মুসা সাদিক
মিথ্যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার শুরু থেকে আমি ও আমার পরিবার বঙ্গবন্ধুর আন্দোলন ও সংগ্রামের সাথে প্রত্যক্ষভাবে মিশে যাই। কারণ, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আমার মামা রুহুল কুদ্দুসকে অন্যতম আসামী করা হয়। তার অপরাধ ছিল তিনি ইসলামাবাদে আইয়ুব খানের অফিসে অতিরিক্ত সচিব হয়েও বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ঐতিহাসিক ৬ দফা রচনা করেন। আগরতলা মামলায় বঙ্গবন্ধুর মুক্তি হলে সকলেই মুক্তি পাবে। সেই লক্ষ্যে সমগ্র বাঙালি জাতি আওয়াজ তোলে “জেলের তালা ভাঙবো, শেখ মুজিবকে আনবো”। আমরাও সেই আওয়াজ ও সংগ্রামে সর্বাত্মকভাবে সামিল হয়ে যাই, একাত্ম হয়ে যাই। আইয়ুব-মোনেম ভাই ভাই-এক দড়িতে ফাঁসি চাই স্লোগানে-হুঙ্কারে ঢাকাসহ সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান আগ্নেয়গিরির লাভাতে পরিণত হল। শহীদ হয়ে গেল ছাত্র মতিউর, শ্রমিক নেতা মনু মিয়া। ডাকসু’র ভি পি তোয়ায়েল আহমদসহ ছাত্র নেতারা কবি নজরুলের অগ্নিবীনা হাতে অগ্নিবহ্নি জ্বালিয়ে দিলেন সারা বাংলায়। আগরতলা মামলা সেই অগ্নিশিখায় পুড়ে ছাই হয়ে গেল। আইয়ুব খানের তখতে তাউস খান খান হয়ে গেল। সত্তরের নির্বাচন হয়ে গেল। নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের পার্লামেন্টের সংখ্যা গরিষ্ঠ দলের নেতা হয়ে গেলেন। বাঙালির রক্তপিপাসু ইয়াহিয়া-টিক্কা খানের মীরজাফরী শুরু হয়ে গেল। সেই সন্ধিক্ষণে বাঙালি জাতির জীবনে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ইতিহাস ঘটে গেল। ৭১-এর ৭ই মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লক্ষ জনতার সম্মুখে কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম”।
৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ পাকিস্তান রেডিও প্রচার না করায় আমার ও চাকসু’র জি. এস. শহীদ আব্দুর রবের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল ছাত্র পরদিন ৮ই মার্চ দুপুর সাড়ে এগারটায় চট্টগ্রামের আগ্রাবাদের রেডিও স্টেশন দখল করে ফেলি। সেখানে রেডিও’র আর. ডি. জনাব নাজমুল আলম অনুপস্থিত ছিলেন। তদস্থলে রেডিও’র বার্তা সম্পাদক সুলতান আহমদ রেডিও’র ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করছিলেন। আমরা সকলে দোতলায় অবস্থিত তার রুমে ঢুকে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের যে ভাষণ, ৮ই মার্চের পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তা চট্টগ্রাম রেডিও থেকে বিশেষ সংবাদ বুলেটিন আকারে প্রচারের জন্য দাবী জানাই। কিন্তু তিনি তখনো পাকিস্তানের সেন্ট্রাল গভর্ণমেন্টের অফিসার দাবী করে তা করতে পারবেন না বলে জানান। উত্তেজিত ছাত্ররা তখন তাকে ধরে ফেলে এবং আমি লাফ দিয়ে তার টেবিলের ওপরে উঠে তার মাথার উপর টাঙ্গানো মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র ছবি ছুড়ে ফেলে দেই। তা দেখে তিনি পাকিস্তানের ক্রীতদাসীদের মতো হাউ-মাউ করে কাঁদতে থাকেন। তখন আমি ও আব্দুর রব নিউজ রুমে ঢুকে একজন নিউজ রিডারকে ধরে দৈনিক আজাদী পত্রিকায় প্রকাশিত বঙ্গবন্ধুর ভাষণ পুরোটা প্রচার করতে থাকি।
সে সময় আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র, বিশ্ববিদ্যালয়ের ইত্তেফাকের সংবাদদাতা, চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদীর সাংবাদিকতাসহ চট্টগ্রাম রেডিও’তে নিয়মিত প্রোগ্রাম করতাম। সেজন্য চট্টগ্রাম রেডিও’র সবকিছু আমার নখদর্পনে ছিল। অতঃপর ৮ই মার্চ থেকে সমগ্র চট্টগ্রাম অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠল এবং “বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর” স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠল। ৮ই মার্চ থেকে ২৪শে মার্চের মধ্যে চট্টগ্রামে পোর্ট ট্রাস্ট, ষোল শহর, আগ্রাবাদ, কালুরঘাট এবং নৌবাহিনীর কোয়ার্টারের দিক দিয়ে নাসিরাবাদ, বায়েজিদ বোস্তামী ও অক্সিজেন মোড় থেকে পাকিস্তান আর্মির সহযোগীতায় বিহারীরা বাঙালিদের উপর বহু গুলি বর্ষণ করলো। ফলে বহু হতাহত হলো। শের শাহ, ফিরোজ শাহ ও অয়ারলেস কলোনী এলাকায় বেশি বাঙালি মারা পড়ে। ২৫শে মার্চ আমি ও যুবলীগ নেতা এস এম ইউসুফ এবং চাকসু’র জি এস আব্দুর রব, ভি পি ইব্রাহীম প্রমুখরা বাটালী হিলে গিয়ে আওয়ামী নেতা এম আর সিদ্দিকী এবং সিনেমা হলের সামনে জহুর আহমেদ চৌধুরীর সাথে তার বাড়ীতে গিয়ে দেখা করলাম এবং মুক্তিযুদ্ধের জন্য পুলিশ লাইনের অস্ত্রাগার খুলে নেবার জন্য বললাম। ২৬শে মার্চ রাতে দৈনিক আজাদী অফিসে সম্পাদক খালেদ মোহাম্মদ, এমপি’র উপস্থিতিতে ঢাকা থেকে তার টেলিপ্রিন্টারে-এ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার মেসেজ এসে গেল। তখন রাত ১২:১০ মিনিট। সেই মূহূর্তে সেখানে আমি ও আমার বড় ভাই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ আবু জাফরসহ শত শত বুদ্ধিজীবি ও সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন।
২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার সাথে সাথে “জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু” রণধ্বনি কণ্ঠে তুলে যে যেখানে ছিল মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লো। ২৬শে মার্চ শুক্রবার চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে আমার বন্ধু আবুল কাশেম স›দ্বীপ-এর কন্ঠস্বরে “স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র” ঘোষণা চট্টগ্রামবাসীসহ সারা দেশবাসী প্রথম শুনতে পেলেন। সেখান থেকে বারংবার বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা তিনি ও অন্যান্য স্বাধীন বাংলা বেতারের কর্মকর্তারা সংবাদ আকারে প্রচার করতে থাকেন। সেখান থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে দুপুর আনুমানিক ২:০০ টায় চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের নেতা এম. এ. হান্নান, এমএনএ ঢাকা থেকে ২৫শে মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ঘোষিত বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করে দিলেন। আবেগের উচ্ছ¡াসে তিনি বেতার থেকে আরো ঘোষণা করে দিলেন যে, “বঙ্গবন্ধু আমাদের সঙ্গে আছেন এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং ঢাকায় বাঙালি কমান্ডোরা গভর্ণর হাউজে ঢুকে গভর্ণর টিক্কা খানকে হত্যা করেছে।”
২৬শে মার্চ বিকাল ৪টায় আমি চাকসু’র তদানিন্তন ভি. পি. মোহাম্মদ ইব্রাহিম ও মণি ভাই-এর ডান হাত যুবলীগের শীর্ষ নেতা এস.এম. ইউসুফ কালুরঘাট স্বাধীন বাংলা বেতারে পৌঁছি এবং আমি স্বাধীন বাংলা বেতারে যোগদান করি। পরদিন ২৭শে মার্চ স্বাধীন বাংলা বেতারের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বেলাল মোহাম্মদ তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বোয়ালখালী থানার কোড়ালডাঙ্গা পাহাড়ের নীচে অবস্থিত অষ্টম বেঙ্গলসহ মেজর জিয়াকে খুঁজে বের করেন। তাঁর পরামর্শে ও পীড়াপীড়িতে মেজর জিয়া ২৭শে মার্চ কালুরঘাটে আসেন এবং সন্ধ্যা ৭:১০ মিনিটে স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ও নামে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। উক্ত ঘোষণার মুসাবিদা রচনা করেন বেতারের প্রথম উদ্যোক্ত বেলাল মোহাম্মদ এবং অধ্যাপক মমতাজ উদ্দীন। মেজর জিয়ার উক্ত ঘোষণার দেড় ঘন্টা পরে আমি, মোহাম্মদ ইব্রাহিম ও এস. এম. ইউসুফ কালুরঘাট স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে পৌঁছি। সেখানে বেলাল মোহাম্মদ, অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন ও আমার বন্ধু আবুল কাশেম স›দ্বীপকে আমরা দেখতে পাই। তারা সবাই মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করার কথা আমাদের জানান। ৩০শে মার্চ মঙ্গলবার আনুমানিক দুপুর ২ টায় পাকিস্তানী ৩টি স্যাভার জেট এসে কালুরঘাট রেডিও স্টেশনের ট্রান্সমিটারের ওপর আঘাত হানলে কালুরঘাট রেডিও স্টেশন বিধ্বস্ত হয়ে যায়। সেখান থেকে আগরতলার বাগাফা থেকে কিছুদিন স্বাধীন বাংলা বেতারের সাময়িক চলে যান। অতঃপর কোলকাতার বালীগঞ্জে একটি গোপন ভবন থেকে স্বাধীন বাংলা বেতারের প্রচার কার্যক্রম স্থায়ীভাবে চালু হয়।
আমি এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি আগরতলা থেকে কোলকাতা হয়ে ৯ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যোগদান করি এবং জাফলং-এ ২৫ দিনের সামরিক প্রশিক্ষণ শেষে ৯ নম্বর সেক্টরে ক্যাপ্টেন হুদার অধীনে সরাসরি পাক বাহিনীর সাথে সম্মুখ সমরে লিপ্ত হই। তন্মধ্যে কালিঞ্চি নদীর যুদ্ধে আমার বিক্রমগাঁথা ও শৌর্য-বীর্যের সাথে যুদ্ধ করে আহত হবার কথা ৯ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। হাসপাতালে আমার চিকিৎসার পর মে মাসে তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্বাধীন বাংলা বেতারের ওয়ার করেসপনডেন্ট হিসেবে আমাকে নিয়োগ করা হয়। সাংবাদিকের ছদ্মাবরণে আমার গোপন মূল দায়িত্ব দেয়া হয় ওয়ার ফ্রন্টে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ডিফেন্স লাইন ভেদ করে তাদের আধা মাইল/এক মাইল পেছনে গিয়ে তাদের ওপর গোয়েন্দাগিরি করা। এবং সেই সামরিক তথ্য আমাদের সেক্টর কমান্ডার ও ভারতীয় বাহিনীর কমান্ডারদের কাছে পৌঁছে দেয়া। এ কাজ করতে গিয়ে প্রতিদিন আমাকে মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয়েছে।
মুজিবনগর সরকারের চীফ সেক্রেটারী হিসেবে প্রশাসন চালাতেন আমার মামা রুহুল কুদ্দুস, যিনি আগরতলা মামলার অন্যতম আসামী এবং বাঙালির মুক্তিসনদ ৬ দফার রচয়িতা। তিনি ফোর্ট উইলিয়ামে অবস্থিত ইস্টার্ণ সেক্টরের কমান্ডার জেনারেল অরোরাকে বলে দেয়ায় আমার জীবনে একটি ঐতিহাসিক সুযোগ ঘটে। সেখান থেকে যখনই ইন্ডিয়ান আর্মি হেলিকপ্টার যে কোন সেক্টরে যেত, আমি তাতে উঠে যেতে পারতাম। ফলে মে মাস থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সাথে দিন-রাত এক ফ্রন্ট থেকে আরেক ফ্রন্টে উল্কার বেগে চলাচল ছিল আমার। দিল্লির বিবিসি ব্যুরো চীফ মার্ক টালিকে প্রতিদিন মুক্তিযুদ্ধের একটি সফল অপারেশন, একটি পাক সেনাদের টহল জীপ বা ট্রাক ধ্বংসের অথবা খান সেনাদের একটি লঞ্চের ওপর মুক্তিযোদ্ধাদের একটি রকেট লাঞ্চারের শেল নিক্ষেপের সংবাদ না দিতে পারলে সে রাতে আমার ঘুম হারাম হয়ে যেতো। স্বাধীন বাংলা বেতারের পরিচালক শামসুল হক ও প্রোগ্রাম অর্গানাইজার আশরাফ ভাই (রণাঙ্গন ঘুরে এলাম- এর প্রযোজক) বার্তা বিভাগে শ্রদ্ধেয় লোহানী ভাই এবং তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব জনাব আনোয়ারুল হক খান অপেক্ষা করে থাকতেন ফ্রন্ট থেকে আমার পাঠানো একটি সফল অপারেশনের খবরের জন্য। তাই যেখানে যুদ্ধ, যেখানে বারুদের গন্ধ, কামানের কান ফাটা শব্দ, সেখানে আমি উল্কার বেগে মুক্তিযোদ্ধাদের কমান্ডো অপারেশনের সংবাদের জন্য ছুটে যেতাম। পাক সেনাদের ওপর একটি কমান্ডো হামলার সংবাদ এবং একটি পাক সেনাদের ডিফেন্সে বা বাঙ্কারে একটি গ্রেনেড নিক্ষেপের বা একটি কালভার্ট বা ব্রীজ উড়িয়ে দেবার সাফল্যের সংবাদ আমার চাইই চাই। মনে হতো সমগ্র বাঙালি জাতি, সমগ্র বিশ্ব, আমার সংবাদের জন্য কান পেতে অপেক্ষা করে আছে। তদুপরি, প্রতি সপ্তাহে স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে স্বকন্ঠে আমার প্রচারিত “মুক্তাঞ্চল ঘুরে এলাম” ও “রণাঙ্গন ঘুরে এলাম” কথিকা দুটি প্রচারের জন্যেও ওয়ার ফ্রন্টের সংবাদ সংগ্রহ করা আমার জীবনের একমাত্র ব্রত হয়ে উঠেছিল। সেজন্য জীবন তুচ্ছ করে ওয়ার ফ্রন্টে বেপরোয়া ছিলাম আমি। বহুবার মুক্তাঞ্চল ভেদ করে পাক সেনাদের অবরুদ্ধ অঞ্চলে ঢুকে গেছি শুধু একটি সংবাদের জন্য ছাড়াও শত্রু এলাকার গোপন সামরিক তথ্য সংগ্রহের যে গুরুদায়িত্ব ছিল আমার ওপর সেজন্যেও। তখন সকল মুক্তিযোদ্ধাদের ন্যায় আমার চোখের সামনে সব কিছু ছিল অন্ধকার। সব কিছুই ছিল অনিশ্চিত। শুধু নিশ্চিত ছিল স্বাধীনতা। সেই স্বাধীনতার স্বপ্ন চোখে-মুখে এঁকে বহু তরুণ বীর কিশোর আমার চোখের সামনে রণাঙ্গনে রণাঙ্গনে চির নিদ্রায় ঢলে পড়েছে।
সেই স্বাধীনতার বাঁধ ভাঙা জোয়ারে ’৭১-এর তরুণ-কিশোর-যুবকরা তাদের যৌবনের সবটুকু নিঃশেষ করে শত শত রণাঙ্গনে ফুলের মতো যখন ঝরে ঝরে পড়ছিল, তখন জীবন-মৃত্যু দু’পায়ে দলে বহুবার, বহু রণক্ষেত্রে নিঃশব্দে পাক ব্যুহ ভেদ করে চলে যেতাম আমি পাকিস্তানী ঘাঁটি, ডিফেন্সের সামরিক তথ্য সংগ্রহে। দুঃসাহসিক এ রকম বহু সাফল্যের পর অকস্মাৎ আমার জীবনে দুর্ভাগ্য নেমে আসে ৮ নম্বর সেক্টরের চাঁচড়ায়। যখন আমার জীবন-মৃত্যুর ব্যবধান ছিল ১ সুতার ব্যবধান মাত্র। মুক্তিযুদ্ধের জন্য জীবন বিলিয়ে দেবার সেই পুণ্যময় দিনগুলোর ঘটনার বিষয়ে প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজুদ্দিন আহমদ তাঁর রিপোর্টে উলেখ করেছেন “পরবর্তীতে রাষ্ট্রীয় স্বার্থে তাঁকে স্বাধীন বাংলা বেতারের সমর সংবাদদাতা নিয়োগ করা হয়। সংবাদদাতার কাজের পাশাপাশি ফ্রন্টে পাক পজিশন ও ডিফেন্সের তথ্য সংগ্রহের সামরিক গুরুত্বপূর্ণ কাজের ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্ব তাঁকে দেয়া হয়।
এ সেই হিরন্ময় সময়ের কথা। এ সেই পুণ্যময় ’৭১ এর কথা। কোনদিন এমন হয়েছে মাঠ প্রান্তরব্যাপী ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তরুণ, যুবক, বৃদ্ধ মুক্তিযোদ্ধাদের বুলেটবিদ্ধ লাশ। সেসব লাশ অতিক্রম করে ছুটে চলেছে মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী। তাদের সাথে ছুটে চলেছি আমি। কোনদিন এমন হয়েছে নৌকায় খাল-নদী পার হতে হচ্ছে চারদিকে ভাসমান শতশত মা-বোনের ও ভাই-বোনের লাশ। সেসব শহীদের লাশ ঠেলে মুক্তিযোদ্ধাদের নৌকা এগিয়ে চলেছে। কাঁদবার শক্তিও তখন ফুরিয়ে গেছে। জীবন-মৃত্যু তুচ্ছ করে ছুটে চলেছে বীর মুক্তিযোদ্ধারা। সবকিছু তখন ভবিষ্যতের গর্ভে অনিশ্চিত, নিশ্চিত শুধু স্বাধীনতা। কণ্ঠে শুধু জয় বাংলা, আলাহু আকবর।
এভাবে লক্ষ লক্ষ মুক্তিযোদ্ধা ও লক্ষ লক্ষ বাঙালি ভাই-বোনের আত্মদান ও রক্তস্রোতের ওপর স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের দিন এগিয়ে আসতে লাগল। ৩রা ডিসেম্বর বাংলাদেশ ও ভারতের সম্মিলিত মিত্রবাহিনী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নব অধ্যায়ের সূচনা করল। জেনারেল মানেক আকাশবাণীতে ঘোষণা করলেন, “হাতিয়ার ডাল দো। তোমহারা সাথ জেনেভা কনভেনশন তরিকাসে ট্রিট করেঙ্গে। আগর মেরা বাত নেহি মানেঙ্গে তো বহুত মসিবত হোগা। বাঙালি হার মুক্তিসেনা চারো তরফসে তোমকো ঘেরাও কিয়া। আভি তক ওয়াক্ত হ্যায়। হাতিয়ার ডাল দো… ।” পাক সেনাদের বাঙ্কারে ও পজিশনে তখন কান্নার রোল উঠে পড়েছে। “রহিমো, কলিমো… ভাগো, ভাগো, মুক্তি আগিয়া… ভাগো, ভাগো” ভয়ার্ত চীৎকারে রিট্রিট শুরু হয়ে গেছে। ১১টি সেক্টর থেকে আমাদের মহাবীর সেক্টর কমান্ডারদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা বীরদর্পে জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান দিয়ে ঢাকা অভিমুখে মার্চ করে চলল। এসে গেল ইতিহাসের সেই মহত্তম মুহুর্ত। ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শত-সহস্র বাঙালি ভাই-বোনের জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগানের মধ্যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কমান্ডার জেনারেল নিয়াজী, বাংলাদেশ ও ভারতের সম্মিলিত বাহিনীর প্রধান জেনারেল অরোরার কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করলেন।
মুসা সাদিক: সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার এবং স্বাধীন বাংলা বেতারের ওয়ার করেসপন্ডেন্ট
Email: infomusabd@gmail.com, Web: www.musabd.com