শিশুদের শেখ রাসেলের চেতনায় গড়ে তুলতে হবে

সুজন হাজং

১৮ অক্টোবর প্রাণের উচ্ছ্বাসে উদ্ভাসিত তুমি। এই ১৮ অক্টোবর বাংলার মাটিতে জন্মেছিলে তুমি। এই দিনে, এই শুভক্ষণে তোমাকে অভিবাদন, তোমাকে অভিবাদন।

তুমি আমাদের রাসেল, রঙধনুর একটি দেশ। তুমি আমাদের রাসেল, ভালোবাসার স্বপ্ন স্বদেশ।স্বদেশের বুক চিরে, কোটি মানুষের অন্তরে মিশে আছে একটি নাম; সে নাম ভালোবাসার, সে নাম আদর-মমতার।সেই অবুঝ শিশুর চোখে নতুন সকাল দেখা; সেই সকালের নাম বাংলাদেশ। সেই অবুঝ শিশুর চোখে নতুন আকাশ দেখা; সেই আকাশের নাম বাংলাদেশ।

সোনাভরা ফসলের মাঠে জেগে উঠুক প্রিয় বাংলাদেশ।
গ্রামবাংলার পথেঘাটে জেগে উঠুক প্রিয় বাংলাদেশ।

এই বাংলাদেশ শেখ রাসেলের; এই বাংলাদেশ স্বপ্নভরা শিশুর চোখে আলোর মিছিলের বাংলাদেশ।

রাসেল আমাদের বাংলাদেশ, কোটি প্রাণের স্পন্দন। রাসেল আমাদের বাংলাদেশ, ভালোবাসার চিরবন্ধন।এই বন্ধন পিতার সঙ্গে পুত্রের; বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তার কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেলের।

‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থে শেখ রাসেলকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন- “৮ ফেব্রুয়ারি ২ বছরের ছেলেটা এসে বলে, আব্বা বাড়ি চলো। কী উত্তর ওকে আমি দিব। ওকে ভোলাতে চেষ্টা করলাম, ও তো বোঝে না আমি কারাবন্দি। ওকে বললাম, ‘তোমার মার বাড়ি তুমি যাও। আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো।’ ও কি বুঝতে চায়! কী করে নিয়ে যাবে এই ছোট্ট ছেলেটা, ওর দুর্বল হাত দিয়ে মুক্ত করে এই পাষাণ প্রাচীর থেকে! দুঃখ আমার লেগেছে। শত হলেও আমি তো মানুষ আর ওর জন্মদাতা। অন্য ছেলেমেয়েরা বুঝতে শিখেছে। কিন্তু রাসেল এখনো বুঝতে শিখেনি। তাই মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে যেতে চায় বাড়িতে।”

পিতার সঙ্গে পুত্রের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য; হৃদয় নিংড়ানো সুনিবিড় স্নেহ আর প্রগাঢ় বিশ্বাসের। এই বিশ্বাস শাশ্বত; এই বিশ্বাস অপরিসীম দরদ ও নির্ভরতার। সন্তান সব সময় পিতার বুকে মাথা রেখে নিরাপদে ঘুমানোর আশ্রয় খোঁজে; পিতার হাত ধরে হাঁটার অবলম্বন খোঁজে; পিতার হাতে ঘুড়ির নাটাই দিয়ে মুক্ত বিহঙ্গের মতো আকাশে ডানা মেলে উড়তে চাই। রাসেলও ঠিক তেমনটা চেয়েছিলেন, বাবার হাত ধরে হাঁটতে চেয়েছিলেন পৃথিবীর পথে।

এই বন্ধন বোনের সঙ্গে ভাইয়ের; হাসু আপার সঙ্গে তার ভাই ছোট্ট রাসেল সোনার। রাসেলের দুঃখজয়ী বোন হাসু আপা বলেন, ‘শেখ রাসেল আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু আছে তার পবিত্র স্মৃতি। বাংলাদেশের সব শিশুর মধ্যে আজও আমি রাসেলকে খুঁজি। এই শিশুদের রাসেলের চেতনায় গড়ে তুলতে হবে; এমন এক উজ্জ্বল শিশুর সত্তা বুকে ধারণ করে বাংলাদেশের শিশুরা বড় হোক। খুনিদের বিরুদ্ধে তারা তীব্র ঘৃণা বর্ষণ করুক।’

এই বন্ধন মায়ের সঙ্গে অবুঝ শিশুর; বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের সঙ্গে তার সন্তান রাসেলের। বঙ্গবন্ধুকন্যা ‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’ গ্রন্থে বলেন- রাসেল, রাসেল তুমি কোথায়?
রাসেলকে মা ডাকে, আসো, খাবে না, খেতে আসো।
মা মা মা, তুমি কোথায় মা?
মা যে কোথায় গেল… মাকে ছাড়া রাসেল যে ঘুমাতে চায় না। ঘুমের সময় মায়ের গলা ধরে ঘুমাতে হবে। মাকে ও মা বলে যেমন ডাক দিত, আবার সময় সময় আব্বা বলেও ডাকত।
মাতৃস্নেহের এই পবিত্র বন্ধন ছিঁড়ে যাবে না কোনোদিন।
এই বন্ধন জন্ম থেকে জমান্তর। এই বন্ধন চিরদিনের।

বঙ্গবন্ধুকন্যা ‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’ গ্রন্থে বলেন, ‘রাসেলের জন্মের আগের মুহূর্তগুলো ছিল ভীষণ উৎকণ্ঠার। আমি, কামাল, জামাল, রেহানা ও খোকা চাচা বাসায়। বড় ফুফু ও মেজো ফুফু মার সাথে। একজন ডাক্তার ও নার্সও এসেছেন। সময় যেন আর কাটে না। জামাল আর রেহানা কিছুক্ষণ ঘুমায় আবার জেগে ওঠে। আমরা ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে জেগে আছি নতুন অতিথির আগমন বার্তা শোনার অপেক্ষায়। মেজো ফুফু ঘর থেকে বের হয়ে এসে খবর দিলেন আমাদের ভাই হয়েছে। খুশিতে আমরা আত্মহারা। কতক্ষণে দেখব। ফুফু বললেন, তিনি ডাকবেন। কিছুক্ষণ পর ডাক এলো। বড় ফুফু আমার কোলে তুলে দিলেন রাসেলকে। মাথাভরা ঘন কালো চুল। তুলতুলে নরম গাল। বেশ বড়সড় হয়েছিল রাসেল।’

রাসেলকে নিয়ে একটি স্বপ্নের রঙিন ভুবন তৈরি করেছিলেন তার হাসু আপা। ছায়াঘেরা, মায়াঘেরা একটি জীবন- যেখানে আনন্দময় বেঁচে থাকবে রাসেল।
রাসেল একদিন অনেক বড় হবে। ধরিত্রীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। কিন্তু ওই স্বপ্নের পথচলা হঠাৎ থেমে গেল। থামিয়ে দিল নিষ্ঠুর ঘাতকরা। বুলেটের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করল তার নরম শরীর।
তোমরা কি শুনতে পাও শেখ রাসেলের ক্রন্দন। তোমরা কি দেখতে পাও তার বুকে রক্তক্ষরণ। আমি মায়ের কাছে যাব। আমি বুবুর কাছে যাব।
দূর পাহাড়ের বুকে যেমন ভোরের সূর্য দেখা যায়।
রাসেল তোমার নামে আজও দু’চোখে নদী বয়ে যায়।
দূর আকাশের বুকে যেমন রাতের তারা দেখা যায়। রাসেল তোমার ডাকে আজও হৃদয়ে আকাশ থমকে দাঁড়ায়।

রাসেল তুমি হারিয়ে যাওনি এ দেশকে ভালোবেসে।
তুমি আছ মিশে অগণিত শিশুর মনের ক্যানভাসে।
তোমার হাসিতে পৃথিবী হাসে দুঃখ মুছে যায়।
তোমার চোখে স্বপ্ন আগামীর শিশুরা দেখতে পায়।

শিশুদের মনের ক্যানভাসে ভেসে উঠুক রাসেলের প্রতিচ্ছবি। শিশুদের ভুবন রাঙানো আদরমাখা হাসিতে হেসে উঠুক বাংলাদেশ।

শিশুদের আনন্দময় স্বপ্নের পথচলা হোক সুন্দর ও গতিশীল। প্রত্যেক শিশুর মেধা ও প্রতিভা বিকশিত হোক আলোর ঝরনাধারায়। আজকের শিশুরাই আগামী দিনে দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করবে।

রাসেল তুমি এই বাংলার স্নিগ্ধ ভোরের আকাশ।
পাখি ডাকা শ্যামল গায়ের মন মাতানো বাতাস।
ভোর যেমন পাখির কলকাকলিতে মুখরিত, তেমনি রাসেল ছিলেন সজীব ও প্রাণবন্ত। এই সজীবতা মিশে থাকুক প্রত্যেক শিশুর জীবনে; এই স্নিগ্ধতা মিশে থাকুক প্রত্যেক শিশুর অবয়বে। নির্মল বাতাসে বেড়ে উঠুক প্রত্যেক শিশুর শৈশব।

হাজার নদীর কলতানে তুমি আছ এই বাংলায়।
প্রজাপতির ডানা মেলে উড়ে যায় দূর অজানায়।
লাল সবুজের পতাকায় তোমার ছবি দেখি।
ভালোবাসার রঙতুলিতে তোমার ছবি আঁকি।
রাসেলের ছবি আঁকা বুকের গভীরে; পরম মমতায়, সযত্নে, ভালোবাসায় ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলজুড়ে, বাংলার মানচিত্রে।

একটি স্বোপার্জিত স্বাধীনতা থেকে কুড়িয়ে নেওয়া স্বপ্ন শিশুর চোখে বেঁচে থাকুক অনন্তকাল। রাসেল আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের অঙ্গীকার; মায়ের কোলে অবুঝ শিশুর বেঁচে থাকার অধিকার।
সে আমাদের নতুন ভোরের সূচনা; সে আমাদের রক্তের দামে কেনা চেতনা।

সুজন হাজং : কবি, গীতিকার, কলামিস্ট ও পরিচালক, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমি বিরিশিরি, নেত্রকোনা

Print Friendly

Related Posts