এটুকু জানাই ছিল।

তাঁর কবিতা সংগ্রহের কাজে হাত দিয়ে কোথায় যেন একটা বড়সড় গরমিল খুঁজে পেলাম।

তখনই মনে হয়েছিল, জাতীয় গ্রন্থাগারে রাখা জীবনানন্দ দাশের পাণ্ডুলিপি একবার দেখে নেওয়া প্রয়োজন। অনুমতি মিলল গ্রন্থাগারে রক্ষিত ৪৮টি খাতা দেখার। তাতে লেখা প্রতিটি কবিতার প্রথম লাইন প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সঙ্গে মিলিয়ে দেখে মনে হল, প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ কবিতা অপ্রকাশিত! এ বার সন্দেহ হল, এই ৪৮টি খাতার বাইরেও কবিতার পাণ্ডুলিপি আরও কোথাও নিশ্চয়ই থেকে গেছে। তার প্রধান কারণ, প্রকাশিত অনেক কবিতার পাণ্ডুলিপি ওই খাতাগুলির মধ্যে নেই।

বিভিন্ন সূত্র থেকে জানতে পারি কবিকন্যা মঞ্জুশ্রী দাশ অনেক খাতা হারিয়ে ফেলেছিলেন। এর পরেও তাঁর কাছে যাও’বা ছিল, তা রক্ষা করেছেন কোনও এক সহৃদয় মহিলা। সেগুলি তিনি আবার কবির ভাই অশোকানন্দ দাশের পুত্র অমিতানন্দ দাশকে যথাসময়ে ফিরিয়েও দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই মহিলার পরিচয় জানা ছিল না।

জীবনানন্দ দাশের ডায়েরিতে জনৈক অশোক নামটি পাওয়া গেল। এই অশোক যে বন্ধুস্থানীয় কেউ, সেটা বুঝতে অসুবিধে হয়নি।

হঠাৎই ‘ব্রহ্মবাদী পত্রিকা’র একটি খবর আমার চোখে পড়ে যায়। পত্রিকাটি বরিশাল ব্রাহ্ম সমাজের মুখপত্র। এখানেই জীবনানন্দের প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন জীবনানন্দ দাশের বাবা সত্যানন্দ দাশ।

পত্রিকার সেই খবরটি লিখছে, ১৯ বৈশাখ ১১৩৯ বঙ্গাব্দে রায়বাহাদুর শরৎচন্দ্র দাশের তৃতীয় কন্যা সলিলার সঙ্গে বরিশালের ব্রাহ্মবন্ধু বিনয়ভূষণ গুপ্তের পুত্র অশোকচন্দ্রের শুভ বিবাহ।

এর পর বহু কষ্টে বিনয় গুপ্তের সেই পুত্রবধূর সঙ্গে জীবনানন্দ-পরিবারের একটা যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া গেল। এও জানা গেল, বিনয়ভূষণ এবং তাঁর দুই ভাই নলিনীভূষণ ও ইন্দুভূষণের সঙ্গে দাশ-পরিবারের হৃদ্যতা ছিল। কবির ঠাকুরদা সর্বানন্দ দাশের মৃত্যুর পর দাশ পরিবারকে অকৃতদার নলিনীভূষণ নানা ভাবে সাহায্যও করেন।

শুরু হল খোঁজ। কিন্তু তখনও অশোকচন্দ্র গুপ্তর কোনও উত্তরাধিকারের খবর আমার কাছে ছিল না।

কথা চলতে লাগল কবির পরিবার বা তাঁদের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা নানা মানুষজনের সঙ্গে। আর তাতেই হদিশ মিলল অশোকচন্দ্র গুপ্তর কন্যা শ্রীমতী রত্না রায়ের। শোনা গেল, কবির মতোই প্রায় একই সময়ে অশোকচন্দ্র গুপ্তও সপরিবার বরিশাল থেকে চলে আসেন কলকাতায়। তাঁদের যোগাযোগ ছিল অটুট।

এক গোধূলিবেলায় হাজির হলাম শ্রীমতী রত্না রায়ের বাড়ি। ঝোলায় তাঁর বাবা-মায়ের বিবাহের খবর সংবলিত ‘ব্রহ্মবাদী’ পত্রিকার কপি। নানান কথার মাঝে রত্নাদেবী জানালেন, প্রাণে ধরে জীবনানন্দ দাশের কিছু খাতা তিনি কাউকে দিতে পারেননি। মঞ্জুশ্রী দাশের কিছু খামখেয়ালির কথাও তিনি বললেন। যে জন্য কবির বহু পাণ্ডুলিপি কোথায় যে হারিয়ে গেছে, কে জানে!

শুধুমাত্র কবির বরিশালের কথা শোনার আগ্রহে আমার যাতায়াত শুরু হল রত্নাদেবীর ডোভার লেনের বাড়িতে। তেমনই একদিন আবার কবির সেই খাতাগুলির প্রসঙ্গে উঠল। এর পর হঠাৎই দেখি, নিজের থেকে উঠে গিয়ে খাতাগুলি নিয়ে এলেন তিনি। আর জীবনানন্দের কবিতা উদ্ধারের কাজ হচ্ছে বলে এত দিন গচ্ছিত রাখা প্রাণভোমরাকে তুলে দিলেন তিনি আমার হাতে!  সেই সংগ্রহ নিয়ে এবারে প্রকাশ পেতে চলেছে ‘অপ্রকাশিত২ জীবনানন্দ দাশ’ (সপ্তর্ষি প্রকাশন)।

রত্নাদেবী আজ আর পৃথিবীতে নেই। কিন্তু উদ্ধার-পর্বের সেই ক্লাইম্যাক্সের ছবিটা এখনও স্পষ্ট দেখতে পাই। তাঁর সঙ্গে এক প্রৌঢ়ার জ্বলজ্বলে চোখের তারাগুলিও!