খাদ্য অধিকার আইন॥ ‍একশন ‍এইড

খাদ্য প্রত্যেক মানুষের প্রধানতম অধিকার। মানুষের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার পূর্বশর্তই হচ্ছে তার খাদ্যের অধিকার পূরণ করা। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার প্রতিবেদন অনুসারে বর্তমানে বিশ্বের ৯২.৫ কোটি মানুষ পর্যাপ্ত খাদ্যাভাবে আছে; আর এর ৩৬ শতাংশেরই বসবাস দণি এশিয়ায়। অপ্রকাশ্য ুধা, পুষ্টিহীনতা, খাদ্য অপচয় এবং অনিরাপদ খাদ্যÑ এসব বিবেচনায় নিলে খাদ্য অনিরাপত্তার প্রকৃত চিত্র আরো ভয়াবহ। সম্প্রতি প্রকাশিত ‘বিশ^ খাদ্য নিরাপত্তা সূচক ২০১৫’ অনুসারে বিশে^র ১০৯টি দেশের মধ্যে খাদ্য নিরাপত্তার দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৯তম। এেেত্র দণি এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান সর্বনিম্নে এবং এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ২২টি দেশের মধ্যে ২১তম। অথচ হাঙ্গার অ্যান্ড নিউট্রিশন কমিটমেন্ট  ইনডেক্স (হানসি) ২০১৪-এর সূচকে ক্ষুধা হ্রাসে রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি বিবেচনায় ৪৫টি উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬ থেকে ১৪ তে উন্নীত হয়েছে। এদিকে দানাদার খাদ্য শস্যের উৎপাদন বিগত বছরগুলোতে বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু সার্বিক বিবেচনায় রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি বাড়লেও খাদ্য নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি।

জনসংখ্যা অনুপাতে আবাদি জমির পরিমান হ্রাস, খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি, অপর্যাপ্ত কৃষিসেবা, অপরিকল্পিত নগরায়ন, খাদ্য সংরণাগার ও টেকসই কৃষিচর্চার অভাব, কৃষিতে বাণিজ্যিক আগ্রাসন এবং জলবায়ুর পরিবর্তন বাংলাদেশে খাদ্য সঙ্কট অনেকাংশে বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা প্রতিবেদন ২০১১ অনুযায়ী খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি বাংলাদেশের খাদ্য ঝুঁকির মূল কারণ, যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তা পরিস্থিতি অনিশ্চিত অবস্থায় রেখেছে। আয়-উপার্জনে ন্যায্যতা অর্জন ও জলবায়ু সহনশীল স্থায়িত্বশীল কৃষি প্রসারের  মাধ্যমে দেশের দারিদ্র্যপীড়িত জনগোষ্ঠীর খাদ্য অধিকার নিশ্চিত করা তাই সময়ের দাবি। এজন্য প্রয়োজন একটি আইনি কাঠামো, যা সকল মানুষের খাদ্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে যথাযথ দায়-দায়িত্বের দিক নির্দেশনা দিবে।

জীবনের অধিকার এবং খাদ্য ও কাজের অধিকার
সাংবিধানিকভাবে খাদ্যের অধিকার অর্জন এবং জনগণের পুষ্টিমান উন্নয়নে বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাছাড়া বাংলাদেশ বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সদস্য এবং ভিয়েনা ঘোষণা ১৯৯৩, ইকোসক-সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তিতে সমর্থন প্রদান করেছে। জাতিসংঘ সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের অনুচ্ছেদ ২৫(১) ধারা অনুযায়ী ‘প্রত্যেক ব্যক্তির নিজের এবং তার পরিবারের কল্যাণ ও সুস্বাস্থের জন্য খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও প্রয়োজনীয় সেবাসহ জীবনযাত্রার পর্যাপ্ত মানের অধিকার রয়েছে এবং বেকারত্ব, অসুস্থতা, অক্ষমতা, বৈধব্য, বার্ধক্য অথবা তার আয়ত্তের বাইরে অন্য কোন কারণে জীবিকা অর্জনে অপারগ হলে নিরাপত্তা লাভের অধিকার রয়েছে।’ এছাড়া খাদ্য অধিকারকে মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে প্রচার এবং তা রাষ্ট্রীয় নীতিতে সন্নিবেশনের জন্য বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ভলান্টারি গাইডলাইন প্রণয়ন করা হয়েছে।

সম্প্রতি জাতিসংঘে গৃহীত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি)-এর দ্বিতীয় লক্ষ্য হলো, ক্ষুধার সমাপ্তি, খাদ্য নিরাপত্তা ও উন্নততর পুষ্টি অর্জন এবং টেকসই কৃষি প্রবর্তন। এছাড়া লক্ষ্য ৩-এর  আওতায় সবার জন্য স্বাস্থ্যকর জীবন, লক্ষ্য ৬-এর আওতায় পানীয় জলের সরবরাহ, লক্ষ্য ১০-এ আভ্যন্তরীণ অসমতা দূরীকরণ, লক্ষ্য ১২-তে টেকসই উৎপাদন ও ভোগ, লক্ষ্য ১৫-তে স্থলজ প্রতিবেশ ও বন সংরক্ষণ এবং লক্ষ্য ১৬-তে জবাবদিহিতা ও অন্তর্ভূক্তিমূলক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে। এ দলিলে ২০৩০ সালের মধ্যে সব ধরনের ক্ষুধা নির্মূল করা, অপুষ্টি দূর করা, প্রাকৃতিক সম্পদসহ সব সম্পদে ক্ষুদ্র কৃষকদের ন্যায্য প্রবেশাধিকার দেয়া, কর্মসংস্থান ও আয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানেও খাদ্যকে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির মধ্যে রাখা হলেও তা আদালত দ্বারা বলবৎযোগ্য নয়।

খাদ্য অধিকার নিশ্চিতকরণে বাংলাদেশে কোনো আইনি কাঠামো না থাকায় ুধা ও দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের কোন জায়গায় আবেদন-নিবেদন বা দাবি করার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু ইতোমধ্যে আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া, ব্রাজিল, ইক্যুয়েডর, এল সালভেদর, গুয়াতেমালা, হন্ডুরাস, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, মেক্সিকো, মোজাম্বিক, নিকারাগুয়া, প্যারাগুয়ে, পেরু, দক্ষিণ আফ্রিকা, তানজানিয়া, উগান্ডা ও ভেনেজুয়েলায় খাদ্য অধিকার আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের কৃষিঋণ, কর্মসৃজন কর্মসূচি, দুঃস্থভাতাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি ও নীতিমালা রয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে জাতীয় বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বরাদ্দ বাড়লেও, কৃষিতে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ হ্রাস পাওয়ায় ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের উপর তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। উদ্বেগের বিষয় যে ৭ম পঞ্চ-বার্ষিকী পরিকল্পনায় (২০১৫/১৬-২০১৯/২০) কৃষি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ও রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ যথেষ্ট রক্ষণশীল উপায়ে নির্ধারণ করা হয়েছে। সুতরাং সার্বিক পরিস্থিতি ও নীতি কাঠামোতে পরিবর্তন আনতে খাদ্য অধিকার বিষয়ক একটি আইনি কাঠামো বা লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অবশ্যাম্ভাবী হয়ে পড়েছে।

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত দক্ষিণ এশীয় খাদ্য অধিকার সম্মেলনে (২০১৫) মাননীয় প্রধানমন্ত্রী খাদ্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় তার সরকারের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি ও উল্লেখিত প্রেক্ষাপট ও আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার বিবেচনায় খাদ্য অধিকার আইন প্রণয়ন এখন একটি প্রধানতম রাজনৈতিক অগ্রাধিকার হিসেবে সরকারকে বিবেচনায় নেওয়া উচিত। এ বিষয়ে নি¤œলিখিত সুপারিশগুলো বিশেষ বিবেচনায় নিতে হবে।

সুপারিশ
১.    খাদ্য অধিকারকে সকল নাগরিকের মৌলিক অধিকার হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেয়া। এই ‘অধিকার’ সংশ্লিষ্ট আইন ও নীতিমালা দ্বারা সংরতি করা। এ আইনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে খাদ্য-সংশ্লিষ্ট অন্যান্য আইনগুলোও প্রণয়ন ও সংশোধন করা।
২.    সুষম ও নিরাপদ খাদ্যের আলোকে খাদ্যের সুস্পষ্ট সংজ্ঞা নির্ধারণ করা। ওষুধভিত্তিক পুষ্টির পরিবর্তে খাদ্যভিত্তিক পুষ্টির ওপর জোর দেয়া। পুষ্টি বিষয়ে পারিবারিক জ্ঞান ও ধারণার বিকাশ করা।
৩.    ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজের অধিকার ও ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা। এ জন্য প্রয়োজনীয় নীতিকাঠামোর সংস্কার করা। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে জনগণের অগ্রাধিকার ও সিদ্ধান্ত বিবেচনায় নেয়া।
৪.    কৃষি নীতিমালায় বর্গাচাষিসহ সকল কৃষক ও কৃষিশ্রমিকের সুস্পষ্ট সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা দেয়া। পাশাপাশি বিদ্যমান কৃষক-সমবায়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে সংশ্লিষ্ট সরকারি পরিসেবা নিশ্চিত করা। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল কৃষকের জন্য কৃষি সম্প্রসারণ সেবায় স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করে নীতিমালা প্রণয়ন করা।
৫.    কৃষকের অধিকার ও কৃষি সংক্রান্ত যে কোন দুর্ঘটনা, কৃষকদের ভোগান্তির দ্রুত প্রতিকার ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ‘কৃষি আদালত’ গঠন করা।
৬.    নারী কৃষকদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান করা। কৃষি নীতিমালায় নারী কৃষকদের কৃষি উপকরণ ও জামানতবিহীন ঋণ প্রদান সম্পর্কে সুস্পষ্ট বিধান এবং নারীবান্ধব কৃষি-গবেষণা নিশ্চিত করা। খাসজমি বিতরণসহ ভূমি ও কৃষি বিষয়ক অন্যান্য সম্পদে নারী কৃষকদের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার জন্য আনুষঙ্গিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
৭.    কৃষিজমি, বনভূমি, জলমহাল ও ঐতিহ্য সুরক্ষায় যুগোপযোগী ভূমি ব্যবহার আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা।
৮.    স্থানীয় বীজ ও প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা ও সংরক্ষণ করে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় টেকসই ও যুগোপযোগী কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলা। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ফসলের ক্ষতির কারণে কৃষকের ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা।
৯.    আদিবাসী কৃষক ও লোকজ কৃষি উন্নয়নে কার্যকরী কর্মসূচি প্রণয়ন করা। ফসলের ধরন, উৎপাদন পদ্ধতি ও কৌশল নির্ধারণ করার ক্ষমতা পুরোপুরি কৃষকের হাতেই ন্যস্ত করা এবং ফসলের বৈচিত্র্য বজায় রাখা।
১০.    চিংড়িচাষসহ বাণিজ্যিক কৃষির ফলে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের বাণিজ্যিক কৃষির মুনাফা থেকে ক্ষতিপূরণ  দেয়া। প্রচলিত উন্নয়ন মডেল ও বাণিজ্যিক আগ্রাসণের কারণে কৃষি থেকে বিচ্যূত যুবকৃষকদের কৃষির মূলধারায় ফিরিয়ে আনার জন্য সহায়তা প্রদান করা।
১১.    কৃষককেন্দ্রিক ও দায়বদ্ধ ভ্যালু-চেইন সৃষ্টিতে সরকারের কার্যকরী ভূমিকা রাখা। লাভজনক মূল্য নিশ্চিত করার জন্য উৎপাদিত কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণে রাষ্ট্রীয় প্রণোদনা নিশ্চিত করা।
১২.    কৃষিক্ষেত্রে নিয়োজিত শ্রমিকদের শ্রম অধিকার নিশ্চিত করাসহ ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার দেয়া।

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts