একুশে পদকপ্রাপ্ত ভাষাসৈনিক বাচ্চু ডাক্তার

আজমাল হোসেন মামুন

mmm

বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম সফল ব্যক্তিত্ব হিসাবে চির স্মরণীয় হয়ে আছেন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, চিকিৎসক, সমাজসেবক, মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও ভাষাসৈনিক ডা. আ. আ. এ. মেসবাহুল হক (বাচ্চু ডাক্তার)। চাঁপাইনবাবগঞ্জের এমন কোন মানুষ নেই যিনি বাচ্চু ডাক্তার নামটি শুনেননি। আজ ৩ মার্চ তার ৯০তম জন্মবার্ষিকী।

তাঁর সুদীর্ঘ ৭৯ বছরের জীবনে প্রধানত তিনটি ক্ষেত্রে বিচরণ করেছেন। রাজনীতি, চিকিৎসা ও সমাজকল্যাণমূলক কাজ। এই তিনটি ক্ষেত্রেই তিনি সাফল্য পেয়েছিলেন এবং নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন দেশ ও জাতির কাছে একজন আদর্শ ব্যক্তি হিসাবে। অমায়িক ব্যবহার, দেশপ্রেম, কর্তব্যনিষ্ঠা, কঠোর পরিশ্রম আর সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন ছিল তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। আর এ কারণেই তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে সকলের শ্রদ্ধা অর্জনে সমর্থ হয়েছিলেন। তিনি দেশ ও জাতির কল্যাণে আজীবন নিঃস্বার্থভাবে কাজ করেছেন বলে আজ জাতীয়ভাবে সুপরিচিত মুখ।

তিনি রাজশাহী বিভাগের সীমান্তবর্তী চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ঐতিহ্যবাহী বালিয়াডাঙ্গা গ্রামে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দেরর ৩ মার্চ এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পেশায় একজন চিকিৎসক হলেও তিনি দেশের মানুষের কাছে সৎ ও দূরদর্শী রাজনীতিবিদ হিসাবেই পরিচিত মুখ। তাঁর পিতার নাম হাজী মোঃ মুনিরউদ্দিন এবং মাতার নাম গোল আরজান নেশা।

ডা. আ. আ. ম. মেসবাহুল হক ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। তিনি ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে রাজশাহী কলেজ থেকে আইএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন।ছাত্রাবস্থায় আ. আ. ম. মেসবাহুল হক (বাচ্চু ডাক্তার) তৎকালীন রাজশাহী কলেজে মহান ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। তিনি সহ অন্যান্য ছাত্ররা ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের কাছে স্মারকলিপি প্রদান করেন বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য। সে সময় প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে ডিপুটেশন প্রদানের কথিত অপরাধে মেহবাহুল হকসহ ১৬ জন ছাত্রকে কলেজ কর্তৃপক্ষ রাজশাহী কলেজ থেকে বহিস্কার করেন। পরবর্তীকালে তিনি রাজশাহী মেডিকেল স্কুলে ভর্তি হন।

এছাড়াও ভাষা আন্দোলনের সাথে জড়িত থাকায় কথিত অপরাধে ১৯৫৪ সালে রাজশাহীতে ৪০জন ছাত্রনেতার সাথে সেই সময়কার দাপটে ছাত্রনেতা ডা. আ.আ. ম. মেসবাহুল হক (বাচ্চু ডাক্তার)ও কারাবরণ করেন।

তৎকালীন রাজশাহী মেডিক্যাল স্কুল (বর্তমানে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ) থেকে ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে এলএমএফ ডিগ্রী অর্জন করেন। পরবর্তীকালে চিকিৎসক হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন এ বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও সমাজসেবক। তিনি ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দের ২১ মার্চ মাসুদা হকের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ৩ ছেলে ও ২ মেয়েসহ মোট ৫ সন্তানের জনক ছিলেন। তাঁর মেয়ে ফেরদৌসী ইসলাম জেসী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মহিলা আসন-৩৩৮ থেকে এবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। এছাড়াও বর্তমানে তাঁর এক সুযোগ্য পুত্র মেসবাহুল শাকের জ্যোতি আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় রয়েছে।

এ ক্ষণজন্মা রাজনীতিবিদ ও সমাজসেবকের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার উন্নয়নে প্রতিটি ক্ষেত্রেই অবদান রয়েছে।তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর একান্ত সহচর।

১৯৭০ প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে (১৯৭১-১৯৭২) গণপরিষদের সদস্য হিসেবেও সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে প্রথম হস্তলিখিত সংবিধানে স্বাক্ষরকারীদের একজন তিনি। ১৯৭৩ সালের জাতীয় নির্বাচনে তিনি জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার গভর্ণর নিযুক্ত করেন। এছাড়াও তিনি (বাচ্চু ডাক্তার) বিভিন্ন মেয়াদে ১৩ বছর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সফলতার সঙ্গে দলকে নেতৃত্ব দেন। তিনি এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের জন্য কারাবরণ করেন। রাজনীতিক জীবনে তিনি ছিলেন আপোসহীন, নির্ভীক ও বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ সহচর। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের অসহযোগ আন্দোলন ও ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দের অসহযোগ আন্দোলনে সরাসরি সম্পৃক্ত থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।

ডা. আ.আ. ম. মেসবাহু হক (বাচ্চু ডাক্তার) ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দান করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকে সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য চাপাইনবাবগঞ্জে ৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করা হয়। যার অন্যতম সদস্য ছিলেন ডা. আ.আ. ম. মেসবাহুল হক (বাচ্চু ডাক্তার)।

মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য ১৯৭১ সালে মালদহে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে সেখানকার জোনাল অফিসের সহকারী চেয়ারম্যান হিসাবে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন ডা. আ.আ. ম. মেসবাহুল হক (বাচ্চু ডাক্তার)। তিনি সেখানে গৌড় বাগান প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ইনচার্জ ছিলেন।

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠার গৌরবময় অবদানের জন্য ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে আজীবন সম্মাননা পদক প্রদান করেন। এ নেতার স্মৃতিকে চির অম্লান করে রাখার জন্য ২০১১ খ্রিস্টাব্দে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নবনির্মিত স্টেডিয়ামটি ডা. আ.আ. ম. মেসবাহুল হক (বাচ্চু ডাক্তার) স্টেডিয়াম নামে নামকরণ করা হয়। এছাড়াও চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর হাসপাতাল সংলগ্ন রাস্তাটির নাম আ. আ. ম. মেসবাহুল হক (বাচ্চু ডাক্তার) সড়ক নামকরণ করেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভা কর্তৃপক্ষ।

ভাষা সৈনিক, মুক্তিযোদ্ধা, সৎ ও যোগ্য রাজনীতিবিদ ডা. আ. আ. ম. মেসবাহুল হক (বাচ্চু ডাক্তার) চাঁপাইনবাবগঞ্জ রেডক্রিসেন্ট সমিতি, ডায়াবেটিক সমিতি, হার্ট ফাউন্ডেশন, অন্ধকল্যাণ সমিতি, রোগী কল্যাণ সমিতি, সরকারি হরিমাহোন স্কুল প্রাক্তন ছাত্র সমিতি, পদ্মানদী ভাঙ্গন প্রতিরোধ কমিটি, চিকিৎসক পরিষদ প্রতিষ্ঠা এবং পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি নবাবগঞ্জ সরকারি কলেজ, নবাবগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজ, শিশু শিক্ষা নিকেতন, নবাবগঞ্জ জেলা স্কুল, বালিয়াডাঙ্গা ফাযিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসা, নবাবগঞ্জ কামিল মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বিভিন্ন মেয়াদে এসব প্রতিষ্ঠানের সাধারণ সম্পাদক, সহ-সভাপতি, সভাপতি এবং কার্যকরী সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মরহুম বাচ্চু ডাক্তার ৬০ এর দশকে নবাবগঞ্জ মহকুমা ক্রীড়া সংস্থার নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন ছাড়াও মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত নির্বাচিত সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করে গেছেন। তিনি নির্বাচিত সহ-সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক বা সদস্য হিসাবে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা ক্রীড়া সংস্থা পরিচালনার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শকে লালন তথা বুকে ধারণ করে দলীয় নেতা-কর্মীসহ চাঁপাইনবাবগঞ্জের মানুষের কল্যাণে রাজনীতি করেছেন বলে চিরস্মরণীয়।

ডা. আ আ ম মেসবাহুল হক (বাচ্চু ডাক্তার) ২০০৯ খ্রিস্টাব্দের ১৬ জানুয়ারী মৃত্যুবরণ করেন। ভাষাসৈনিক, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, সমাজসেবক ও রাজনীতিবিদ ডা. আ. আ. ম. মেসবাহুল হক (বাচ্চু ডাক্তার) কে মহান মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার ২০২০ খ্রিস্টাব্দে একুশে পদক ( মরণোত্তর) প্রদান করেন।

লেখক: শিক্ষক  হরিমোহন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, চাঁপাইনবাবগঞ্জ

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts