শত্রু তুমি বন্ধু তুমি- সাকিব আল হাসান ও তামিম ইকবালের বন্ধুত্বের বাঁধন আলগা হয়ে যায় প্রায় এক দশক আগে। ২০১১ সালে জিম্বাবুয়ে সফরের পর একযোগে দুজনের নেতৃত্ব হারানো এই বিচ্ছেদের পটভূমি।
সময় যত গড়িয়েছে, ততই দূরত্ব বেড়েছে দুজনের। এখন অবস্থা এমন যে, তামিম ইকবালের অগ্রজ ম্যানেজার হিসেবে ড্রেসিংরুমে থাকবেন—এটাও অস্বস্তিকর বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক সাকিবের কাছে।
দুজনের সম্পর্কের ভূমিধস দেখে বিচলিত বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) পরিচালকদের একাংশের মনে নাকি সংশয়, সামর্থ্যানুযায়ী পারফরম না করে সাকিবকে ‘স্যাবোটাজ’ করবেন না তো তামিম! নানা মাধ্যমে প্রকাশিত এমন সংশয়ের ব্যাপারে জানতে চাইলে গতকাল তিনি থমকে গেছেন, ‘আপনার প্রশ্নটা শুনেই আমার লজ্জা লাগছে! আর কিছু বলতে চাই না।’
একই সংশয় সাকিবকে ঘিরেও আলোচনায় এসেছিল। সেই সংশয় এক ঝামটায় উড়িয়ে দিয়েছিলেন তৎকালীন অধিনায়ক তামিম ইকবাল, ‘পাগল নাকি! এসব ভাবলে আপনি খেলবেন কী করে?’ একালে ক্রিকেটারদের শরীরী ভাষা পড়ার জন্য ড্রেসিংরুমে এত এত বিশেষজ্ঞ থাকেন যে, দলকে ডোবাতে গেলে সেই খেলোয়াড় নিশ্চিত বিপদে পড়বেন। তাতে অনুমান করা যায়, সাকিবের মনে এমন সংশয় থাকার কথা নয়।
সাকিব বোর্ড সভাপতির সঙ্গে রাত গভীরের আলোচনায় তামিমের ফিটনেস নিয়েই আপত্তির কথা বলেছেন। তামিমের ‘স্যাবোটাজ’ করা নিয়ে সংশয়ের কথা বলেননি। কিন্তু ক্রিকেটসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আলোচনার সীমা-পরিসীমা নেই। তামিমের অধীনে সাকিবের ইচ্ছাকৃতভাবে খারাপ খেলার সংশয়ের ধোয়া ছড়িয়েছিল এই পক্ষ থেকেই।
তামিমের যদিও কখনো তা মনে হয়নি। বরং বাঁহাতি ওপেনারের অধীনে দক্ষিণ আফ্রিকায় ওয়ানডে সিরিজ জয়ে দুর্দান্ত পারফরম করেছিলেন সাকিব। জোহানেসবার্গে জয়ের পর সাকিব ও তামিমের আলিঙ্গনাবদ্ধ ছবিও আছে। তবে সেই ছবি বন্ধুত্বের নয়, পেশাদার সাফল্য উদযাপনের ছবি।
এরপর সব ঠিকঠাকই চলছিল।
মাঠে তারা প্রয়োজনে কথা বলেন। কিন্তু মাঠের বাইরে কেউ কারোর ছায়াও মাড়ান না। তাতে মাঠে তো কোনো সমস্যা হচ্ছে না—দুই তারকার সম্পর্কের অবনতিবিষয়ক আলোচনায় শান্তিপূর্ণ যতিচিহ্ন পড়েও গিয়েছিল। কিন্তু সেই সম্পর্ক আবার সামনে এসেছে। সেটা আরো উগ্রভাবে। একজন খেলোয়াড় ইচ্ছাকৃতভাবে খারাপ খেলতে পারেন—এই সংশয় বিষাক্ত। আর যদি তা সত্যিই হয়ে থাকে, তবে সেই খেলোয়াড় সর্বজনপরিত্যাজ্য। তিনি তামিম কিংবা সাকিব, যিনিই হন না কেন। তবে শুরুতেই বলেছি, নিজের ক্যারিয়ার বিলীন করা এমন অপচিন্তা আধুনিক ক্রিকেটে অচল। ড্রেসিংরুম তো বটেই, আজকাল টিভির দর্শকরাও এসব আঁচ করে ফেলে। বরং এমন সংশয় যে বা যাদের মনে জাগে, তাদের মানসিক চিকিৎসা জরুরি। আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, বোর্ডের আনাচে-কানাচেও এমন ‘রোগী’ আছেন, যাঁদের কাজ সমস্যার সমাধান খোঁজা, উসকে দেওয়া নয়।
যাক, সাকিব-তামিমের বন্ধুত্বের গল্পে ফেরা যাক। দুজনে উঠতি প্রতিভা। সেকালে মাঠ এতটাই ফাঁকা ছিল যে, অল্প বয়সে মহাতারকা বনে যান দুজনে। দুজনের প্রসঙ্গ এলেই অকৃত্রিম বন্ধুত্বের স্রোত আছড়ে পড়ে ক্রিকেটাঙ্গনে। দুজনের ফেসবুক ঘাঁটাঘাঁটি করলেও একজনকে আরেকজনকে ‘বেস্ট ফ্রেন্ড’ বলে সম্বোধন করতে দেখা যাবে। যদিও কয়েক বছর আগে দুজনের একজন প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, ‘আমি ওকে বেস্ট ফ্রেন্ড মনে করতাম। কিন্তু ও সম্ভবত সেটা মনে করত না।’
কে মনে করতেন আর কে হয়তো মনে করতেন না—পুরনো কাসুন্দি টেনে তামিম ও সাকিবের সম্পর্কের দেয়ালে নতুন করে পলেস্তারা দেওয়ার দরকার নেই। যেমন, বলার দরকার নেই ২০১১ জিম্বাবুয়ে সফরের পর দুজনের মধ্যে উঠে যাওয়া অদৃশ্য দেয়ালের খবর। ওই সফরের পরপর নেতৃত্ব হারিয়েছিলেন দুজনে। বিশ্বস্ত সূত্র মতে, সেবার নেতৃত্ব হারানোর পেছনে এঁদের একজন বন্ধুর দায় খুঁজে পেয়েছিলেন। এখানেও অনুল্লেখ্য থাকুক।
এরপর দুজনের খ্যাতি বেড়েছে, বিজ্ঞাপনের বাজারও বড় হয়েছে। সঙ্গে ক্রিকেট প্রশাসক মহলে গুরুত্বের প্রতিযোগিতা বেড়েছে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে দুজনের ভক্তের সংখ্যা বেড়েছে। এই বাড়-বাড়ন্তের মধ্যে দুজনের মাঝে দূরত্ব বহুগুণ বেশি বেড়েছে। এই দূরত্ব তৈরির পেছনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দুজনের ভক্তকুলের প্রভাবও আছে। সাকিবের ব্যর্থতায় হুমড়ি খেয়ে পড়েছে একদল ফেসবুক জনতা। তামিমের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। যোগ-বিয়োগ করে ক্রিকেটাররাই আবিষ্কার করেন যে, এই জনতা সাকিব কিংবা তামিমের ফ্যানবেজ। এসব দেশে ২০১৯ বিশ্বকাপের সময় তারকা ক্রিকেটারদের বলাবলি করতে শুনেছি—ভক্তরা কি একটু বেশি বাড়াবাড়ি করছে না?
তবু ২০১৯ বিশ্বকাপের পর ক্রিকেটারদের এক দিনের বিদ্রোহে সাকিব ও তামিম কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন। বাংলাদেশের ক্রিকেট সংস্কৃতি পরিবর্তনের পক্ষে দুজনের মুখেই স্লোগান শোনা গিয়েছিল।
সেসব স্লোগান আর শোনা যায় না। আর কখনো শোনা যাবে বলে মনেও হয় না। তবে আসন্ন বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের (বিপিএল) ‘টিআরপি’ আকাশ ছোঁয়ার প্রেক্ষাপট তৈরি করে দিয়েছে ২০২৩ বিশ্বকাপের দল নির্বাচন। এই দল নির্বাচনকে ঘিরে সাকিব আল হাসান ও তামিম ইকবালের সম্পর্কের যে ছবি আঁকা হয়েছে জনমনে, তাতে বিপিএল বাড়তি দর্শক টানবে নিশ্চিত। রংপুর রাইডার্স আর ফরচুন বরিশালের মধ্যকার ম্যাচেই তো মুখোমুখি হবেন দুজনে!