ক্ষত বিক্ষত জীবনের কথামালা
শিউল মনজুর []
আমাদের উপন্যাস সাহিত্যের সুপরিচিত নাম সালাম সালেহ উদদীন। ছোট গল্প রচনার ক্ষেত্রেও তাই। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে যে কজন উপন্যাসিক ও ছোট গল্পকার সক্রিয় লিখে চলেছেন, তাদের মধ্যে সালাম সালেহ উদদীন একজন।
তিনি শধু সুপরিচিতই নন একজন শক্তিশালী লেখকও বটে। ইতিমধ্যে তাঁর গল্প উপন্যাস ও সম্পাদনা মিলে প্রায় ৩০ টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এবং কয়েকটি উপন্যাস ও ছোটগল্পের বই সুধি পাঠক মহলের প্রশংসাও অর্জন করেছে। প্রতি বৎসরই ২/৩টি বই তাঁর প্রকাশিত হয়ে আসছে।
গত জুন ২০১২ খ্রীস্টাব্দে সালাউদ্দিন বইঘর থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর একটি চমৎকার উপন্যাস মাটিরঙের জীবন। মৃত্তিকা নামের একটি মেয়েকে কেন্দ্র করে মাটিরঙের জীবন নামের এই উপন্যাসটির কাহিনি আবর্তিত হয়েছে। লেখক তার সাবলীল ও মনোমুগ্ধকর ভাষায় মৃত্তিকার শৈশব, কৈশোর, যৌবনের ও তার সংসার এবং পেশাগত জীবনের নানা ঘটনার চিত্র আমাদের সম্মুখে উপস্থাপন করেছেন।
মৃত্তিকার এই সুখ দুঃখের জীবন কাহিনির মধ্য দিয়েই লেখক কিন্তু আমাদের বাস্তব জীবনের রূঢ় চিত্র তুলে ধরেছেন। সেই সাথে একজন মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, প্রেম ভালোবাসা এবং তার চাওয়া পাওয়ার বিষয়টি এই উপন্যাসে প্রস্ফুটিত হয়েছে। এখানে উপন্যাসের কেন্দ্রিয় চরিত্র মৃত্তিকার স্কুল বা কৈশোরিক জীবনের একটি ঘটনা এখানে পাঠকের জন্য উপস্থাপন করা হলো;
হাবীবের একতরফা প্রেমের ঘটনা বেশিদিন চাপা থাকে না। সে যে জয় মোহাম্মদের একমাত্র মেয়ে মৃত্তিকার দিওয়ানা একথা জনে জনে পথে প্রান্তরে বাজার ঘাটে স্কুলে স্কুলে প্রচার হতে থাকে। এও প্রচার হতে থাকে যে হাবীব সারারাত জেগে প্রতিদিন মৃত্তিকার জন্য একটি করে চিঠি লিখে। কখনো কখনো প্রতিদিন দুটোও লিখে। অতঃপর এই চিঠি নিয়ে সে পদ্মপুকুর গ্রামের মোড়ে মৃত্তিকার জন্য দাঁড়িয়ে থাকে। কখনো কখনো ঝিকরগাছা স্কুলের সামনেও তাকে দেখা যায়। (পৃষ্টা-৩২)
মাটিরঙের উপন্যাসের কাহিনি চিত্রগুলি এভাবেই উপন্যাসিক বর্ণনা করেছেন। মৃত্তিকাকে কেন্দ্র করে উপন্যাসের অবয়ব গড়ে উঠলেও তার পার্শ্বচরিত্রগুলি মধ্যদিয়ে আমাদের তবিত সমাজের নানা সমস্যা উঠে এসেছে। মৃত্তিকার স্কুল বান্ধবী শেফালির জীবনের একটি ঘটনা, এখানে পাঠকের জন্যে উপস্থাপন করা হলো;
এস এস সি পরীা দেয়ার প্রস্তুতি পর্বে একদিন শেফালী এসে বলে তার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। একথা শুনে মৃত্তিকার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। ও বললো-
– সামনে পরীা এ সময় কেউ বিয়ে করে?
– আমার মনে হয় পরীা দেয়া হবে না। পরিবারের সবাই বলত মেয়েদের উচ্চ শিত করে লাভ নেই।
– তোর কী মত?
– আমি তো পড়ালেখা চালিয়ে যেতে চাই।
– ঠিক আছে। আমি তোর বাপ-ভাইদের সঙ্গে কথা বলবো। (পৃষ্টা-৩৩)
মৃত্তিকা ও শেফালীর মধ্যে উপরোক্ত সংলাপের মধ্যদিয়ে লেখক অল্প বয়সী মেয়েদের বিয়ে ও মেয়েদের লেখাপড়ার প্রতি আমাদের সামাজিক অবহেলার দিকটি সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। যা আমাদের ত বিত সমাজের দগদগে গা যা শুকিয়ে যাবার মতো নয়। উপন্যাসের নায়িকা মৃত্তিকা, শেফালীর বাবা ও ভাইদের সাথে কথা বলেও শেফালীর বিয়ে ফেরাতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত শেফালীর বিয়ে হয়ে যায়।
অন্যদিকে মৃত্তিকা উচ্চশিার স্বপ্ন নিয়ে গ্রাম ছেড়ে রাজধানী শহর ঢাকার ইডেন কলেজে ভর্তি হয়ে এখানে আরও নতুন নতুন সামাজিক সমস্যার সম্মুখীন হয়। সে গ্রামের ও শহুরে সামাজিক পরিবেশের তারতম্য অনুভব করতে পারে। উপন্যাসের একটি বর্ণনাচিত্র পাঠকদের জন্যে এখানে উপস্থাপন করা হলো;
মামাতো ভাই ইফতেখারই মৃত্তিকাকে ইডেনে ভর্তির ব্যাপারে হযোগিতা করে। প্রথম প্রথম পরিবারের কেউ কেউ তাকে কলেজ গেটে নামিয়ে দিয়ে যেত। এখন সে নিজেই যাতায়াত করতে পারে। তা ছাড়া উডেন কলেজ থেকে সরাসরি রিকসা যায় কলাবাগান। ফলে মৃত্তিকার যাতায়াতে তেমন অসুবিধা হয় না। বরং রিকসা ভ্রমণ তার ভালই লাগে। কিন্তু নিউ মার্কেট বা ঢাকা কলেজের সামনে এলে ঘটে নানা বিপত্তি। দন্ডায়মান তরুণরা এমনভাবে মৃত্তিকার দিকে তাকায় যেন জীবনেও মেয়ে দেখেনি। এক শ্রেণীর তরুণকে সে ইডেনের গেটে অথবা গেটের বিপরীত দিকেও জটলা করতে দেখে। এসব তরুণের প্রধান উদ্দেশ্য সুন্দরী মেয়ে দেখা এবং সুযোগ পেলে প্রেম নিবেদন করা।
পদ্মপুকুর কিংবা ঝিকরগাছার তরুণরা এমন না। তারা রাস্তার মোড়ে বাজারের সামনে কিংবা ব্রিজে রেল স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকে কিন্তু মেয়েদের দিকে এমন লোলুপ দৃষ্টিতে তাকায় না। কিছু কিছু তরুণের তাকানোর ভঙ্গি এমন যে, মনে হয় তারা ওকে গিলে খাচ্ছে। কলেজে যাতায়াত করতে গিয়ে কিংবা নিউমার্কেট গাউছিয়ায় কেনাকাটা করতে গেলে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় মৃত্তিকাকে। (পৃষ্টা-৪৪)
এখানে শহর ও গ্রামের মানুষের মধ্যে যে, সামাজিক মূল্যবোধ এর পার্থক্য রয়েছে, তাও উপন্যাসে চিত্রিত হয়েছে।
পরিশেষে একথা বলা যায় যে, আমাদের সমাজে নারীরা যে নানাভাবে নির্যাতিত হয় মাটিরঙের জীবন উপন্যাসটি তারই একটি বাস্তব কাহিনী সমৃদ্ধ ক্যানভাস। এখানে একজন শহুরে বাস্তবতায় নারীর বদলে যাবার কাহিনী প্রস্ফুটিত হয়েছে। সেই সাথে তার সংগ্রাম মুখর জীবনের কাহিনীও লেখকের কথনে উঠে এসেছে অথবা বলা যায় উপন্যাসের চরিত্রগুলোর মধ্যদিয়ে উদ্ভাসিত হয়েছে আমাদের চারপাশের পরিবেশ। যে পরিবেশে আমরা বসবাস করি এবং প্রত্য ও পরোভাবে এই পরিবেশের বিষাক্ত গ্যাস আমরা গ্রহণ করে চলেছি। যার ঝাঝ থেকে আমরা কেউ মুক্ত নই। অন্যদিকে বলা যায়, উপন্যাসের সাবলীল বয়ান ও পরিমিত শব্দ গাঁথুনি মাটিরঙের উপন্যাস সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করবে নিঃসন্দেহে।
শিউল মনজুর কবি ও কথাসাহিত্যিক