জাহাঙ্গীর লিটন: লক্ষ্মীপুরে খামারি ও কৃষকদের দারিদ্র বিমোচন ও ন্যায্যপ্রাপ্তি নিশ্চিতকরণে গড়ে তোলা হয় মিল্কভিটার দুগ্ধ কারাখানা। পাশাপাশি মাংস উৎপাদন বাড়াতে নেওয়া হয় মহিষ উন্নয়ন প্রকল্প।
এই কারাখানায় গত পাঁচ বছর ধরে বন্ধ রয়েছে দুধ সংগ্রহ। এতে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন চরাঞ্চলের এক হাজার খামারি। অন্যদিকে বন্ধ হওয়ার পথে সোয়া ১৮ কোটি টাকার মহিষ প্রকল্পটিও। অথচ এনিয়ে কারও যেনো কোনো মাথাব্যথা নেই।
খামারিদের থেকে জানা যায়, ২০০২ সালে লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার মিতালী বাজারে ৫.৪৭ একর জমিতে দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় ইউনিয়ন লিমিটেড নামে দুগ্ধ শীতলীকরণ ও সরবরাহ কেন্দ্র স্থাপন করে মিল্কভিটা কর্তৃপক্ষ। উদ্দেশ্য, চরাঞ্চলের মানুষের ভাগ্য উন্নয়ন। এ কেন্দ্রের আওতায় ৩৮টি প্রাথমিক দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় সমিতির প্রায় ১ হাজার খামারির কাছ থেকে নির্ধারিত মূল্যে দুধ ক্রয় করতো মিল্কভিটা। দুধগুলো প্রক্রিয়া শেষে ঢাকার মিরপুরে মিল্কভিটার মূল কেন্দ্রে পাঠানো হতো।
অন্যদিকে, খামার পরিচালনার জন্য ২০ হাজার থেকে ৭০ হাজার টাকারও অধিক ঋণের পাশাপাশি গবাদিপশুর চিকিৎসা সেবা নিশ্চিতকরণ ও ঔষধ দেওয়া হতো খামারিদের। হঠাৎ করে ২০১৮ সালে রায়পুর মিল্কভিটার দুধ শীতলীকরণ কেন্দ্রের দুধ সংগ্রহ কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়। এমনকি শীতলীকরণের অত্যাধুনিক মেশিনটিও গত দুই বছর আগেই ফেরত নিয়ে যায় উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। এতে খামারিরা উৎপাদিত দুধ বিক্রি ও ঋণ পরিশোধ নিয়ে বিপাকে পড়েন। একপর্যায়ে ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে বাধ্য হয়ে দুধ উৎপাদন ও গরু পালন ছেড়েছেন চরাঞ্চলের অধিকাংশ খামারি।
এখন শুধু লাখ লাখ টাকা খরচ করে গড়ে ওঠা খামারটি দৃশ্যমান হয়ে আছে কিন্তু তাতে নেই কোন গরু। নিঃস্ব হয়ে পথে বসেছেন বেশিরভাগ খামারিই।
এদিকে নীতিমালা অনুযায়ী লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ায় সোয়া ১৮ কোটি টাকা ব্যয়ের উন্নত জাতের মহিষ প্রকল্পেও চরম অনিয়ম-অব্যবস্থাপনায় প্রায় বন্ধের পথে মিল্কভিটার দুগ্ধ কেন্দ্রটি।
মিল্কভিটা অফিস সুত্রে জানা যায়, দুধ ও মাংসের পাশাপাশি খামারিদের ভাগ্য উন্নয়নের সেই বিশেষ প্রকল্পটি রায়পুর মহিষ উন্নয়ন ও কৃক্রিম প্রজনন প্রকল্প নামে অনুমোদন লাভ করে। সরকারি ৭৫ ভাগ ও মিল্কভিটা সমবায়ীদের ২৫ ভাগ অর্থায়নে ১৮ কোটি ২৩ লক্ষ ৪৭ হাজার টাকা ব্যয়ের এ প্রকল্পটি ২০১৩ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যস্ত বাস্তবায়নের মেয়াদ কাল ধরা হয়। প্রকল্পের আওতায় খামারিদের সেবা দেওয়ার জন্য মিল্কভিটায় ৫টি শেড, একটি বীজাগার মেশিন, একটি গবেষণাগার, প্রজনন মেশিন, আধুনিক নিক্তিসহ বিভিন্ন যন্ত্রাংশ স্থাপন করা হয়।
খামারি ও মিল্কভিটার শ্রমিকরা বলেন, সপ্তাহে ৪/৫ লাখ টাকার দুধ সরবরাহ করা হতো একেকটি খামার থেকে। শুরুর দিকে ৩২.৮১ টাকা হারে দুধ ক্রয় করেছে মিল্কভিটা। বাজারে যখন ৫০/৬০ টাকা মূল্য তখনও সর্বোচ্চ ৪০ টাকা, ৪২ টাকা হারেও দুধ সংগ্রহ করতো তারা। দুধ বিক্রির অংশ থেকে পরিবহন ব্যয়, সুদের কিস্তির টাকা, শেয়ার খরিদ ৪০ পয়সা, সঞ্চয় ৬৫ পয়সা ও কমিশন ১ টাকা ধরা হতো। কিন্তু কোনো ঋণ না থাকা সত্ত্বেও খামারিদের পাওনা টাকা ফেরত না দেওয়ার অভিযোগ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে।
খামারিদের অভিযোগ, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রকৃত খামারিদের ঋণ না দিয়ে স্বজনপ্রীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে দিয়েছেন ঋণ। তবে বিশেষ প্রকল্পের মাধ্যমে খামারিদের ভাগ্য উন্নয়নের আশ্বাসও দেন কর্তৃপক্ষ। খামারিদের দেওয়া সেই আশ্বাস আশ্বাসেই রয়ে যায়।
রায়পুরের চরাঞ্চলের খামারিদের ভাগ্য ফেরাতে শীতলীকরণ মেশিনটি পুনরায় স্থাপন করে বাজার মূল্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে মূল্য নির্ধারণপূর্বক দুধ সংগ্রহ করার দাবী জানান খামারিরা। একই সাথে খামারিদের জমাকৃত সঞ্চয়ের টাকা ফেরতসহ বিনা সুদে ঋণের মাধ্যমে খামারিদের পুনরায় সচল রাখার দাবী করেন তারা।
বর্তমানে মহিষ প্রকল্পটি লোকসানে রয়েছে। প্রতিদিনই ৬০-৭০ লিটার দুধ সংগ্রহ হয়। সেগুলো ফ্রিজআপ করে ইজারাদারকে দেওয়া হচ্ছে।
রায়পুর মিল্কভিটার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ডা. আশ্রাফুজ্জামান বলেন, কর্তৃপক্ষের নিদেশনা অনুযায়ী উন্নত জাতের মহিষগুলো রাখাল নিয়োগের মাধ্যমে দেখভাল করা হচ্ছে। শুরুতে ২৫০টি মহিষ থাকলেও বিক্রয় উপযোগী হওয়ায় বেশ কিছু মহিষ বিক্রি করা হয়েছে। বর্তমানে ১১১টি মহিষ রয়েছে। শীতলীকরণ মেশিনের চাহিদা মত দুধ না পাওয়ায় মেশিন নিয়ে যায় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু খামারিরা মিল্কভিটায় দুধের দাম কম দেখে বাজারে মিষ্টির দোকানগুলোতে সাপ্লাই দেয়। এখানে উৎপাদিত মহিষের দুধ টেন্ডারের মাধ্যমে বাইরে বিক্রি করে রাজস্ব আয় হয়।