সদস্য ফাঁকা আছে। অনেকের ধারণা এই পদে তাকে নেওয়া হতে পারে। দলীয় হাইকমান্ডের ইচ্ছায় আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম ক্রয় ও জমা দেন মুরাদ সিদ্দিকী। পরে মনোনয়ন বঞ্চিত হন।

টাঙ্গাইল সদর আসনে মুরাদ সিদ্দিকীর রয়েছে একটি নিজস্ব ভোট ব্যাংক। এবার নির্বাচনকে ঘিরে সভা-সমাবেশ, উঠান বৈঠক ও জনসভা করছেন।

মুরাদ সিদ্দিকী বলেন, আমি আওয়ামী পরিবারের সন্তান, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী পরিবারের সন্তান। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর আদর্শে জননেত্রী শেখ হাসিনার একজন কর্মী। দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের সাথে আছি। আমি আওয়ামী লীগের বাইরের কেউ নই। দল থেকে মনোনয়ন চেয়েছিলাম, পাইনি। তবে দলীয় হাইকমান্ডের নির্দেশে সদর আসনে নির্বাচন করছি।

মুরাদ সিদ্দিকী আরো বলেন, জনগণ আমাকে ভালবাসে, আমার পাশে আছে। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে ভোটের মাধ্যমে আমি নির্বাচিত হবো।

টাঙ্গাইল সদর আসনে মুরাদ সিদ্দিকীর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে নৌকার প্রার্থী অ্যাডভোকেট মামুন অর রশিদ ও ঈগল প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী বর্তমান এমপি ছানোয়ার হোসেনের।

 

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts