নিয়ন মতিয়ুল
সমসাময়িক কিছু ঘটনা বুদবুদের মতো। নানা ঘাত-প্রতিঘাত, মত-দ্বিমত, আলোচনা-সমালোচনা আর বিতর্কের মধ্য দিয়ে তার প্রশমন ঘটে। তাই সেসব নিয়ে কথা বলার ইচ্ছেই হয় না। তবে সেসব ঘটনার সঙ্গে অতিঘনিষ্টভাবে সম্পর্কিত ‘অতিরাজনীতি’ বা ‘অতিরাজনীতিকরণ’ নিয়ে বলা বা লেখা এখন সময়ের দাবি। রাজনীতি যে আর তার ‘ঐতিহ্যের ফর্মে’ নেই তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
‘ঐতিহ্যের ফর্ম’ বলতে ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসন আর জাতিগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রায় শতবছর ধরে গড়ে ওঠা সমন্বিত রাজনৈতিক শক্তিকে (পলিটিকেল ফোর্স) বুঝে নিতে পারা যায়। বিস্ময়কর হলেও সত্য, যে ‘ফোর্স’ আমাদের পরম কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা এনে দিয়েছে, জাতির মুক্তি ঘটিয়েছে পরাধীনতা থেকে- নতুন প্রজন্মকে তা কোনোভাবেই আকৃষ্ট করতে পারছে না। রাজনৈতিক ফোর্স আর তার প্রয়োগকারীদের কোনোভাবেই পড়তে পারছে না তরুণরা। বিশেষভাবে বললে, আত্মস্থ করতে পারছে না। রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রতি তাই এক ধরনের উদাসীনতা তৈরি হয়েছে এ প্রজন্মের।
বিষয়টা উদ্বেগজনক হলেও এক্ষেত্রে রাজনৈতিক নির্লিপ্ততা দৃশ্যমান। তারচে বরং রাজনীতির সোনালি ঐতিহ্যের ‘আফিমে’ ডুবে বর্তমানকে ভুলে থাকার আত্মতৃপ্তির মাত্রা প্রবলরকম। নতুন প্রজন্মের আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ হয়ে ওঠা সমাজকে বদলে দেয়ার বড় টুলস হচ্ছে রাজনীতি তথা রাজনৈতিক শক্তি আর আদর্শ। ব্যক্তি থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে এই শক্তি কাজ করে। তবে গেল অর্ধশতাব্দী কাল ধরে নানা ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে আসা আমাদের ঐতিহ্যের সেই ‘পলিটিকেল ফোর্সের’ গতিপথ এখন সময়ের প্রয়োজনেই বদলে যাচ্ছে। তবে তা ইতিবাচক না হয়ে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে নেতিবাচক ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে। বদলে যাচ্ছে রাজনৈতিক শক্তির কাঙ্ক্ষিত রং আর রূপ। ইতিবাচক পথে নতুন প্রজন্মের মাঝে সেই ফোর্সের উৎস আর আদর্শ চালিত করার শক্তিও দুর্বল হয়ে পড়েছে।
প্রচলিত রাজনীতির বৈশিষ্ট্যের এই বদলে যাওয়াটাকে স্বীকার করা হলেও গতিপথ নির্ধারণের টেকসই কোনো কৌশল প্রয়োগের বিষয় চোখে পড়ছে না কারোরই। বরং ইতিবাচক ধারায় গতিপথ নির্ধারণ করার আগেই রাজনীতিকে সর্বজনীনকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। প্রান্তিক পর্যায়ে ঘরে ঘরে গড়ে তোলা হয়েছে বা হচ্ছে রাজনৈতিক নেতৃত্ব। ক্ষমতার রাজনীতির জন্য যা নীতিনির্ধারকদের কাছে অতিসম্ভাবনাময়। আর রাজনৈতিক আদর্শ ঘরে ঘরে ছড়িয়ে বা পৌঁছে দিতে পাড়ায়-মহল্লায়, গ্রামে-গঞ্জে গড়ে উঠছে সমর্থক ও কর্মীবাহিনী।
প্রচলিত রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেশের ‘জনগণ’ বলতে নিজস্ব কর্মীবাহিনী আর সমর্থকদেরই বুঝানো হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে ঘরে ঘরে নেতা, কর্মী, সমর্থকবাহিনী গড়ে তোলার মধ্যে ক্ষমতা কিংবা ভোটের রাজনীতির সফলতার অনন্ত সম্ভাবনার বীজ লুকিয়ে থাকে। যত বেশি সমর্থক, ততবেশি ভোট, ততবেশি ক্ষমতা পাওয়ার সম্ভাবনা। তবে ভোট আর ক্ষমতার এই ‘অতিরাজনীতিকরণের’ ফলে কাঙ্ক্ষিত ফসল না পাওয়ার আশঙ্কাই এখন প্রবল।
‘অতিরাজনীতিকরণে’ সামাজিক চরিত্রের যে বদল ঘটছে তা একেবারেই নেতিবাচক। মূলত, ক্ষমতার সর্বজনীনকরণের ফলে ক্ষমতার অপব্যবহার ভয়াবহ আকার নিচ্ছে। মূল্যবোধের বদল ঘটে সমাজের স্থিতিশীল কাঠামো ভঙ্গুর হচ্ছে। সবচেয়ে বড় বিষয়, পলিটিকেল ফোর্সের ‘ঐতিহ্যের ফর্ম’ ভেঙে পড়ছে।
স্বাধীনতার পর দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে রক্ষণশীল আর ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক শক্তির পাশাপাশি অরাজনৈতিক সামরিক শক্তির চর্চা ছিল চোখে পড়ার মতো। ‘অপরাজনীতির’ প্রবল বিস্তারে সমাজে স্বস্তি আর শান্তির মূলে আঘাত ছিল অতিমাত্রায়। সেবার চেয়ে ক্ষমতামুখী রাজনীতির চর্চাই হয়ে ওঠে মূখ্য। রাজনীতি সেবা নয়, মুনাফা- এমন ধারণা ধীরে ধীরে গ্রাস করেছে ‘ঐতিহ্যের ফর্মের’ শিকড়কে। এমন ‘অপরাজনীতি’ থেকে বেরিয়ে ঐতিহ্যের ধারায় ফেরার আকুলতা ব্যাকুলতা ছিল কয়েক দশক ধরেই। তবে আশার সেই আলো জ্বলজ্বল করে জ্বলতে দেখা যায়নি কখনই। ‘অপরাজনীতি’র সেই অন্ধকার ছেড়ে ‘অতিরাজনীতির’ ধোঁয়াশায় ফিরেছে ঐতিহ্যের সেই পলিটিকেল ফোর্স। যা কোনোভাবেই দিনের আলোয় ঝলমল করে উঠার সুযোগ পাচ্ছে না। স্বার্থপরতা, দুর্বৃত্তায়ন, আদর্শহীনতা- রাজনীতির সর্বজনীন বিস্তারের আশা আকাঙ্ক্ষাকে ম্লান করে দিয়েছে, দিচ্ছে। জনসেবা এখন জনভীতিতে পরিণত হয়েছে। ভয় আর আতঙ্কের প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে রাজনীতি। সাধারণ মানুষের আপন কিংবা ভরসার স্থল হয়ে ওঠেননি বেশিরভাগ রাজনৈতিক নেতাকর্মী।
‘অতিরাজনীতিকরণের’ ভয়াবহ পরিণতি হিসেবে ঐতিহ্যের সেই ‘পলিটিকেল ফোর্স’ নতুন প্রজন্মকে কোনো বার্তাই দিতে পারছে না। কি ঘরে, কি মহল্লায়, কিংবা ক্যাম্পাসে নতুন প্রজন্মের চিন্তা চেতনায় কিংবা আলোচনার টেবিলে ইতিবাচক কোনো জায়গাই নিতে পারছেন না প্রচলিত রাজনীতির বৈশিষ্ট্য।
রাজনীতির সোনালি ঐতিহ্যের ‘আফিমে’ ডুবে থাকা গণমাধ্যমের নীতিনির্ধারকরাও নতুন প্রজন্মের জন্য রাজনীতির নতুন কোনো বার্তা দিতে পারছেন না। সম্প্রতি ‘অতিরাজনীতিকরণের’ নেতিবাচক ফলাফলের একটা বার্তা পাওয়া গেছে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ঘটনার পর। হাইকোর্টের আদেশে গঠিত তিন সদস্যের অনুসন্ধান কমিটি গেল বৃহস্পতিবার (২৯ অক্টোবর) তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় অস্ত্র, মাদক, অর্থের দাপটে একশ্রেণির লোক গ্রামে ত্রাসের রাজত্ব বিস্তার করে সাধারণ মানুষকে বঞ্চনা আর নির্যাতনের মাধ্যমে জিম্মি করে রেখেছেন। প্রতিবেদনের ভূমিকায় বলা হয়েছে, স্থানীয় সন্ত্রাসী বাহিনী স্বেচ্ছাচারিতার চূড়ান্ত অবস্থা সৃষ্টি করেছে। রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত নিয়মিত বাহিনীকেও তারা অবজ্ঞা করছে। এর মাধ্যমে সরকার বা রাষ্ট্রকে সন্ত্রাসী চক্র চ্যালেঞ্জ ছুঁড়েছে। এ অবস্থার অবসান হওয়া উচিত। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, দলীয়ভাবে স্থানীয় নির্বাচন গ্রামীণ সমাজের পঞ্চায়েত প্রথাকে বিলুপ্ত করেছে। স্থানীয় মেম্বার, চেয়ারম্যানও দলীয় প্রভাবের বাইরে কাজ করতে পারছেন না।
‘অতিরাজনীতিকরণের’ এটা যেমন একটা দৃষ্টান্ত তেমনি অপ্রাসঙ্গিক হলেও জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক আবদুর রহিমের পোশাকবিধি বিষয়ক প্রজ্ঞাপন অতি কিংবা অপরাজনীতিকরণের ফল কিনা তা ভেবে দেখা দরকার।
সবচেয়ে বড় শঙ্কার বিষয়, রাজনীতি নিয়ে কথা বলা বা লেখায় ভয়াবহ বিপদ আছে। রাজনীতি বিষয়ক যে কোনো লেখা অতিশক্তিশালী মাইক্রোস্কোপে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে লেখকের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নির্ধারণ করা হয়। তারপর সেই লেখাসহ লেখককে আলোচনা-সমালোচনার টেবিলে নিয়ে ইচ্ছেমত রঙ দেয়া হয়। তবে এটাও যে হয় ‘অতিরাজনীতিকরণের’ ফলে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
লেখক: দীর্ঘদিন ধরে অনলাইন সাংবাদিকতা করে আসছেন। সমসাময়িক বিষয়ে মতামত তুলে বিভিন্ন সময়ে লেখালেখি করছেন। তার লেখায় থাকে নির্মোহ ও নতুন দৃষ্টিভঙ্গি। বর্তমানে তিনি ভোরের কাগজ অনলাইনে ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।