শৌল বৈরাগী
যুগ বা কালের পরিবর্তনে অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়ে থাকে এবং হয়। সে যে কোন সেক্টরে বা বিষয়েই হোক না কেন। এই পরিবর্তনগুলোর মধ্যে ভৌগোলিক, পরিবেশ, জলবায়ু, মানুষের আচার-আচরণ, খাদ্যাভ্যাস, সংস্কৃতি, রীতিনীতি, পুরানো ব্যবহার্য জিনিস পত্রের পরিবর্তে আধুনিক সব যন্ত্রপাতি ব্যবহার ইত্যাদি। অনেকগুলো পরিবর্তন সহজেই চোখে পড়ে আবার এমন অনেক পরিবর্তন যা সহজে বুঝা বা হিসেব নিকেষ করা যায় না।
আবার অনেক বিষয় যেমন অভ্যাস, রীতিনীতি, সংস্কৃতি ইত্যাদি হয়তো ৪০/৫০ বছর আগে ছিল; কিন্তু এখন আর সেগুলো কেউ কালেভদ্রে অভ্যাস বজায় রাখলেও ঢালাও ভাবে পরিবর্তিত অবস্থার প্রেক্ষাপটে অভ্যাসগুলো পালন করা সম্ভব হয় না। আর ৪০/৫০ বছর আগের ব্যবহৃত অভ্যাস, সংস্কৃতি, রীতিনীতি ইত্যাদি এখনকার প্রজন্ম তো অনেক ক্ষেত্রে জানবেই না; কারণ অনেক কিছুই এখন আর চলমান নাই বা অধুনিকতার যাঁতাকলে হারিয়ে গেছে বা পরিবর্তিত হয়েছে।
যাহোক, আজ আমার ৪০/৫০ বছর আগের দেখা এবং বর্তমানে দেখা বড়দিন উদযাপন কেমন ছিল বা কেমন পরিবর্তিত হয়ে তা নিয়ে। বড়দিন এলেই খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে একটা সাজ সাজ রব শুরু হয়ে যায়। বড়দিন উদযাপনে চলে নানা প্রস্তুতি। সে প্রস্তুতি, রীতিনীতি, সংস্কৃতি তুলে ধরাই এ লেখা।
বড়দিনের কীর্তন:
বড়দিনের সেকাল অর্থাৎ ৪/৫ দশক আগের কথা। ডিসেম্বর মাস এলেই মনের মধ্যে কেমন একটা খচখচ ভাব এমনিতেই চলে আসতো। বিশেষতঃ ছোট ছেলে-মেয়ে থেকে শুরু করে যুবকদের মধ্যে এমনকি যারা বয়োজেষ্ঠ্য ছিলেন তাদের মধ্যেও। ৮/১০ বছর ছেলেমেয়ে থেকে শুরু করে যুবকদের মধ্যে খচখচ ভাবটা ছিল এক ধরণের। কারণ তারা নগর র্কীতন করবে, কে কোথায় আছে, কার বাড়ীতে খোল, ঢোল, করতাল আছে, কে কীর্তন লিড দিবে ইত্যাদি। সাধারনতঃ পাড়া পাড়া হিসেবে নগর কীর্তন বের করতো। কোন পাড়ার দলে বেশী সংখ্যক থাকে এবং কোন দল কোন কোন পাড়া, গ্রাম বা মহল্লায় যায়, কত গভীর রাত পর্যন্ত ঘুরে ঘুরে কীর্তন করে এসব ছিল বিচার্য বিষয়। এমন কি প্রতি পাড়া থেকে একাধিক কীর্তন দল (বয়স ভেদে) বের হতো এবং অনেক সময় বয়সের বিবেচনা না করে একসঙ্গে একটি দলই বের হতো। আবার যারা একেবারে ছোট এবং একেবারে বয়োজেষ্ঠরা বাড়ীতে বসেই কীর্তন করে আনন্দ ভাগাভাগি মেটাতো। প্রতি ঘর থেকে কিছু চাল বা টাকা কীর্তন দলকে দেয়া হতো, যা দিয়ে এবং আরো কিছু চাঁদা তুলে বা যারা চাঁদা দিতে না পারতো তারা সমপরিমাণ চাল দিয়ে ঐ দলের ছেলে মেয়েরা সাধারনতঃ নতুন বছরে একসাথে রান্না করে পিকনিক মত করে আনন্দ উপভোগ করতো।
আর বড়দের বা বাবা-মা’দের খচখচানি ছিল টেনশন। টেনশনের কারন ছিল অর্থনৈতিক দূর্দশা। বড়দিন উদযাপন কিভাবে করবে, কোথায় টাকা পাবে, কার জন্য কি দিবে ইত্যাদি। বর্তমানেও কীর্তন হয়। তবে কেন যেন মনে হয় আগের মত এত উৎসাহ উদ্দীপনা নেই, একতা নেই, সবাই যেন কেমন ছাড়া ছাড়া ভাব। কি নিয়ে যেন সবাই ব্যস্ত। এখনও কীর্তন হয় তবে সেটা বেশীর ভাগই ঘরোয়া বা বাড়ী কেন্দ্রিক। সেই সম্মিলিত পাড়ার সব ছেলে-মেয়েদের সবাইকে নিয়ে যেন আর হয় না। সবাই যার যার তার তার হয়ে গেছে। আনন্দগুলো সংকুচিত হয়ে গেছে। মনে হয় বর্তমানে মোবাইল ফোন এর একটা বড় কারন। তা ছাড়াও ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ থাকাতে টেলিভিশনে নানা অনুষ্ঠান দেখা নিয়েও সবাই অনেক ব্যস্ত।
বড়দিনের শুভেচ্ছা বা ক্রিসমাস কার্ড:
তখন বিশেষত গ্রামাঞ্চলে বড়দিনের শুভেচ্ছা জানানোর জন্য রেডিমেড কার্ড তেমন পাওয়া যেত না। তাই বড়দিনের শুভেচ্ছা কার্ড প্রিয়জন, বন্ধুদের, আত্মীয়-স্বজনকে দেয়ার জন্য সাদা কাগজে কলম দিয়ে কিছু এঁকে এবং সুন্দর কথা মালা লিখে দেয়া হতো। আর এর মধ্যে উভয় পক্ষেরই একটা ভিন্ন রকম ভালবাসা ও আন্তরিকতার গন্ধ পাওয়া যেত এবং যিনি পেতেন তিনি কার্ডটি যতœ করে রেখে দিতেন। আর যে আনন্দ উভয়েই প্রকাশ করতো তার তুলনা কিছুতেই হয় না। কেউ কেউ হয়তো কিছু রেডিমেড কার্ড সংগ্রহ করে বন্ধু বান্ধবদের শুভেচ্ছা বিনিময় করতেন; এতেও অবশ্য একটা অন্য রকম অনুভূতি ছিল; কারন কার্ডগুলো তাদের কাছে ছিল একেবারে নতুন এবং ছাপানো। কিন্তু বর্তমানে কার্ড এবং শুভেচ্ছা বিনিময়ের মাধ্যম অনেক সহজ হয়ে গেছে এবং কার্ডও একেবারে হাতের নাগালে। গুগলে সার্চ দিলেই হাজারো রং ও ডিজাইনের কার্ড পাওয়া যায়, সেখান থেকে একটা পছন্দ করে ইমেইলে, ফেসবুকে, হোয়াটসএপে বা কোন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েই দায়িত্ব শেষ করে। কার্ড বা শুভেচ্ছা কেউ দেখলো বা না দেখলো তার কোন হিসেব কেউ রাখে না। কেউ কেউ দেখে হয়তো ফিরতি ম্যাসেজ দেয়; কিন্তু সেটাও উনি দেখলেন কি না দেখলেন তাতে কিছু আসে যায় না। আন্তরিকতা, ভালবাসা ইত্যাদি কেমন যেন হারিয়ে যাচ্ছে। আধুনিকতায় সব চাপা পড়ে যাচ্ছে।
গীর্জঘর ও ঘর-বাড়ী সাজানো:
বড়দিনের সপ্তাহ দুয়েক আগে থেকেই গীর্জাঘর এর চারপাশ পরিষ্কার করা ও সুন্দর করে সাজানোর নানা পরিকল্পনা ও তৎপরতা যুবকদের মধ্যে পরিলক্ষিত হত। গীজাঘর ধোয়া, মোছা, কাগজ কেটে সাজানো নিয়ে খুব ব্যতিব্যস্ত। কে কাগজ কেনা টাকা দিবে, কোথায় টাকা পাবে, কাগজ দেয়া কারো মানত আছে কিনা তা নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই কাটেখিষ্ট মহোদয়ের কাছে খোঁজ-খবর নেয়া। তখন এখনকার মত রেডিমেড ঝলম, নিশান, জরি ইত্যাদি পাওয়া যেত না। যা করার রঙিন কাগজ কিনে কাঁচি, এক ধরণের বাঁকানো বাটালি দিয়ে সময় নিয়ে কেটে কেটে বানানো হতো। ঝলমের জন্য কে ভাল আর্ট করতে পারে তার কাছেও কয়েকদিন ঘোরা লাগত। তারপর প্রচলিত সুতলি তে (রঙিন সুতাও নয়) নির্দিষ্ট দূরত্বে এবং রং ধারাবহিকভাবে মিলিয়ে আটায় তৈরী আঠা দিয়ে লাগানো হতো এবং পরে গীর্জঘরের ভেতওে লাগিয়ে দেয়া হতো। যদি কিছু নিশান বেশী হতো তবে বাহিরে লাগানো হতো নচেৎ নয়। কিন্তু বর্তমানে এ সবের কোন বালাই নাই, এত কষ্টেরও কোন বালাই নাই। সবই বাজারে/মার্কেটে রেডিমেড পাওয়া যায়। কিনে এনে লাগিয়ে দিলেই হয়। তবে পার্থক্য হলো আগে ঐ গুলো করার মধ্যে একটা বিশুদ্ধ আনন্দ ছিল, কাজের স্পৃহা ছিল। কিন্তু এখন নিজ হাতে করে একটি সুন্দরকে ফুটিয়ে তোলার সে আনন্দ আর নাই। খুব সহজেই কাজগুলো হয়ে যায়। কারন সারাদিন কাজ করে, না খেয়ে থেকে বিকেল বা সন্ধ্যা বেলা দোকান থেকে এক প্যাকেট নাবিস্কো বিস্কুট বা একপোয়া মুড়ি কিনে এনে সবাই মিলে এক পাত্রে খাওয়ার যে আনন্দ তা এখন আর নেই। উপাসনার শেষে যখন পুরোহিত বা কাটেখিষ্ট ঘোষণা করতেন যে, অমুক অমুক গীর্জাগর সাজিয়েছে, তখন সে স্বীকৃতিতে বুক ভরে যেত।
পোষাক পরিচ্ছদ:
দেশের অর্থনীতি পরিবর্তনের সাথে অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়ে যায়। এখন থেকে কয়েক দশক আগে দেশের অর্থনীতি খুবই দূর্বল ছিল; বিশেষতঃ গ্রামাঞ্চলে। তখন মানুষ দু’বেলা খেতেই পারতো না। তারপর আবার বিশেষ কোন উৎসব! তাই যারা ছোট তাদের সর্বাগ্রে খুশী করার জন্য বাবা মা খুব চিন্তিত থাকতেন। কোন রকম একটা নতুন পোষাক পেলেই আমরা খুশী থাকতাম। একটার বেশী পোষাক অধিকাংশ সময়ই ছেলেমেয়েদের দিতে পারতেন না। কিন্ত তাতেই ছেলেমেয়েরা খুব খুশী হতেন। মা’য়েদের বড়দিনের আগের দিন স্থানীয় কারিকরদের (নিজেদের বোনা) নিকট হতে বাকিতে নিয়ে দিত; অবশ্য এমনটা হতো অর্থনৈতিক দৈনতায়। আর সাজগোঁজ তো ছিল একেবারেই সাধারণ। কোন কৃত্রিমতার ছোঁয়া ছিল না। হয়তো একটা হালকা পাউডার; দু’গাছি চুড়ি, পায়ে একটু আলতা। কিন্ত বর্তমানে পোষাকের বাহার, একটা নয় কয়েকটা না কিনলে তো মনই ভরে না। আর সাজগোজ তো সর্বাধুনিক। মেয়ে মহিলারা তো বিউটি পার্লারে গিয়ে নানা সাজে সেজে আসে। নিজেকে অন্যভাবে প্রকাশ করতে চায়। শাড়ী কে কত দাম দিয়ে কিনলো তার উপর তাদের সামাজিক ষ্টাটাস নির্ভর করে।
প্রেমভোজ:
বড়দিনে প্রেমভোজ ছিল একটি কমন বিষয়। প্রেমভোজের জন্য পরিবারের সদস্য অনুযায়ী চাঁদা ও চাল সংগ্রহ করে সবাই একসাথে বড়দিনের দিন খাওয়া দাওয়া করতো। অবশ্য প্রেমভোজটা যে খুব সহজেই ব্যবস্থা করা যেত তা না। কারন সারাবছরে কারো কারো সাথে একটু মনোমালিন্য হলেই বলতো যে প্রেমভোজে অংশ নিবে না। কিন্তু প্রেমভোজতো সকলকে নিয়ে। তাই যাদের সাথে মনোমালিন্য তা মিটানোর জন্য আবার বসত আলাদা বৈঠক। সেখানে উভয় পক্ষকে মিলিয়ে দেয়া হতো। আবার এমনও পরিবার ছিল যে, যাদের চাঁদা দেয়ার মত সামর্থ্য থাকতো না। তাই তাদের জন্য কেউ কেউ (যাদের সামর্থ্য আছে) দিয়ে দিত অথবা চার্চ বা মন্ডলী তাদের নিজস্ব ফান্ড থেকে ব্যবস্থা করতো। এভাবে সবাই মিলে বড়দিনের দিন ধর্মীয় উপাসনা শেষ করার পর প্রেমভোজে অংশ নিত। সকলে একসঙ্গে লম্বা লাইনে বসে খেত এবং সকলের চোখে মুখে একটা অদ্ভুত আনন্দ পরিলক্ষ্যিত হতো। বর্তমানে কোথায় কোথায় প্রেমভোজ ব্যবস্থা বহমান আছে। তবে এখন সকলে মিলে প্রেমভোজ করার পরিবর্তে পারিবারিক দাওয়াত ও খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। নিজের আত্মীয় স্বজনকে ডেকে তাদের নিয়েই খাওয়া দাওয়া করা হয়। অবশ্য এগুলো পেছনে অর্থনৈতিক উন্নয়ন একটা অন্যতম কারন। তবে আগেই বলেছি প্রেমভোজ এখনো অনেক এলাকায় বা চার্চে (মন্ডলীতে) প্রচলিত আছে এবং চেষ্টা করা হচ্ছে এই ঐতিহ্য বজায় রাখতে।
মেলা:
বড়দিনে প্রতিটি স্থানেই মেলার (অস্থায়ী) আয়োজন থাকতো এবং এখনো আছে। মেলাগুলো সকাল থেকে শুরু হয়ে রাত অবধি চলে। মেলায় বেশী বিক্রি হতো মিষ্টি, জিলাপি, শিশুদের খেলনা, পান ইত্যাদি। অধিকাংশ পরিবারই মেলায় গিয়ে কমবেশী মিষ্টি নিয়ে আসে এবং আত্মীয়দের বাসায়ও পাঠায়। আবার কিছু মেলা বড়দিন পরবর্তী নতুন বছর (১ জানুয়ারি) পর্যন্ত একটানা চলে। একটি বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, বড়দিন খ্রীষ্ট ধর্মের উৎসব হলেও আশে পাশের সকল ধর্মের জনগণ এমন ভাবে মিশে যায় যে কারো বোঝার কোন সাধ্য নেই কে খ্রীষ্টান, কে হিন্দু বা কে মুসলমান। ধর্মীয় সম্প্রীতির এক বিরাট উদাহরন হয়ে আছে এই বড়দিন উৎসবে।
দেশভেদে, জাতি-উপজাতি ভেদে, এলকা ভেদে বড়দিন উৎসব উদযাপনের পার্থক্য আছে এবং থাকবে। রীতিনীতিতে পরিবর্তন হবে সময়ের ব্যবধানে, অর্থনৈতিক উন্নয়নে এবং নতুন নতুন উদ্ভাবনে ও মানসিকতার পরিবর্তনে। পরিবর্তনগুলো চাই বা না চাই কালের বিবর্তনে হবেই। এগুলো মেনে নিয়ে বড়দিনের প্রকৃত তাৎপর্য, খারাপ পথ ও কাজ পরিহার করা, মানুষকে ভালবাসা, ঈশ^রের নির্দেশিত পথে চলা এবং প্রকৃত আধ্যত্মিকতা বজায় রাখাই প্রকৃত বড়দিন। বাহ্যিক পরিবর্তনগুলোকে মেনে নিয়ে আধ্যাত্মিকতা ধারণ করে যীশুর পথে চলাই বড়দিন। বড়দিন সবার জন্য সুখ, শান্তি ও আনন্দ বয়ে আনুক এ কামনা করি। সবাইকে শুভ বড়দিন।
লেখক : সমাজকর্মী।