ম্যাকি ওয়াদুদ
শিল্প বিপ্লবের ফলে আমাদের এই সুন্দর মায়াবী পৃথিবীটা প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষতায় হারিয়ে গিয়েছে। বদলে দিয়েছে মানুষের সভ্যতা ও জীবনমান উন্নয়নের চালচিত্র। এই বিপ্লবের উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করছে বিশ্ব অর্থনীতির অগ্রগতি ও বিকাশ। ১৭৮৪ সাল থেকেই মূলত বাষ্পীয় ইঞ্জিনের নানাবিধ কলাকৌশল আবিস্কারের হাত ধরেই শিল্প বিপ্লবের সুচনা হয়। এরপর মানবসভ্যতা বিকাশের বহু চড়াই উৎরাই এর পর বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট আবিস্কারের ফলশ্র“তিতে বিশ্বের ব্যবসা-বানিজ্য, কৃষি শিল্প উৎপাদন তথা সমাজ সংস্কৃতি উন্নতির সর্বোচ্চ শিখরে অবস্থান করছে। বিদ্যুৎশক্তি ও ইন্টারনেটকে কাজে লাগিয়ে বিশ্ব এখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব মূলত তথ্য প্রযুক্তি নির্ভর ভার্চুয়াল জগত যার মাধ্যমে আমাদের জীবন-জীবিকাসহ সকল আনুসঙ্গিক কর্মপ্রণালীর আমুল পরিবর্তন ও বিকাশ লাভ করেছে।
ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়াসহ এশিয়া মহাদেশের চীন, জাপান, কোরিয়া, ভারত ইত্যাদি দেশ সমূহের অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত ও টেকসই হওয়ার অন্যতম কারণ হলো তথ্যপ্রযুক্তি। মানুষের বেঁচে থাকা ও জীবন-জীবিকা সংশ্লিষ্ট অন্ন, বস্ত্র, বাসস্খান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বিনোদনভিত্তিক মৌলিক ছয়টি চাহিদার সবগুলো পূরণ ও বিকাশের জন্য প্রযুক্তির বিভিন্ন কলা-কৌশলের অবদান অনস্বীকার্য। ডিজিটাল বিপ্লবের সোনালী পরশে বিশ্বের শ্রমবাজার ও উৎপাদনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবটিক অটোমেশন ব্যবহারে মনুষ্য সভ্যতার জীবনমানকে যতটা না সহজ করেছে তারচেয়ে বেশী করেছে সাশ্রয়ী ও সক্রিয়। ডিজিটাল প্রযুক্তি একটি অত্যন্ত স্বচ্ছ ও নিরাপদ এবং কার্যকর প্রক্রিয়া। এতে পক্ষপাতিত্ব বা অন্যায় অত্যাচারের কোন সুযোগ নেই। সকলের রয়েছে সমান অধিকার ও অংশিদারীত্ব। এতে জবাবদিহিতা ও অংশগ্রহণের সমান সুযোগ রয়েছে। যে জাতি সময়ের সাথে সাথে প্রযুক্তিতে নিজেদের হালনাগাদ করেছে সেই জাতি ততবেশি উন্নত ও মানবিক এবং নিরাপদ।
একবিংশ শতাব্দির বিশ্বায়নের বিশাল এই জগতের কোন একটি সুনির্দিষ্ট এলাকায় আমাদের বসবাস হতে পারে তবে আমাদের কাজের ক্ষেত্র সমস্ত পৃথিবী জুড়ে। প্রতিটি দেশের মানুষের ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও ভৌগলিক এলাকা অনুযায়ী জীবন ধারণ প্রক্রিয়া আলাদা-আলাদা হলেও প্রয়োজন ও চাহিদা এবং মানবিক গুনাবলী কিন্তু একই। কাজেই আমাদের চিন্তা-ভাবনা ও কর্মজগৎকে নির্দিষ্ট কোন এলাকা বা সমাজ সংস্কৃতির মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে পৃথিবীর সকল মানুষের সামষ্ঠিক ভাবনার সাথে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। আমাদের পেশা বা দক্ষতা এবং ধারণা গুলিকে সমগ্র বিশ্বের মানুষের জীবন ও জীবিকার উপযোগী করে প্রকাশ করতে হবে। ডিজিটাল বিপ্লবের চরম উৎকর্ষতার ফলে আমাদের ভাবনার দুয়ার খুলে দিতে হবে পৃথিবীর সকল মানুষের মাঝে। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে আমাদের নিজস্ব প্রতিভা বা দক্ষতাকে সকল মানুষের প্রয়োজন বা চাহিদা পূরণের নিমিত্তে বিনিময় বা বিক্রয় করার সুযোগ পেয়েছি। আমাদের শিক্ষা ও অভিজ্ঞতাকে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের মাঝে কেন্দ্রীভূত না করে রেখে বিকেন্দ্রিকরণ বা ছড়িয়ে দেয়ার এখনই প্রকৃত সময়। আমরা এই সুন্দর পৃথিবীতে সুখ-শান্তির মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকার জন্য ভার্চুয়াল জগতের প্রয়োজনে বৈশ্বিক পরিমন্ডলে আমাদের নিজেকে তৈরি করে নিতে হবে।
আমরা ভার্চুয়াল জগতের অনিন্দ্য সুন্দর এক অভিযাত্রী। এ-জগতে রূপ-রস, গন্ধ-সৌন্দর্য সবই আছে কিন্তু মনে হয় যেন প্রাণ নেই। জগতটি মনুষ্য সমাজকে প্রবল বেগে আকৃষ্ট ও মোহাচ্ছন্ন করে রাখে এবং মায়ার বন্ধনে মরিচিকার মতো জড়িয়ে নেয়। এ জগত বড়ই আশ্চর্য এক জগত। শুধুমাত্র এ জগতকে জীবনের আষ্ঠেপৃষ্ঠে বাঁধলে সাময়িক আরাম আয়েশ এবং সুখ স্বাচ্ছন্দ্য পাওয়া যায়। তবে অতিরিক্ত অনলাইন বা তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভরতা মানুষকে ক্রমান্বয়ে মেশিন বানিয়ে ফেলে। মানুষ তখন হয়ে যায় অনেকটা রোবটের মতো। রোবট শুধুমাত্র মানুষের কমান্ড অনুসরণ করে বা পালন করে কিন্তু মানুষের আবেগ, দুঃখ-কষ্ট বুঝতে পারেনা। রোবট বা মেশিন আমাদের সুখে হাসেও না আবার দুঃখে কাঁদেও না। এই জগতে মানুষ বেশি দিন থাকলে নেশায় আবিষ্ট হয়ে যায়। অনেকটা মাদকাসক্তির মতো ভয়াল আসক্তির দিকে ক্রমান্বয়ে ডিপ্রেশনে চলে যায়। মানুষ তখন বোধশক্তি ও বিচার বিশ্লেষণ ভুলে গিয়ে অসামাজিক হয়ে যায়। সমাজ-সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
মানুষ সামাজিক জীব ও প্রকৃতির সন্তান। প্রকৃতিতে প্রাচুর্য ও রূপ-সৌন্দর্য্য সবই আছে। প্রকৃতি জীবন্ত ও সত্য। প্রকৃতি থেকে আমরা প্রেম-ভালোবাসা, ঐশ্বর্য সবই পাই। প্রকৃতি মানুষকে ধীরে ধীরে সামাজিক করে তুলে। প্রকৃতি তার নিজস্ব নিয়মে মনুষ্য সমাজের সকল জীবন-জীবিকায় সঠিক পথ প্রদর্শন করে থাকে। আমাদের জীবন দর্শণের মধ্যে শিক্ষা ও জ্ঞান অর্জনে প্রকৃতি হলো বন্ধুর মতো। প্রকৃতি সমাজ-সংসারে সুখ-শান্তির সাথে-সাথে ঐশ্বর্য ও পরমাশ্চর্য পরমায়ু দেয়। মানুষের উচিত হবে যতোটা সম্ভব কৃত্রিম ও মেশিন-রোবট থেকে নিজেকে দূরে রাখা এবং প্রকৃত সত্যকে ধারণ করা। খোলা আকাশের নীচে শান্ত স্নিগ্ধ বাতাসে ঘুরে বেড়ালে তথ্য প্রযুক্তিগত ভাবনাকে মানুষ আরও সুদৃঢ় করতে সক্ষম হবে।
বাংলাদেশ ২০০৯ সাল থেকে ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখলেও দেশের সর্বস্তরে সকল সেক্টরে এখনো ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রয়োগ সম্ভব হয়ে উঠেনি। স্বাধীনতার পঞ্চাশতম বছরে বাংলাদেশ সরকার ২০২১ সালের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ অর্থাৎ রূপকল্প- ২০২১ এর মাধ্যমে দেশকে মধ্যম আয়ের একটি উন্নত দেশে পরিণত করবে বলে প্রতিশ্র“তি দিয়েছে। ২০২০ সালের শেষান্তে এসে আমাদের উপলদ্ধি হলো দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত ও টেকসই এবং জীবন মানের উন্নয়ন ও উৎপাদন খরচ সাশ্র্রয়ী করতে হলে ডিজিটাল প্রযুক্তির উপর নির্ভর করতে হবে। দেশের রাজনীতি ও সমাজনীতি আধুনিক, নিরাপদ, কার্যকর ও মানবিক হওয়ার একমাত্র অবলম্বন হলো সমৃদ্ধশালী অর্থনীতি বিনির্মাণ। দেশের মানুষ হয়তো মনে করে অতিমাত্রায় প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে দেশের ঐতিহ্যবাহী পেশাসমূহ এবং কৃষ্টি-কালচার বিনষ্ট হযে যেতে পারে। অনেক মানুষ বাবা-দাদার বংশ-পরম্পরায যে পেশায় নিয়োজিত ছিলো তা ধ্বংস হয়ে যাবার ভয়ে প্রযুক্তিকে আত্মীকরণ করতে ভয় পাচ্ছে বিধায় তারা ধীরে-ধীরে কর্মহীন হয়ে পড়ছে। আমাদেরকে এই ধারণা থেকে বের হয়ে না আসলে বা যুগের সাথে নিজেকে হালনাগাদ না করতে পারলে সমাজ-সংসারে প্রতিষ্ঠিত হওয়া খুবই কঠিন। আমরা প্রতিটি মানুষ নিজ নিজ আগ্রহ অনুসারে ভিন্ন-ভিন্ন বিষয় বা সেক্টরে সমাজ-সংসারে প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকি। কাজেই আমাদের আগ্রহ ও প্রতিভা মোতাবেক নিজেকে অভিজ্ঞ বা দক্ষ করে তোলার জন্য ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা বা প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই।
আমরা যদি সাফল্যের সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করতে চাই তবে আমাদেরকে কেবলমাত্র সুনির্দিষ্ট সঠিক ট্রেড বা কৌশলগুলিতে প্রশিক্ষণ দরকার। অনলাইন জগতের মধ্যে যে বিষয়গুলি আমাদের জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে সবসময় যুক্ত রয়েছে আমাদের তরুণ সমাজ ও গ্রামিণ জনগোষ্ঠিকে সঠিক প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে দরিদ্র ও হতাশাগ্রস্ত এ জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এদেশে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪৯% শতাংশ রয়েছে ২৪ বছরের নীচে যারা খুবই সতেজ, প্রাণবন্ত ও চঞ্চলতায় ভরপুর। এই বিশাল পরিমাণ মেধাবী তরুণ-তরুণীকে ডিজিটালাইজেশন বা অটোমেশানে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে উপযুক্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিয়ে উৎপাদন কার্যে নিয়োজিত করতে পারলে আমাদের এই ক্ষুধা-দারিদ্রতায় অভিশপ্ত দেশও ইউরোপ, আমেরিকার মতো উন্নত দেশে পরিণত হওয়া শুধু সময়ের ব্যপার।
অনলাইন ডিজিটাল প্রযুক্তির উৎকর্ষতার ফলে বহির্বিশ্বের অন্যান্য দেশসমুহ উন্নতির চরম শিখরে এগিয়ে গেলেও বাংলাদেশ যে তিমিরে ছিল অনেকটা সে তিমিরেই রয়ে গেল। আমাদের প্রিয় সোনার বাংলাদেশে রূপকল্প-২০২১ তথা ডিজিটাল বাংলাদেশ তেমন একটা চোখে পড়ার মতো পরিবর্তন হয়নি। এর প্রধান কারণ হলো ডিজিটাল প্রযুক্তির মধ্যে রয়েছে সুশাসন অর্থাৎ স্বচ্ছতা, সমঅংশগ্রহণ, জবাবদিহিতা এবং ন্যায্যতা। আমাদের এদেশের সমাজ সংস্কারক তথা দেশের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে ব্যক্তিদের মধ্যে বেশির ভাগই সমাজ ও রাষ্ট্রের সামষ্টিক উন্নয়নের চেয়ে ব্যক্তি স্বার্থের উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রযুক্তিকে ব্যবহার করছেন। বাংলাদেশের আটষট্টি হাজার গ্রাম-বাংলার সর্বত্র ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়ন করতে হলে সকল এলাকাকে বিদ্যুত, ইন্টারনেট ও ওয়াইফাই এর ব্যবস্থা করতে হবে। বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট এর খরচ আমাদের দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠিীর আয় ক্ষমতার মধ্যে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। ডিজিটাল ডিভাইসগুলো যেমন ল্যাপটপ, কম্পিউটার, স্মার্টফোন, ইন্টারনেট, সার্ভারসহ সকল সামগ্রীর দাম কমাতে হবে এবং তা ক্রয়ের জন্য সহজশর্তে ঋণ প্রদান করতে হবে। সারাদেশে ডিজিটাল উদ্যোক্ত সৃষ্টি করতে হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সাথে জড়িত সংশ্লিষ্ট সকল মহলকে সচেতন করতে হবে। মাধ্যমিক পর্যায়ের ছাত্র-ছাত্রীদের পাঠ্য বিষয়ে ডিজিটালাইজেশন, যোগাযোগ ও নেটওয়ার্ক নামে আলাদা বিভাগের মাধ্যমে তত্ত¡ ও ব্যবহারিক শিক্ষা প্রদান করতে হবে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে মূল সমস্যা গুলো হলো: ১) ডিজিটালাইজেশনের মূল ভিত্তি হলো প্রোগ্রামিং, নতুন নতুন উদ্ভাবন এবং মার্কেটিং চ্যানেল। অপরিপক্ক কোডিং অথবা প্রোগামিং বলতে আমরা যে দক্ষতা বুঝি বাংলাদেশে তার সংখ্যা খুব অপ্রতুল। আর নতুন উদ্ভাবন এর ক্ষেত্রে নীতি নর্িারিত পর্যায় এবং সরকারের শক্ত সহায়তা দরকার হয়। যেটা আমদের দেশে একদমই করা হয় না বরং আমাদের সৃজনশীল উদ্ভাবনসমূহ কেড়ে নিয়ে অন্যদের উদ্ভাবন হিসেবে চালিয়ে দেয়া হয় ২) বাংলাদেশে প্রায় প্রতিটি প্রকল্প অথবা কনসেপ্টই হয় কপি করা। আমাদের দেশের সোনার ছেলেরা যে নতুন-নতুন তথ্য প্রযুক্তিভিত্তিক ভাবনাগুলো সৃষ্টি করে তা কখনো নীতি নির্ধারক বা সকারের সংশ্লিষ্ট পর্যায়ে প্রভাব বিস্তার করতে পারেনা । কারণ আমাদের মধ্যে দেশপ্রেম ও দেশের বৃহত্তর বা সামষ্ঠিক স্বার্থে নিজেকে উজাড় করে দেয়ার মানসিকতা গড়ে উঠেনি ৩) ‘তেলে মাথায় তেল’ বাংলা এই প্রবাদটি আমাদের দেশে পুরোটাই সত্যি। আমরা যতো বড় মাল্টি বিলিয়ন ডলার এর প্রকল্প উদ্ভাবন করিনা কেন তা বাস্তবায়ন বা প্রয়োগের ক্ষেত্রে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয়না এবং ৪) আমাদের দেশের পরিবেশ ও কনটেক্সট অনুযায়ী ডিজিটাল প্রযুক্তির কিছু-কিছু প্রকল্প সহায়ক না হওয়া সত্তে¡¡ও বিশিষ্টজন ও বড়-বড় শীর্ষ ও নেতৃত্ব শ্রেণি পর্যায়ের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের প্রভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে যার সুফল আমাদের স্বল্প আয়ের দরিদ্র জনগোষ্ঠী সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারছেনা।
আমরা গ্লোবাল বিশ্বে বাস করলেও আমাদের নিজেদের একটি পরিবার-সমাজ ও দেশ রয়েছে। আমাদের জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে আয় রোজগার করতে হয়। আমরা তৃতীয় বিশ্বের মানুষের ধারণা হলো আয়-রোজগার করা মানে চাকরি করা। আর এই চাকরি নামক সোনার হরিণের পিছনে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে সময়-অর্থ-শ্রম সব হারিয়ে হতাশ হয়ে অন্যের উপর নির্ভর করা। বিশেষ করে আমাদের সোনা ফলা দেশের মেধাবী সন্তানরা এদেশের মায়া-মমতা, স্নেহ-ভালোবাসা ত্যাগ করে বিদেশে নির্বাসিত হয় ভালো চাকরীর লোভে, অন্যের দাসত্ব করার জন্য। এদেশের অধিক জনসংখ্যা যদি দেশের একজন সংগঠক বা উদ্যোক্তা হয়ে জনসম্পদে পরিণত হতো তাহলে আজ আমরা ইউরোপ, আমেরিকার মতো উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারতাম। উদ্যোক্তা বা সংগঠক বলতে বুঝায় নিজস্ব বুদ্ধি, বিবেচনা, সৃজনশীল প্রতিভাকে ব্যবহার করে কোন উদ্যোগ গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে আয় রোজগার করে পরিবার-সমাজ ও দেশের প্রতি দায়িত্ব পালন করা এবং নিজস্ব উদ্যোগসমুহকে প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কাজে লাগিয়ে নিজের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি দেশ ও দশের সেবা করা। কিন্তু আমাদের সমাজে আমরা উদ্যোক্তা বলতে বুঝি কোন পণ্য ও সেবা প্রস্তুতপূর্বক মানুষের কাছে চড়া দামে বিক্রি করে নিজে নিজে প্রতিষ্ঠিত হওয়া। আমাদের এই ধরণের সনাতনী ধারণা পরিহার করা উচিত।
আমরা কোন না কোন সমাজ বা দেশের বাসিন্দা। কাজেই আমাদের উচিত এমন কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা যাতে ওই উদ্যোগের ফলে নিজের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি সমাজ ও দেশের কিছু বেকার মানুষের কর্মসংস্থান হয়। এতে করে নিজের আয়-উন্নতির পাশাপাশি দেশ ও দশেরও আয় উন্নতি হয়। আমরা প্রতিটি মানুষ নিজ নিজ আগ্রহ অনুসারে ভিন্ন-ভিন্ন বিষয় বা সেক্টরে সমাজ-সংসারে প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকি। কাজেই আমাদের আগ্রহ ও প্রতিভা মোতাবেক নিজেকে অভিজ্ঞ বা দক্ষ করে তোলার জন্য ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা বা প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই। আমরা যদি সাফল্যের সর্বোচ্চ শিখরে আরোহন করতে চাই তবে আমাদেরকে কেবলমাত্র সুনির্দিষ্ট সঠিক ট্রেড বা কৌশলগুলিতে প্রশিক্ষণ দরকার। অনলাইন জগতের মধ্যে যে বিষয় গুলি আমাদের জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে সবসময় যুক্ত রয়েছে আমাদের তরুণ সমাজ ও গ্রামিণ জনগোষ্ঠিকে সঠিক প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে দরিদ্র ও হতাশাগ্রস্ত এ জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
অনলাইন ও ইন্টারনেট এবং স্মার্টফোন এর মাধ্যমে ঘরে বসে আয় রোজগার করা সম্ভব। কারণ ডিজিটালাইজেশনে কোন সমাজ বা দেশের মধ্যে সীমানা দেয়াল নেই। কাজেই আমরা এখন বিশ্ব নামে একটি সমাজে বাস করছি। ডিজিটাল বিশ্বে সকলের অংশগ্রহণের সমান সুযোগ রয়েছে এবং কাজের স্বীকৃতির সাথে সাথে স্বচ্ছতাও রয়েছে। এখানে ধনী-দরিদ্র, ছোট-বড়, উঁচু-নিচুর কোন ভেদাভেদ নেই। এখানে খুব সহজেই কোন বিষয়ের উপর প্রশিক্ষণ নিয়ে দক্ষ হয়ে নিজের উদ্যোগে একটি সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান করে খুব সহজেই জীবন-জীবিকার সংস্থান করা সম্ভব। পাশাপাশি দেশ ও দশের বেকার তরুণ-তরুণীদের উৎসাহ দানের মাধ্যমে তাদের বেকারসমস্যা দূর করে গোটা জাতিকে স্বাবলম্বী করা সম্ভব। আমাদেরকে এখন সময়ের সাথে-সাথে নিজেকে আপডেট করতে পারলে অনলাইন সুবিধাকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো যাবে। এজন্যে আমাদের এখন শুধুই উদ্যোক্তা না হয়ে ডিজিটাল উদ্যোক্তা হয়ে পরিবার-সমাজ ও রাষ্ট্র-বিশ্বের উন্নয়নে অবদান রাখতে হবে।
সফলতার প্রতিটি সিড়ি অতিক্রম করে স্বর্ণ শিখরে পৌঁছাতে হলে চারটি বিষয় সবার আগে মনে রাখা ও পালন করা জরুরী। ১) সবসময় ভালো কাজে ব্যস্ত থাকতে হবে ২) ”না” বলা শিখতে হবে ৩) সমমনাদের মধ্যে নেটওয়ার্ক বা টিম বিল্ডিং করতে হবে এবং ৪) নিজের দক্ষতা ও যোগ্যতা সম্পর্কে সুস্পষ্ঠ ধারণা অর্থাৎ নিজেকে জানতে হবে। এই চারটি বিষয় জানা থাকলে প্রতিটি ব্যক্তি শুধুমাত্র চাকরির মুখাপেক্ষি না হয়েও আত্বনির্ভর হয়ে সমাজ সংসারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবে। তবে আশার কথা হলো এদেশের কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণীদের মধ্যে ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রতি আগ্রহ ও ব্যবহার অনেকাংশেই বেড়েছে। যা সমাজের সুবিধাবঞ্চিত ও প্রান্তিকপর্যায়ের জনগোষ্ঠির উন্নয়ন ও জীবন-জীবিকার পাথেয় হিসেবে কাজ করবে। শহর-নগর এবং গ্রাম-গঞ্জের সর্বত্র এই অনলাইন প্রযুক্তি সমভাবে বিকাশ করতে পারলে বাংলাদেশের তরুণরা চাকরি নামক সোনার হরিণের পিছনে কম ছুটবে এবং হতাশা ও বিভ্রান্তির শিকার হতে রেহাই পাবে। আমাদের প্রাণ-চাঞ্চল্য তরুণ সমাজ যদি নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নে প্রযুক্তিকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারে তবে তারা আর দেশ ও দশের বোঝা হবেনা। তারা জীবনযুদ্ধে শত বাধা অতিক্রম করে আত্মনির্ভর হয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখতে সক্ষম হবে। এজন্য তাদেরকে উদ্যোক্তা হতে হবে। শুধু উদ্যোক্তা হলেও চলবেনা। তাদের হতে হবে ডিজিটাল উদ্যোক্তা।
বৈশ্বিক কোভিড মহামারীতে সর্বগ্রাসী করোনার ভয়াল থাবায় পুরো বিশ্ব এখন অবরুদ্ধ, ঘরবন্দি বা কোয়ারেন্টাইনে প্রায় অচলাবস্থায় আছে। বিশ্বের অনেক দেশ বহু বছর আগ থেকে পুরোপুরি প্রযুক্তি নির্ভর হওয়া সত্বেও এখন করোনার প্রকোপে হিমশিম খেতে হচ্ছে। সেখানে বাংলাদেশতো একবারেই শিশু। এদেশের সরকার হতে শুরু করে আপাময় জনসাধারণসহ নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের সকলেই এখন হাড়ে হাড়ে উপলদ্ধি ও বিশ্বাস করছে যে অনলাইন বা তথ্যপ্রযুক্তির পরশ বা বিকাশ ব্যতিত এ জাতিকে উন্নতির সর্বোচ্চ শিখরে আরোহন করা সম্ভব নয়। কাজেই এখনি আমাদের উপযুক্ত সময় চতুর্থ শিল্প বিপ্লব তথা ডিজিটাল বিপ্লবকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিযে জীবন ও জীবিকা সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম পরিচালনায় সঠিক পরিকল্পনা করা। তথ্যপ্রযুক্তি ও কলা-কৌশলকে বাস্তবে রূপদান বা প্রয়োগ করে অনলাইনের মাধ্যমে আত্ম-কর্মসংস্থানে নিজেকে নিয়োজিত করে ক্ষুধা ও দারিদ্রতাসহ মৌলিক অধিকার সমূহ প্রতিষ্ঠা করা। কোভিড-১৯ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব রেধে আতংকিত না হয়ে সাবধান ও সচেতন থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারলেই পরিবার, সমাজ, দেশ ও বিশ্ব নিরাপদ থাকবে।
গ্লোবাল বিশ্বে আমাদের নিজেদের জাতীয়তা বা পরিচিতি জন্মগ্রহণ বা বসবাসকারী দেশের হলেও আমাদের মনোজগৎ ও কর্মজগৎকে সৌরজগতের সকল গ্রহের সকল দেশে বিস্তার করতে হবে। আমাদের বিভিন্ন দেশের মধ্যে সীমানা দেয়াল থাকলেও এখন আমরা ঘরে বসে ভাবনা বিনিময় ও নিজের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা বিক্রয়ের মধ্যে কোন দেয়াল নেই। পৃথিবীর সমস্ত দেশের মানুষ ধর্ম-বর্ণ ও জাতি-গোষ্ঠি নির্বিশেষে এখন একটি অভিন্ন জগতের বাসিন্দা হয়ে বাস করছে। আমরা পৃথিবীবাসী সবাই আজ ডিজিটাল শিল্প বিপ্লবের কল্যাণে একটি পরিবার-সমাজ ও রাষ্ট্র এবং জাতিতে পরিণত হয়েছি। সবাই সমান অধিকার ও সমমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে নিরাপদ ও সুখ-শান্তি বসবাস করবে এই অনলাইন জগতে তথা ভার্চুয়াল জগতে। আমরা সকলেই এক। সকলেই একটি জাতি। আমাদের একটিই সংস্কৃতি আর একটিই পৃথিবী।
ম্যাকি ওয়াদুদ: লেখক ও প্রাবন্ধিক।