মনির জামান
আমার বিশ্ব বিদ্যালয় জীবনের সহপাঠি ছিলো শেলী সেনগুপ্তা; এখনো প্রিয় বন্ধু; রণজিৎ বিশ্বাস ছিলেন ওর বর। ওদের এক ছেলে, এক মেয়ে—অভিষেক আর উপমা; দাদা ডাকতো হিরা, মুক্তা বলে। আমরা যখন ছাত্র ওরা তখন থাকতো আজিমপুর কলোনীর বেবি আইসক্রিম মোড়ের কোয়ার্টারে। রনজিৎ দা তখন উপ-সচিব; কাজ করেন উপপ্রধান মন্ত্রী কাজী জাফরের দফতরে। এই সময়টায় খুব আন্দোলন সংগ্রাম চলতো গনতন্ত্রের জন্য; প্রায়ই ভার্সিটি বন্ধ হয়ে যেতো। আমরা তখন শেলীর বাসায় খুব আড্ডা দিতাম। তখন দাদাকে দেখেছি, শত ব্যস্ততার মধ্যেও ধীরে ধীরে লেখক হয়ে উঠছেন। যতটা অবসর পেতেন, পুরোটা দিয়ে দিতেন লেখার খাতায়।
তার অনেকগুলো ডাইরী ছিলো—পুরো লেখা, আধা লেখায় ভরা। চলতে চলতে যদি কিছু—কোনো চরণ, দৃশ্যপট, তুচ্ছ বিষয় পেয়ে যেতেন—টুকে রাখতেন অইসব লেখার খাতায়। দাদার হস্তাক্ষর ছিলো আপন কন্যা মুক্তার মতো সুন্দর। দাদা ছিলেন পরিপাটি গোছগাছ; কথা বলতেন সুচারু করে; সবার জন্য ছিলো পরম মমতা। গূঢ়তর সাহিত্যজ্ঞান সঞ্চয় করতে পছন্দ করতেন। রসায়ন শাস্ত্রে উচ্চতর ডিগ্রীধারী হওয়ায় স্ত্রীকে সাহিত্যের ছাত্রী হতে অনুপ্রানিত করেছেন সাহিত্যপ্রেম থেকে।
সন্তানদের জন্য ছিলেন সংবেদনশীল পিতা। নিয়তির কী নির্মম লীলেখেলা, প্রিয় পুত্রের দাহ করতে হয়েছিলো তাকে। তবু সাহিত্য থেকে একপ্রস্থ্য দূরে থাকেননি কোনো ভাবালুতায়। দেখতে দেখতে তার লেখা দিয়ে কুড়িটির মতো গ্রন্থ পেয়ে গেছি আমরা।
বাংলা ভাষা ছিলো রণজিৎ বিশ্বাসের নিমগ্নতার বিরাট ক্ষেত্র। শব্দকে বাজিয়ে দেখতেন প্রতিটি লেখায়। শব্দের ভান্ডারি ছিলেন দাদা। ভাষা নিয়ে কিছু বইয়ের নাম বলি, তাতেই বুঝবেন তার ভাবনা কতদূর প্রসারিত—ব্যবহারিক বাংলা: যত ভুল তত ফুল, শুদ্ধ লেখা শুদ্ধ বলা, ভাষার যত গোলক ধাঁধা।
রণজিৎ বিশ্বাস নাম করেছেন গল্পকার হিসাবে। আমরা যেমন প্রচল গদ্যে গল্প সাজাই তিনি কোনোক্রমেই তেমন ছিলেন না। তার গল্পের ভাষা নতুন এবং নীরিক্ষাপ্রবন।‘ আমার প্রথম গল্প উনিশ’ বইটি পড়লে টের পেয়ে যাবেন। ‘মানুষ এবং মুক্তিযুদ্ধের সংলাপ’, ‘কুড়িয়ে পাওয়া সংলাপ’, ‘মাতৃভুমির মালিকানা’—এই বই তিনটিতে দেখবেন, ডাইরীতে নানা সময়ে টুকে রাখা বিচিত্র অভিজ্ঞতা নতুন ভাষাভঙ্গিতে তুলে ধরেছেন আমাদের জন্য।
অনেকেই তাকে জেনেছেন রম্য লেখক হিসাবে। সত্যি তিনি বাংলা রস-রচনায় যোগ করেছেন নতুন মাত্রা। ঢাকার লোকজন পড়ে কম, বলে বেশি। রণজিৎ বাবুর ‘রম্যকথার এক ঝাঁপি’, ‘রম্যারম্য বচন কথা’, ‘গুরুগুরু লঘুলঘু’—এই বইগুলো পড়েই দেখুন না, কত বিচিত্র আনন্দ মেলে।
রণজিৎ বিশ্বাস ছিলেন ক্রিড়া লেখক; ক্রিকেট ছিলো তার প্রিয় বিষয়। যে সময় ঢাকার মানুষ ক্রিকেট নিয়ে ছিলো একদম অশিক্ষিত, তখন, সেই আশির দশকের গোড়া থেকে ক্রিকেট নিয়ে পত্রিকায় লিখেছেন লঘু-গুরু নানান পদের লেখা। তিনি ছিলেন ক্রিকেটের ধারাভাষ্যকার; বাংলা, ইংরেজি দুই ভাষাতে ক্রিকেট নিয়ে বলতে শুনেছি টিভি, রেডিওতে। এনিয়ে তার বই আছে—‘ক্রিকেটের কথা শোনো অমৃত সমান’।
এই মহান মানুষটার সঙ্গে কিছু ভুল কাজ করে ফেলেছিলাম, জীবনের অনভিজ্ঞতা থেকে। আমাকে তার প্রথম দুটি গল্পের বই ছপেতে দিয়েছিলেন, যা একদম হযবরল করে ফেলি। উন আমাকে কিছুই বলেন নি; স্নেহের চোখেই দেখেছেন। দাদার সাথে শেষ দেখা ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয় মসজিদ চত্তরে কবি রফিক আজাদের জানাযার সময়। ‘কবি খোকন’ বলে পিঠে হাত বুলিয়ে স্নেহের পরশ দিয়েছিলেন। তখন তিনি কিছুটা অসুস্থ; দুর্বিত্তদের আঘাতে আহত হওয়ায় লাঠি ভরদিতে হচ্ছিলো।
আমরা এই মহান লেখকটিকে হারিয়ে ফেলেছি, ঠিক স্বীয় পুত্র অভিষেকের মত। দুঃখ করি না, কারণ লেখক যুগযুগ বেঁচে থাকে তার লেখায়। জয়তু রণজিৎ- অভিষেক।