কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে ১৭০ হাড়ের তিমির কঙ্কাল

তারেকুর রহমান: বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটে দায়িত্বরত ৬ জনের একটি টিম তিমির কঙ্কাল সংগ্রহের জন্য ছুটে যান কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে। মাংসসহ পুঁতে ফেলার ২ বছর ৯ মাস পর ১৭০ হাড়ের কঙ্কাল উত্তোলন করেন তারা। এটি ছিলো প্রজাতি হিসেবে ব্রাইড’স হোয়েল।

তিমিটি ২০২১ সালে ১০ এপ্রিলে মুখের একটি হাড় ছাড়া ভেসে আসে। এর ওজন ছিল প্রায় ৯ মেট্রিক টন, দৈর্ঘ্য ৪৬ ফুট ও প্রস্থ ১৬ ফুট। গভীর বঙ্গোপসাগরে তিমিটির মৃত্যু হওয়ায় শরীরের বিভিন্ন অংশ পচে বিকৃত হয়ে গিয়েছিলো।

সেই সময়ে পুঁতে ফেলা তিমিটির ১৭০টি হাড় সংগ্রহ করে তিমির আদলে কঙ্কালটি সাজিয়ে দর্শণার্থী ও গবেষণা কাজের জন্য সংরক্ষণ করছে বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট। প্রতিষ্ঠানটির আওতায় মেরিন অ্যাকুরিয়াম স্থাপন করা হলে সেখানে ওই কঙ্কালটি স্থানান্তর করা হবে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

শনিবার (২৭ জানুয়ারি) সরেজমিনে বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের ক্যাম্পাসে গিয়ে দেখা যায়, ওই প্রতিষ্ঠানের ভূ-তাত্ত্বিক ওশানোগ্রাফি বিভাগের প্রধান ও জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. জাকারিয়ার নেতৃত্বে ৬ জনের একটি টিম হাড়গুলো নির্দিষ্ট একটি জায়গায় সাজিয়ে রাখার কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন।

টিমের সদস্যরা হলেন, মো. হানিফ বিশ্বাস, মো. নাজমুল হোসেন, মো. হারুনর রশীদ, রবিন কুমার দাশ, মো. রিপন মিয়া, আব্দুল্লাহ আল মামুন। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে তিমির হাড়গুলো একে একে মাটির নিচ থেকে তোলা হয়।

জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. জাকারিয়া বলেন, তিমিটি মারা যাওয়ার পর দীর্ঘদিন পানিতে ভাসতে থাকায় মুখের অংশের একটি হাড় শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পুঁতে ফেলার দুই বছর পর তিমির হাড় উত্তোলন করতে যাই আমরা। একে একে ১৭০টি হাড় তুলে সেগুলো জোড়া দিয়ে কঙ্কাল তৈরির জন্য একটি বিশেষজ্ঞ দল গঠন করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞ দলের সদস্যরা হাড় জোড়া দিয়ে এর পূর্ণাঙ্গ রূপ দেবেন। বিশেষ করে গবেষণা কাজের জন্য এই কঙ্কাল সংরক্ষণ করা হবে। পাশাপাশি দর্শনার্থীরাও দেখতে পাবেন।

তিনি বলেন, আমরা ইতোমধ্যে তিমিটির মুখের একটি হাড় ছাড়া ১৭০টি হাড় সংগ্রহ করেছি। গবেষণা করে দেখেছি ব্রাইড’স হোয়েল প্রজাতির তিমির ১৭৭ থেকে ১৮৫টি হাড় থাকতে পারে। তিন থেকে চার প্রজাতির তিমি রয়েছে। তবে কোন প্রজাতির তিমির হাড় কয়টা তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা নেই। যেহেতু ১৭০টি হাড়ের মধ্যে এই ব্রাইড’স হোয়েল প্রজাতির রূপ চলে এসেছে সুতরাং আমরা রেফারেন্স হিসেবে এ তথ্য ব্যবহার করতে পারি।

তিনি আরও বলেন, দেশি-বিদেশি গবেষক ও শিক্ষার্থীদের এটি দেখানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কয়েকদিনের মধ্যে এটি পূর্ণাঙ্গভাবে স্থাপনের কাজ শুরু হবে।

অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে কঙ্কাল উত্তোলন টিমের সদস্য মো. নাজমুল হোসেন বলেন, ‘জীবনে প্রথম এতো বড় কঙ্কাল আমি দেখেছি। এর হাড়গুলো খুঁজতে গিয়ে খুবই কৌতুহলী ছিলাম। খু্ঁজে পাওয়া হাড়গুলো একটি একটি করে জোড়া লাগাই। কঙ্কাল যতো বড় হয় ততো আমরা উৎফুল্ল হই। অবশেষে চার দিনের কঠোর পরিশ্রমে সব হাড় মাটি থেকে তুলে আনতে সক্ষম হই।’

মো. হারুনর রশীদ বলেন, ‘আমাদের টিম লিডারের মাধ্যমে লোকেশনটা পেয়ে আমরা মাটি খুঁড়তে শুরু করি। প্রথমে কঙ্কাল না পেয়ে হতাশ ছিলাম। পরে খুঁজে পেয়ে মহাখুশি। দুর্গন্ধ ছিলো তারপরও একটা একটা করে সব হাড় সংগ্রহ করি।’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য (একাডেমিক) বেনু কুমার দে বলেন, ‘সাগরের তিমিগুলো কোন অবস্থায় আছে, কী খাচ্ছে- এগুলোর উপর অনেক গবেষণা রয়েছে। তিমিগুলো যে প্লাস্টিক হজম করছে সে প্লাস্টিকগুলো আমরা খাচ্ছি। যা ক্যান্সারের একটি বড় উৎস। তাই এই তিমি নিয়ে শিক্ষার্থীরা অনেক গবেষণা করবে, এতে তাদের অনেক উপকার হবে। এরকম আমাদের অনেক ইকুইটিক অ্যানিমেল ও প্লান্ট আছে। এগুলো নিয়ে বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট গবেষণা করবে। একদিন এই প্রতিষ্ঠান আমাদের আলোকবর্তিকা হয়ে দাঁড়াবে। আমরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় তাদের পাশে আছি।’

তিনি বলেন, ‘সাগরের বুকে অপার সম্ভাবনা এবং অনেক সম্পদ লুকিয়ে আছে। আমরা সেগুলো নিশ্চিতকরণ করবো। এবং পরিমাণ নির্ধারণ করে যৌক্তিক ব্যবহারের মাধ্যমে আমাদের দেশকে সমৃদ্ধ করবো। এটি ছিলো বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন।’

গভীর সমুদ্রে জাহাজের মেশিন পাখায়, জালে আটকে কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে তিমির মৃত্যু হয় বলে ধারণা করা হয়।

বিগত কয়েক বছরে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে মৃত তিমি ভেসে আসে। তন্মধ্যে ২০২১ সালের ৩ মে টেকনাফ সমুদ্রসৈকতে প্রায় সাড়ে ৪ মেট্রিক টন ওজনের একটি তিমি ভেসে এসেছিলো। এরপর ২০২১ সালের ৯ ও ১০ এপ্রিল কক্সবাজার শহর থেকে অদূরে দরিয়ানগর ও হিমছড়ি সৈকতে প্রায় ৯ ও ১০ মেট্রিক টন ওজনের দুটি মৃত তিমি ভেসে আসে। তিমিগুলো বালুচরে পুঁতে ফেলা হয়েছিলো।

Print Friendly

Related Posts