করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ও দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা

এম. এ.কাদের

চলতি শীত মৌসুমে ঠাণ্ডাজনিত রোগের কারণে করোনা সংক্রমণ বাড়ার যথেষ্ট আশংকা রয়েছে। ইতোমধ্যে ইউরোপে নতুন করে প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধির মধ্যদিয়ে বিশ্বব্যাপী রেকর্ড সংখ্যক নতুন করোনা রোগী বেড়েছে। মহাদেশটিতে গত কয়েকদিনে গড়ে প্রতিদিন ২ লক্ষ ১৫ হাজারের বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে। এখন বিশ্বজুড়ে প্রতি ১০০ জন আক্রান্তের মধ্যে ২৭ জনই ইউরোপীয় দেশগুলোর বাসিন্দা।

মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে ইউরোপে এ পর্যন্ত ১ কোটি ৮১ লাখের বেশী রোগী শনাক্ত হয়েছে। সে তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থা অনেকটাই ভালো। চলতি শীত মৌসুমে দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আসতে পারে- জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের এমন আশঙ্কার পর তা মোকাবিলায় গত সেপ্টেম্বরে এর রোডম্যাপও তৈরি করা হয়েছে। প্রস্ততি নাজুক হলে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ বা সেকেন্ড ওয়েভ সামলানো কঠিন হবে। এতে সংক্রমণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়তে পারে, যদিও সরকারের নীতিনির্ধারকরা এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ প্রস্ততি সম্পন্ন করার কথা জানিয়েছেন। দেশের প্রতিটি জেলা প্রশাসনকে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

দেশে করোনা ভাইরাস ৮মার্চ শনাক্ত হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত গত ৭ মাসে কোনদিনই এ মৃত্যুর মিছিল থেমে থাকেনি। বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিস্থিতির বেশি অবনতি হলে গরীব দেশ হিসাবে সামাল দিতে পারা আমাদের জন্য অনেক কষ্টসাধ্য হয়ে যাবে। কাজেই সংক্রমণ যাতে না বাড়ে, সেদিকে আমাদের মনোযোগী হওয়া দরকার। করোনা আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থা কতটা দুর্বল।

গত জুন-জুলাই মাসে করোনার প্রকোপ দেখা দিলে অনেক সাধারণ রোগী হার্টঅ্যাটাক, স্ট্রোক, কিডনী, ডায়রিয়াসহ বিভিন্নভাবে করোনা সন্দেহের কারণে জরুরী চিকিৎসা না পেয়ে এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতাল ছোটাছুটি করে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণে এসব জরুরী রোগী ও অভিভাবকরা হাসপাতালে যেতে অনীহা প্রকাশ করায় বিনা চিকিৎসায় অনেকে বাড়িতেই মৃত্যুবরণ করেছেন।

সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা, ইতোমধ্যে মন্ত্রীসহ শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন শিল্পপতি করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। এস. আলম গ্রুপের পরিচালক, ৫টি ব্যাংক সহ ৩৫ টি শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক মোরশেদুল আলম করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ১টি ভেন্টিলেটরের অভাবে পরিবারের সকলের সামনে করুণ মৃত্যুবরণ করেন। দেশে এস.আলম গ্রুপের মত অনেক শিল্পপতি, আমলা, জনপ্রতিনিধি আছেন, যারা সাধারণ জ্বর-কাশিতেও চিকিৎসা ও চেকআপের জন্য বিদেশে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে আসেন।

দেশ উন্নয়নে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সবচেয়ে গুরুত্ব বহন করে শিক্ষা ও চিকিৎসা। স্পর্শকাতর এ দুটি বিষয়কে কোনো ভাবেই অবহেলা করার সুযোগ নাই। কিন্তু দুর্নীতি অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনার কারণে এই দুটি বিষয়ে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। ২০১৯-২০ অর্থবছরে চিকিৎসা খাতে ২৫ হাজার ৭শত ৩২ কোটি টাকা বাজেট থাকা সত্ত্বেও চিকিৎসা ব্যবস্থার তেমন উন্নতি না হবার কারণে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর মানুষ আস্থা হারাচ্ছে। আমাদের দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর আস্থার অভাব শুধু সাধারণ রোগীদেরই নয়, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, সরকারি আমলা ছাড়াও এমপি-মন্ত্রীদেরও। আর এ অনাস্থার কারণেই তারা প্রায় বিদেশে চিকিৎসার জন্য গিয়ে থাকেন। চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর আস্থা না থাকার কারণ- প্রয়োজনীয় দক্ষ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরি না হওয়া, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের স্বল্পতা, মেধাবী চিকিৎসকদের সঠিকভাবে মূল্যায়ন না করা, কম মেধাবী শিক্ষার্থীদের চিকিৎসক হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা।

এছাড়াও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে জরুরী রোগী দেখানোর ক্ষেত্রে অধিক সিরিয়াল, বেশির ভাগ নির্ভুল রোগ নির্নয়ের ক্ষেত্রে এক ডায়গনষ্টিক সেন্টারের সাথে অন্য ডায়গনষ্টিক সেন্টারের রিপোর্টে মিল না থাকা, অভিজ্ঞ টেকনিশিয়ান এর অভাব, প্রয়োজনীয় ডাক্তারের স্বল্পতা, ডাক্তারদের বাসা, চেম্বার ও নিরাপত্তার অভাব রয়েছে।

দেশে প্রতি বছর ৩৬ টি সরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে ৪ হাজার ৬৮ জন ও প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ থেকে ৬ হাজার ২৩৩ জন অর্থাৎ কমবেশি ১০ হাজার ২৯৯জন ডাক্তার বেরিয়ে থাকেন, অথচ হাসপাতালগুলোতে ডাক্তারের সংকট প্রায় লেগেই থাকে। এতে করে প্রতি উপজেলায় ৩/৪ লক্ষ মানুষের চিকিৎসা ব্যবস্থা ডাক্তারের স্বল্পতায় ঠিকমত চিকিৎসা সেবা দেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না।

দেশে চিকিৎসকের অনেক অভাব রয়েছে। DMDC এর ২০১৮ সালের তথ্যমতে, আমাদের দেশে মোট ডাক্তারের হিসাব আনুযায়ী ১৮৪৭ জন মানুষের জন্য ১ জন ডাক্তার নিয়োজিত আছে। তাছাড়া চিকিৎসকদেরকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন না করার কারণে অনেক অভিজ্ঞ চিকিৎসক দেশের বাইরে চলে যায়, ফলে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় চিকিৎসকের স্বল্পতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে কিছু ডাক্তারদের সাথে ডায়াগনস্টিক সেন্টার এর একটা বড় কমিশন বাণিজ্য রয়েছে। অনেক ডাক্তারের নির্ধারিত ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে রিপোর্ট না করলে তারা গ্রহণ করতে চান না।

এ ছাড়াও ভুল রোগ নির্ণয়, ভুল অপারেশন ও ওষুধের দাম অধিক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় রোগীরা দেশের চিকিৎসার উপর অনেকটা বিমুখ হচ্ছে। বর্তমান সরকারের চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর সঠিক পরিকল্পনা ও নজরদারির কারণে ইদানিং আমরা অনেক সুফলও পাচ্ছি। আমাদের দেশে এখন স্বল্প খরচে অনেক ভালো নির্ভুল চিকিৎসা হচ্ছে।

এছাড়াও দেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য অত্যাধুনিক আন্তর্জাতিক মানের নিউরোসাইন্স হাসপাতাল, জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, জাতীয় হার্ট ফাউন্ডেশন, শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ণ ও প্লাস্টিক সার্জারী ইন্সটিটিউটসহ বেশ কয়েকটি সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে হাসপাতাল তৈরি হওয়ায় আমরা তার সুফল ভোগ করছি।

তাছাড়া ইতিমধ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজের পাশেই আন্তর্জাতিক মানের সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল নির্মাণের কাজ শুরু করেছেন। এখানে সর্ব প্রকার জটিল রোগের অপারেশন হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দেশের মানুষের জন্য চিকিৎসা ব্যবস্থা অধিক গুরুত্ব বহন করে এবং বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর হওয়ায় সরকারকে অবশ্যই দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে নিরপেক্ষতার সাথে দুর্নীতি দমন করে চিকিৎসা ব্যবস্থাকে এগিয়ে নিতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে সবচেয়ে মেধাবীরাই চিকিৎসার মত মহৎ পেশায় সেবা দিয়ে থাকেন। তাদের অবহেলা করার কোন সুযোগ নাই। সমাজে তাদের সর্বোচ্চ মর্যাদা, বেতনসহ সর্ব প্রকার সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। যোগ্য ডাক্তারদের সঠিকভাবে মূল্যায়ন হলে মেধাবী ডাক্তারদের বিদেশে যাওয়া বন্ধ হবে এবং দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার অনেক উন্নয়ন ঘটবে, এতে দেশের জনগণের
চিকিৎসার প্রতি আস্থা ফিরে আসলে বিদেশে চিকিৎসার জন্য যাওয়া বন্ধ হবে। এতে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে।

আধুনিক ও উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা শুধু ঢাকা কেন্দ্রিক নয়, পুরাতন জেলা শহর পর্যন্ত ছডি়য়ে দিতে হবে। বর্তমানে দেশে হৃদরোগের ঝুঁকি অনেক বেড়ে গেছে। প্রচুর মানুষ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে, সময়মতো সঠিক চিকিৎসা না পাওয়ার কারণে মারা যাচ্ছে। অন্তত প্রত্যেক মেডিকেল কলেজে করোনারী কেয়ার ইউনিট (সিসিইউ) চালু থাকলে বেশীর ভাগ রোগী বাঁচানো সম্ভব হবে। ডাক্তারদের ডিউটির ক্ষেত্রে সেবামূলক মনোভাব ও আন্তরিকতা থাকতে হবে। ডিউটির ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে তাদেরকে অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনতে হবে। ডাক্তারদের জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

 

এম. এ.কাদের : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
Email-makader958@gmail.com

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts