নীলাম্বরী নীলগিরি

 

শিউল মনজুর

 

এক. শঙ্খ নদী ও দূরপাহাড়ের লাবণ্য

 

চাঁন্দের গাড়ির ড্রাইভার আবুল কালাম হঠাৎ করে রাস্তার পাশে গাড়ি ব্রেক করলেন। ছোট ছেলে সুবর্ণকে নিয়ে আমি তারপাশেই বসা ছিলাম। জিজ্ঞেস করলাম, চিম্বুক কি চলে এসেছি?

না স্যার। আরো কিছুদূর গেলে চিম্বুক। এটা মিলনছড়ি।

তাহলে এখানে যে থামালেন?

এখানে পুলিশের চেক পোস্ট।

ইতোমধ্যে গাড়ির পেছন থেকে হইচই করে নেমে পড়েছে সবাই। এলিন ডাকছে, মামা বসে আছেন কেন? দারুণ জায়গা। একটা নদী দেখা যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি নামেন।

এলিনের কথায় আমি সাড়া দিই।

সুবর্ণকে নিয়ে নেমে পড়ি। অবশ্য গাড়ির মধ্য থেকেই বুঝতে পারছিলাম আমরা সমতল থেকে কয়েক হাজার মিটার উপরে। চেক পোস্টের চারদিকে তাকিয়ে দেখি সবুজ অরণ্য। আর এই অরণ্যের মাঝখানে আমরা। এলিনের দেখিয়ে দেওয়া নদীর দিকে তাকিয়ে অবাক হলাম, দূরে কয়েকটি পাহাড়ের মধ্যদিয়ে অনেক নিচে প্রবাহিত হচ্ছে নদীর মতো একটা কিছু। পুলিশ চেক পোস্টের দিকে এগিয়ে যাই। সুবর্ণ আমার সাথে আছে। তার বয়স ছয়। বেড়াতে গেলে তাকে কেয়ার করার দায়িত্ব আমার উপরই পড়ে। বড় ছেলে সৌহার্দের বয়স তের। সে তার মায়ের কেয়ারেই থাকে। চেক পোস্টের রেজিস্টার খাতায় প্রয়োজনীয় তথ্য লিপিবদ্ধ করণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করছেন, আমাদের ১৩ সদস্যের পুরোটিমের লিডার সুবর্নের খালু বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের উপ-পরিচালক মুখলেছুর রহমান খান রিপন। আমি এক ফাঁকে চেক পোস্টের তরুণ পুলিশ কনস্টেবল সাত্তারকে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই এটা কোন নদী?

image002+
নীলগিরি

সাঙ্গু নদী।

দেখে মনে হচ্ছে ছোটো নদী।

অনেক উপর থেকে দেখছেন তো, তাই ছোটো মনে হচ্ছে।

সাত্তার আরো জানালো এ নদী বান্দরবান জেলার সবচেয়ে বড় নদী। এ নদীকে স্থানীয়রা বলে শঙ্খনদী।

সৌহার্দ আমার পাশেই দাঁড়ানো ছিল। সে বললো, বাবা শঙ্খ নদীটি মিয়ানমার সীমান্তে থানচি উপজেলার একটি পাহাড়ে উৎপত্তি হয়েছে। এই নদীর দৈর্ঘ্য ১৭০ কিলোমিটার। চট্রগ্রামের উপর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে।

তুমি কি করে জানলে?

বইতে পড়েছি।

ড্রাইভার তাড়া দেয়, গাড়িতে ওঠার জন্য।

সবাই সেলফি করছে।

আমি শঙ্খ নদীসহ পাহাড়ের কয়েকটি ছবি ক্যামেরাবন্দী করি।

ড্রাইভার বলে, স্যার চিম্বুক সামনে। ওখানে ছবি তুলবেন।

আমরা গাড়িতে উঠে বসি। শেষবার মিলনছড়ির চারদিকে তাকিয়ে দেখি, লাবণ্যের সবুজ দ্যুতি খেলা করছে দূরের পাহাড়গুলিতে। এ সুন্দর যেনো বর্ণনাতীত।

image003+
নীলগিরি হ্যালিপ্যাড

 

 

দুই. পাহাড়িদের জীবনচিত্র ও আধুনিক চাষাবাদ

 

ড্রাইভার আবুল কালাম গাড়ি ছেড়ে দিলেন। পাহাড়ের উপর অরণ্যের ভেতর আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে চাঁন্দের গাড়ি এগিয়ে যেতে থাকে। দূরে তাকালে বুঝা যায়, আমরা কয়েক হাজার মিটার উপর দিয়ে যাচ্ছি। একটু এদিক সেদিক হলে উপায় নেই, অনেক নিচে গভীর অরণ্যে পতিত হতে হবে। যেখান থেকে উঠে আসা বা বেঁচে থাকা অত্যন্ত কঠিন। এরই মধ্যে মাঝে মধ্যে চোখে পড়ে আধিবাসীদের ঘরবাড়ি। তাদের বাড়িগুলি অনেকটা মাচার মতো। মাটি থেকে কয়েক ফুট উপরে। মনে হয় বৃষ্টির পানি যাতে গড়িয়ে চলে যায় এবং বন্য পশুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যায় তার জন্যই তাদের বাড়িগুলি এমন করে নির্মিত। অনেক আধিবাসী তরুণী ও মহিলাকে লম্বা দা নিয়ে ঘুরাফেরা করতে দেখা গেল। দা দিয়ে পাহাড়ে তারা নানা রকম কাজ করে। জ্বালানির লাকড়ি, পশু শিকার, ফলমুল সংগ্রহ এবং প্রয়োজনে আত্মরক্ষার জন্য এ দা ব্যবহার করে। আবার অনেক আধিবাসী তরুণী ও মহিলাদেরকে গরু চরাতে দেখা গেল। সেই সাথে বেশ কিছু মহিলারা শিশু সন্তানকে বিশেষ কায়দায় কাপড়ে বেঁধে কাঁধে ঝুলিয়ে কাজ করতে দেখা গেল। এ সব দৃশ্য পাহাড়ি জীবন যাত্রার চিত্র। জুম চাষের বিষয়টি সম্পর্কে আমরা কিছু জানি। পাহাড়ের ঢালু জায়গায় জুম চাষের বাগানও দেখা গেল। কিন্তু বান্দরবানের পাহাড়ে ফাঁকে ফাঁকে কাঠাল, আনারস, পেপে, কলা, আখ, আম, জাম, পেয়ারা ইত্যাদি ফলের ব্যাপক চাষ দেখে অবাকই হলাম। তবে পাহাড়ি জনগণকে আধুনিক চাষাবাদে উৎসাহিত করা হচ্ছে ভেবে ভীষণ ভালো লাগলো।

 

image004+
নীলগিরি চূড়া থেকে এমন নান্দনিক দৃশ্য দেখা যায় সহজেই

 

তিন. চিম্বুকের চূড়ায় সবুজ পৃথিবী ও একজন ডলি মারমার সাথে বন্ধুত্ব

 

পেছন থেকে হইচই শোনা গেল। একটু আগে পাশ কেটে এসেছি একটি আধিবাসী পাড়া। হয়তো কোন ব্যতিক্রম তাদের চোখে পড়েছে। আধিবাসী তরুণী কিংবা মহিলারা শুধু চাষবাস করে না, তারা দোকানে বসে নিজস্ব উৎপাদিত জিনিসপত্র বিক্রয় এর পাশাপাশি দেশ বিদেশের নানা পণ্য বিক্রয়ও করে থাকে। বান্দরবান শহরে আমরা এমন দৃশ্য দেখেছি। মূলত আধিবাসী পুরুষরা তেমন কোন কাজ করে না। আধিবাসীদের সমাজ ব্যবস্থা মুসলিম ও হিন্দু ধর্ম থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। পেছন থেকে আবারো হইচই শোনাগেল। যাত্রার শুরু থেকেই আমি ও সুবর্ণ চান্দের গাড়ির সামনে। বাকীরা পেছনে। ওরা শুরু থেকে মজা করে আসছে। আসলে চাঁন্দের গাড়িতে ভ্রমণ আমাদের নতুন অভিজ্ঞতা। রাস্তার বা পাশে অসংখ্য দোকান চোখে পড়ল। ড্রাইভার আবুল কালাম গাড়ি পার্কিং করতে করতে বললো, আমরা চিম্বুক এসে পড়েছি। ডানপাশের পাহাড়টাই চিম্বুক পাহাড়।

গাড়ি থেকে নিচে নামতেই দেখি সবাই পানি পান করছে। বোঝা গেল সবাই তৃষ্ণার্ত। ক্যালেন্ডারের পাতায় অক্টোবর মাস প্রবেশ করেছে। কিন্তু গরম এখনো কমেনি। একটা দোকান থেকে আমিও টাকা দিয়ে পানি সংগ্রহ করি। সুবর্ণ তৃপ্তি সহকারে পানি পান করলো। সবার চোখে মুখে নতুন জায়গা দেখার আনন্দ। সবচেয়ে বেশি আনন্দ করছে এলিন, সৌহার্দ, অনন্য, সুবর্ণ ও তামজিদ। অবশ্য সুবর্ণ ও তামজিদের আনন্দটা অন্যরকম। প্রকৃতি দেখার আনন্দের চাইতে নতুন কিছু খেলনা কিনতে পারলেই তারা যেনো বেশি খুশি। যেখানে যাচ্ছে নতুন কিছু কেনার বায়না আছেই। তবে এই মুহূর্তে আমাদের আনন্দ হইচই এর মধ্যেও একজনের মনখারাপ। তিনি সুবর্ণের খালামনি তিথি (অধ্যাপিকা খোদেজা বেগম মেরি)। মন খারাপের বিষয়, ছোটো ছেলে তাহলিলের জ¦র। অষুধ খাচ্ছে না। মুখে দেয়ার সাথে সাথে বমি করে দিচ্ছে। আমি সান্তনা দিয়ে বললাম, মন খারাপ কর না। ওষুধটা আবার খাওয়ানোর চেষ্টা কর। ইনশাল্লাহ কমে যাবে। এদিকে পানি পর্ব শেষ করে, এলিনের আম্মু ও সুবর্ণের আম্মু একটি আধিবাসী দোকানে প্রবেশ করেছে। আমি তাদের দিকে এগিয়ে যাই। রাস্তারপাশে গড়ে ওঠা এ ছোট দোকানে দেখলাম, নানা রঙের নানা রকম চাঁদর, গামছা, লুঙ্গি, ক্যাপ এবং নানা রকম প্রসাধনীসহ শিশুদের বিভিন্ন খেলনা। এরই মধ্যে গামছা ও চাঁদর কেনার জন্যে আধিবাসী মহিলার সাথে দরকষাকষি চলছে। আমি এগিয়ে যাই, জিজ্ঞেস করি, আপা আপনার কি নাম?

ডলি।

ডলি চাকমা?

না, আমি চাকমা না, আমি মারমা।

ডলি মারমা।

জি¦।

আপনি তো সুন্দর করে বাংলায় কথা বলেন।

আমার বোন আরও সুন্দর করে কথা বলে।

দেখলাম দোকানের অন্যপাশে একজন তরুণী দাঁড়িয়ে আছে। তার দিকে এগিয়ে যাই। জিজ্ঞেস করি, কি নাম?

কলি।

বাহ্ চমৎকার নাম। ডলি, কলি।

 

image007+
চিম্বুকের নিচে ডলি মারমার সাথে

ডলি মারমা এবং কলি মারমার সাথে কথা বললাম তাদের ব্যবসা বাণিজ্য ও সংসার নিয়ে। তারা জানালেন বন্ধের সময় ভাল বিকি হয়। পর্যটকরা আসে বেশি। লাভ মোটামুটি হয়। কলির বিয়ে হয় নি। সে এইচ এস সি পাশ করেছে। তার স্বপ্ন বিশ^বিদ্যালয়ে পড়বে। ডলি বিয়ে করেছে। স্বামী ও এক ছেলে নিয়ে সংসার। ডলি বেগম তার স্বামীর সাথেও পরিচয় করিয়ে দিলেন। তার স্বামী তার ব্যবসায়ে সাহায্য করে। ছোটো ছেলে এখনও স্কুলে ভর্তি হয় নি। মারমা আধিবাসীদের প্রধান পেশা জুম চাষ। অন্যান্য আধিবাসীরাও জুম চাষ করে।

সুবর্ণের মা শাহিদা আক্তার শানু আমাকে তাড়া দেয়। এরই মধ্যে চাঁদর ও গামছা কেনা হয়ে গেছে অনেকগুলো। ডলি মারমার সাথে এলিনের মা ও সুবর্ণের মা কয়েকটি ছবি তুলে। তারপর সবাই চিম্বুক পাহাড়ের দিকে এগিয়ে যাই।

চিম্বুক পাহাড়ের চূড়ায় উঠার জন্য নিচ থেকেই শুরু হয়ে গেছে পিচডালা রাস্তা। উঠতে উঠতে চোখে পড়ল পুলিশ ক্যাম্পের সাইনবোর্ড এবং মনে হল এখানে নিরাপত্তা আছে। আরও কয়েকটি সাইনবোর্ড চোখে পড়ল। চিম্বুক বন্য প্রাণীদের অভয়ারণ্য। মনটা ভরে গেল। উপরে উঠার সময় এলিন বেশ কয়েকটি সেলফি তুলল। পাহাড়ের চূড়ায় উঠে মনটা আনন্দে নেচে উঠল। এ যেন, অন্যরকম সুন্দর আর সুন্দর। সবুজের মধ্যে যেন আমরা দাঁড়িয়ে আছি। সেই সাথে রোদ মেঘের খেলা প্রকৃতিকে করে তুলেছে বিচিত্র সুন্দরের অধিকারী। এলিন, এলিনের বাবা, সৌহার্দ আর তাহলিলের চাচা বেশ কিছু ছবি তুলল। চিম্বুকের চূড়ায় দাঁড়িয়ে মনে হল, গোটা বান্দরবান আমাদের চোখের সামনে সবুজ লাবণ্য নিয়ে দন্ডায়মান। তবে চিম্বুক চূড়ায়, বিদ্যুতের নানা সরঞ্জাম, ইট সিমেন্ট বালুর স্তুপ দুঃখজনক।

 

image005+
নীলগিরি গাছের নিচে রৌদ্র ছায়ায় আরাম করে বসে আড্ডা দেয়া যায়

 

চার : ওয়াই জংশন ও বান্দরবানে চান্দের গাড়ি

আনন্দের সাথে চিম্বুক দর্শন শেষ করে আমরা ফিরে আসি পার্কিং প্লেসে। ধীরে ধীরে সবাই যার যার আসনে বসে পড়ি। যথারীতি আমি ও সুবর্ণ সামনের সিটে। ড্রাইভার আবুল কালাম গাড়ি ছেড়ে দেন। আমি জিজ্ঞেস করি, এখান থেকে নীলগিরি কতদূর?

১৮ কিলোমিটার।

কত সময় লাগতে পারে?

ঘন্টা খানেক লাগতে পারে।

বান্দরবান থেকে নীলগিরির দূরত্ব ৪৬ কিলোমিটার। তাহলে, বান্দরবান থেকে চিম্বুক এর দূরত্ব ২৮ কিলোমিটার। অর্থ্যাৎ ২৮ কিলোমিটার দূরত্ব পার হয়ে এখন আমরা নীলগিরির পথে। চারপাশের নানা দৃশ্য দেখতে দেখতে আমাদের গাড়ি একটা জায়গায় এসে থামে। জায়গাটা তিনমুখী রাস্তার মিলন স্থল। ড্রাইভার বললেন, আপনারা একজন নেমে আসেন। এখানে আর্মি চেকপোস্ট আছে। সুবর্ণকে রেখে আমি নেমে পড়ি। পেছন থেকে মুখলেছুর রহমান খান রিপন সাহেবও নেমে এলেন। দেখা গেল এক জায়গায় বড় করে লেখা ণ জংশন। এখানে তিনটি রাস্তা তিনদিকে গেছে। অনেকটা ণ এর ডালের মতো। এ কারণেই বোধ করি জায়গাটার নাম রাখা হয়েছে ণ জংশন। ণ জংশন থেকে একটি রাস্তা রোমার দিকে চলে গেছে অন্যটি থানচির দিকে। ড্রাইভার ও মুখলেছুর রহমান খান রিপন সাহেব চেকপোস্টের কাজ শেষ করে আবার ফিরে আসেন। কয়েকটি রেস্টুরেন্ট ও রিসোর্টের সাইনবোর্ড চোখে পড়ল। মনে হচ্ছে এখানে থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। উঠে পড়ি গাড়িতে।  আমাদের গাড়ি আবার চলতে শুরু করে নীলগিরির দিকে। মনের ভেতর নীলগিরি দেখার আনন্দ উথাল-পাতাল করছে। শুনেছি এবং বিভিন্ন পত্রিকায় পড়েছি বান্দরবানের সবচাইতে সুন্দর জায়গাটার নাম নীলগিরি। এখানে নাকী মেঘের সাথে মিতালি করা যায়।

আমি ড্রাইভার আবুল কালামের দিকে তাকালাম। কালাম খুব মনোযোগ দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছেন। আসলে কালাম দক্ষ ড্রাইভার। তিনি এর মধ্যে প্রমাণ করেছেন। এমন উচু নিচু আঁকাবাঁকা রাস্তা চালাতে হলে আবুল কালামের মতো দক্ষ ড্রাইভার ছাড়া সম্ভব নয়। আবুল কালামের সতর্ক দৃষ্টি আঁকাবাঁকা রাস্তার সামনের দিকে।

জিজ্ঞেস করলাম, আবুল কালাম আপনার বাড়ি কোথায়?

কুমিল্লাতে।

এখানে কী পরিবার নিয়ে থাকেন?

জি। এখানে পরিবার নিয়েই থাকি।

গাড়ি চালাচ্ছেন কবে থেকে?

১৫/১৬ বছর ধরে এ গাড়ি চালাচ্ছি।

এই রাস্তাতেই?

জি।

তাহলে তো এই রাস্তার এবং বান্দরবান এলাকার সবকিছু আপনার জানাশোনা। আচ্ছা, আবুল কালাম আপনি যে গাড়ি চালাচ্ছেন, এটিই কি চান্দের গাড়ি?

না স্যার, সেনাবাহিনীদের পুরনো গাড়িগুলি ছিল চান্দের গাড়ি। চান্দের গাড়িতে সামনে পেছনে উপরে বসে এক সময় দূর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে মানুষ যাতায়াত করতো। ঐ গাড়িগুলিই চান্দের গাড়ি। এখন ঐ গাড়িগুলি পাওয়া যায় না। বর্তমানে বুলেরো ম্যাক্সিট্রাক গাড়িগুলিকেই চান্দের গাড়ি বলে।

তাই। এ সব গাড়ির দাম কত?

এ সব গাড়ির দাম ১১ থেকে ১২ লাখ টাকায় পাওয়া যায়।

বান্দরবান আসার পর থেকেই সব জায়গা চান্দের গাড়ি দেখছি। এই রাস্তায়ও চান্দের গাড়িই বেশি দেখছি। কারণ কী?

বান্দরবানের উচানিচা রাস্তার জন্যে চান্দের গাড়িই উত্তম। এ গাড়িগুলির শক্তি অন্যান্য গাড়িগুলি থেকে একটু বেশি। সহজেই উচু জায়গা দিয়ে উঠতে পারে। বান্দরবানে প্রায় ৩০০ চান্দের গাড়ি আছে। পর্যটকরা বান্দরবানে এসে চান্দের গাড়িতেই ঘুরে বেড়ায়।

আমি আর কোন প্রশ্ন করি না।

সামনের একটা বাঁক পেরিয়েই বর্ডারগার্ডের বিশাল ট্রাক সামনে পড়ে। আবুল কালাম সাথে সাথে ব্রেক করেন। সামনের ট্রাকটিও। সাথে সাথে আবুল কালাম খুব দক্ষতার সাথে গাড়িকে একটু পেছন নিয়ে জায়গা করে দেন। ট্রাকটি পাশ কেটে চলে যায়। আমরা অল্পের জন্য দূর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাই। আল্লাহর কাছে শোকরিয়া আদায় করি। গাড়ি আবার চলতে শুরু করেছে। আবুল কালামকে সতর্কতার সাথে গাড়ি চালানোর জন্যে ধন্যবাদ দিই।

image006+
বান্দরবানের দর্শনীয় স্থানসমুহ দেখার জন্যে চান্দের গাড়িই উত্তম

 

পাঁচ. নীলাম্বরী নীলগিরি এবং রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দের কবিতা

নীলগিরির কাছাকাছি হতেই গাড়ির পেছন থেকে সমস্বরে শব্দ বেজে উঠে। ঐ যে নীলগিরি। আমার ভিতরে রোমাঞ্চ প্রবাহিত হয়। চাঁন্দের গাড়ি পার্কিং প্লেসে প্রবেশ করার সাথে সাথে আমি ও সুবর্ণ নেমে পড়ি। আমি একবার ঘড়ির দিকে তাকাই। বেলা সাড়ে বারটা বাজে। নীলগিরির প্রবেশ পথের সাইনবোর্ড, ব্যানার চোখে পড়ে। এরই মধ্যে রিপন সাহেব নীলগিরি প্রবেশের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করার জন্য কাউন্টারে বসা লোকের সাথে কথা বলছেন। আমাদের টিমের সদস্যরা ইতোমধ্যে আশপাশে ছড়িয়ে পড়েছেন। কেউ কেউ গাছের নিচে ছায়ায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন আবার কেউ কেউ সেলফি তুলতে ব্যস্ত।

 

পার্কিং প্লেসের দিকে আমার নজর যায়। দেখি, এখানে যত পর্যটকরা এসেছেন প্রত্যেকেই চাঁন্দের গাড়ি নিয়েই এসেছেন। কোন প্রাইভেট গাড়ি চোখে পড়লো না। রিপন সাহেব সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে ইশারায় জানালেন, আমরা এবার নীলগিরির ভিতরে প্রবেশ করতে পারি। গেট দিয়ে পিচডালা বাঁকানো পথ বেয়ে উপরে উঠতে থাকি। মনে হলো কয়েকটি উচুটিলা নিয়ে নীলগিরি গড়ে উঠেছে। চারপাশে পরিচ্ছন্নতার ছোঁয়া। নীলগিরির চূঁড়ায় পৌঁছে অপরূপ দৃশ্য অবলোকন করে আমরা দারুণ তৃপ্তিবোধ করি। এ যেনো স্বর্গের কাছাকাছি মর্তের সাঁজানো বাগান। যদিও মাথার অনেক উপরে শাদা মেঘপুঞ্জ ঘুরছে আপন খেয়ালে কিন্তু চূঁড়ায় দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকিয়ে প্রকৃতির যে অভাবনীয় সৌন্দর্য আজ দেখলাম তা যেনো চিরন্তন অস্থিত্ব নিয়ে আমৃত্যু বেঁচে থাকবে স্মৃতির পাতায়। নীলগিরির নীল ছোঁয়া নীলাম্বরীর পরশ নিতে নিতে আমরা এক একটি দৃশ্যকে বন্দী করি ক্যামেরায়। আর ভাবতে থাকি ক্যামেরায় নয়, মনের ক্যামেরায় নীলগিরির স্বর্গদৃশ্য গাঁথা হয়ে রইল জীবন্ত হয়ে।

 

নীলগিরির বিভিন্ন দিক ঘুরতে ঘুরতে এক সময় দেখা হয়ে গেল নীলগিরি রিসোর্টের একজন কর্মকর্তার সাথে। নিজেকে একজন লেখক পরিচয় দিলে তিনি অত্যন্ত উৎসাহিত হলেন এবং তিনি বললেন, আমি এখানকার ক্যাম্প কমান্ডার। তারপর, তারসাথে নীলগিরির ব্যবস্থাপনা ও পর্যটন বিষয়ে বেশ কিছু কথা হলো। তিনি জানালেন, এখানে মেঘদূত, আকাশলীনা, মারমা, ইনছায়া, ইখিয়াই, মারুইপ্রে, মরুইফং, নীলাঞ্জনা নামের ছোটবড় চমৎকার ৮টি কটেজ ও খাওয়া দাওয়ার জন্যে একটি ক্যাফেটরিয়া রয়েছে। তবে এখানে থাকা ও খাওয়ার জন্যে কয়েকমাসপূর্বে এডভ্যান্স বুকিং দিতে হয়। সেনাবাহিনী, বিমান ও নৌবাহিনী, সরকারী কর্মকর্তা এবং পুলিশবাহিনীর সদস্যদের জন্যে বিশেষ সুবিধা রয়েছে। পাবলিকরাও কটেজ ও ক্যাফেটরিয়া বুকিং দিতে পারে, তবে সে ক্ষেত্রে তাদের হিসাব আলাদা।

 

এর মধ্যে হঠাৎ করে নোটিশ ছাড়াই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলে কমান্ডার সাহেব করমর্দন করে দ্রুত তাঁর কাজে চলে যান। আমি মাথার উপরে তাকিযে দেখি মেঘ একদম পাহাড়ের কাছাকাছি নেমে এসেছে। অপূুর্ব। তাহলে, নীলগিরিতে যে মেঘের সাথে মিতালি করা যায় সেটি মিথ্যে নয়। আমি, সুবর্ণ ও শানু অন্যান্য পর্যটকদের মতো দৌঁড়ে একটা কটেজের ছোট্ট বারান্দায় আশ্রয় নিই। এখানে আরো কয়েকজন পর্যটক আশ্রয় নিয়েছেন। একজন জানালেন, নীলগিরিতে এমন বৃষ্টি প্রায়ই হয়। বৃষ্টির মধ্যে নীলগিরি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মনভরে উপভোগ করলাম। খুব কাছ থেকে দেখলাম, মেঘ উড়ছে। মেঘ ও পাহাড়ের মিতালি এ যেন অন্যরকম দৃশ্য। তবে বৃষ্টি বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। খন্ড খন্ড মেঘ দূরে উড়ে গেলে বৃষ্টিও থেমে যায়। কটেজ থেকে বেরিয়ে আসি। ঝলমলে রোদ আবার উঠেছে। সৌহার্দকে অনেকক্ষণ পরে পেলাম। আসলে এখানে উঠারপর আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি। টিমের অন্যান্য সদস্যরা কোন জায়গা আছে জানি না। আমি আমার পরিবারের সদস্যদেরকে নিয়ে অন্যদিকে পা বাড়াই। আরেকটি টিলায় উঠি। সৌহার্দ বলে, বাবা ঐটা কি? দেখি টিলার মাথা কেটে হ্যালিপ্যাড তৈরী করা হয়েছে। বললাম, হেলিকপ্টার নামার জন্যে এমন সুন্দর করে ব্যবস্থা করা হয়েছে। সৌহার্দ বেশ কয়েকটি ছবি তুললো। আমিও সুবর্ণ ও শানুর কয়েকটি ছবি তুলি। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখতে দেখতে মনে হলো আমার দেশ সত্যিই নয়নাভিরাম। এদেশের সাথে আর কোন দেশের তুলনা হয় না। এ জন্যই বোধ করি জীবননান্দ দাস লিখেছেন; বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর।

 

[ কীভাবে যাবেন :

ঢাকা থেকে সায়দাবাদ, কলাবাগান, পান্থপথ, ফকিরাপুল থেকে শ্যামলী, হানিফ, ইউনিক, ডলফিন, এস আলম প্রভৃতি বাস রাত ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে বান্দরবান শহরের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। আবার বান্দরবান শহর থেকে চান্দেরগাড়ি, প্রাইভেট কার, আতুল নামের সি এন জি (বেবি টেক্সী) করে নীলগিরি যেতে পারেন। নীলগিরি ছাড়াও বান্দরবান জেলায় মেঘলা পর্যটন কমপ্লেক্স, শৈলপ্রপাত, নীলাচল, মিলনছড়ি, চিম্বুক, বগালেকসহ অসংখ্য নান্দনিক জায়গা রয়েছে। থাকার জন্যে বান্দরবান শহরে রয়েছে অসংখ্য রিসোর্ট, হোটেল, মোটেল ।]

 

 

শিউল মনজুর  পেশাঃ অধ্যাপনা

 

 

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts