আলহাজ্ব এম. এ. কাদের
দেশের উন্নয়নের জন্য, বাৎসরিক বাজেট একটি বড় বিষয়। যে দেশের বাৎসরিক বাজেট যত বেশি, সে দেশ তত উন্নত। চলতি অর্থবছরে অর্থাৎ ২০২০-২১ সালে আমাদের দেশে মোট বাজেট ছিল ৫ ল ৬৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু উন্নয়ন খাতে বাজেট ২লাখ ৫ হাজার ১শ ৪৫ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের প্রায় ৩৬ শতাংশ।
পরিকল্পিত এবং সঠিক সিদ্ধান্তে দুর্নীতিমুক্ত করে উন্নয়ন খাতে ব্যয় করলে এই খাত থেকে বছরে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা বাঁচানো সম্ভব। দেশের বৃহত্তম পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের সর্বশেষ বাজেট ধরা হয়েছে ৩০ হাজার ১শ ৯৩ কোটি টাকা। সেই হিসাবে উন্নয়ন খাতে উদ্বৃত্ত টাকা দিয়ে প্রতি বছর পদ্মা সেতুর মত ১টি সেতু নির্মাণ করেও আরও ২০ হাজার কোটি টাকা বাঁচানো সম্ভব। দেশের উন্নয়ন বাস্তবায়নে, প্রতিযোগিতামূলক ঠিকাদার নির্বাচন করা হলে ও অফিসের পারসেন্টেজ, দুর্নীতি বন্ধ হলে উন্নয়ন ব্যয় কমে আসবে। এতে রাস্তাঘাট, ব্রিজ, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, অফিস-আদালত, নদী শাসনসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ এবং বাস্তবায়িত অবকাঠামো সঠিক রনাবেক্ষনের মাধ্যমে উল্লেখিত উন্নয়ন খাতের কমপক্ষে ২৫% টাকা বাঁচানো সম্ভব।
দুর্নীতির উপর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছেন। এই সাহসী পদক্ষেপ বাস্তবায়নের জন্য সবাইকে এগিয়ে আসা দরকার।
বর্তমান সরকার প্রতিযোগিতামূলক ঠিকাদার নির্বাচন ও দুর্নীতি বন্ধের জন্য ই জি পি পদ্ধতি চালু করেছেন, যেখানে টেন্ডারবাজীদের কোন স্থান নাই। উন্নয়নমূলক কাজ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কিছু কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা কর্মচারী নির্মাণ কাজের বিল দেওয়ার সময় অহেতুক কাজের ভুল-ত্রুটি ধরে ঠিকাদারের নিকট থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায় করে নিচ্ছে। মনে হয় নির্মাণ কাজের বিল পাসের এই পার্সেন্টেজের টাকা তাদের প্রাপ্য পাওনা। ঠিকাদার নির্বাচনের ক্ষেত্রেও নেওয়া হয় নানা কৌশল। নির্ধারিত কিছু ঠিকাদারের সঙ্গে উপরের কর্তাদের সখ্যতা গড়ে উঠায় দরপত্রে প্রতিযোগী না হওয়া বা কম হওয়ার জন্য টার্নওভার সহ অন্যান্য জটিল শর্ত আরোপ করে আইনি মারপ্যাঁচে ঘুরেফিরে কাজ পাচ্ছে কিছু নির্ধারিত ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঠিকাদারী কাজের এই অসম বন্টনে সময়মত কাজ শেষ না করায় নির্দেশ দিয়েছেন, যেন একই ঠিকাদার একসঙ্গে একাধিক কাজ না পায়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশ বাস্তবায়ন হলে দেশে প্রায় ৩০ হাজার বেকার ঠিকাদারের কর্মসংস্থান হবে। বেশির ভাগ ঠিকাদারী কাজ বন্টনের ক্ষেত্রে বার্ষিক কাজের টার্নওভার চাওয়া হয়। টার্নওভার অর্থ বাৎসরিক গড় চুক্তি মূল্য, ঐ বিভাগে বছরে তিনি কত টাকার কাজ করেছেন। এ কারণে সংগতি থাকা সত্তে্বও বেশীর ভাগ ঠিকাদার কাজে অংশগ্রহণ করতে পারে না, ফলে প্রতিযোগিতা না হওয়ায় একই প্রতিষ্ঠান একাধিকবার কাজ পেয়ে থাকে। এ সমস্ত কাজ নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়ন করতে না পারায় অধিক লাভে অন্য ঠিকাদারের নিকট বিক্রয় করে দেয়, আবার কিছু কিছু ঠিকাদার নিজের টার্নওভার যোগ্য লাইসেন্সের মাধ্যমে অন্য ঠিকাদারের টেন্ডার দেওয়ার সুযোগ করে দিয়ে ২% থেকে ৩% লাভ নিয়ে থাকেন। এভাবে ওই ঠিকাদার নিজে কাজ না করলেও তার টার্ণওভার/অভিজ্ঞতা বাড়তেই থাকে। অহেতুক এ টার্নওভার না থাকলে অধিক ঠিকাদারের মধ্যে প্রতিযোগিতা হলে, বুক ভ্যালু থেকে যেখানে ২০% থেকে ২৫% নিম্নদরে বাস্তবায়ন করা সম্ভব, সেখানে অনেক কাজ সমাদরে অথবা ৫% নিম্ন দরে বাস্তবায়িত হয়ে থাকে।
বর্তমান দেশের প্রায় ৫০% থেকে ৬০% ঠিকাদারের কোন টার্নওভার নেই, কারণ তাদের কাজ পাওয়ার সুযোগই রাখা হয়নি। একারণে দেশের প্রায় ৩০ হাজার ঠিকাদার বেকার হয়ে পড়েছে। নতুন ঠিকাদার তৈরীতে এল,টি,এম পদ্ধতি চালু রাখা হয়েছে, যেখানে কিছু কাজে ২ থেকে ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত টার্ণওভার ছাড়া দরপত্রে অংশগ্রহণ করা যায়। কিন্তু সেখানে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রে অংশগ্রহণ করার কোন সুযোগ রাখা হয়নি। সবাইকেই একই দরে বা সমদরে অংশগ্রহন করতে হয়। একারনে কিছু কিছু একক কাজে ৫০০ জন পর্যন্ত ঠিকাদার অংশগ্রহন করে থাকেন। এর মধ্যে লটারীর মাধ্যমে মাত্র একজন কাজ পেয়ে থাকেন। ফলে একজন নতুন ঠিকাদার বছরের পর বছর চেষ্টা করে লাখ লাখ টাকার দরপত্র খরিদ করেও, কাজ না পেয়ে মূলধনহারা হয়ে বেকার হয়ে পড়ে এবং উৎসাহ হারায়। তাছাড়া অভিজ্ঞতা সম্পন্ন একজন ঠিকাদারের দীর্ঘদিন (২৫/৩০ বছর) কাজ করার অভিজ্ঞতা নিয়ে কোটি কোটি টাকার কাজ করা থাকলেও যেকোন কারণে গত ৫ বছরের টার্নওভার না থাকায় তার অভিজ্ঞতার কোন মূল্যই রাখা হয়নি।
দেশে উন্নয়ন মূলক কাজসমূহ সড়ক ও জনপদ বিভাগ, পানি উন্নয়নবোর্ড, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর, এল.জি.ই.ডি, বি.এ.ডি.সি, গনপূর্তঅধিদপ্তর সহ অন্যান্য দপ্তর বাস্তবায়ন করে থাকে। বাস্তবায়িত এসব রাস্তা, বিল্ডিংসহ বিভিন্ন অবকাঠামো, পরিকল্পিত ও সময়মত রনাবেনের ব্যবস্থা না থাকায়, স্বল্প সময়ের মধ্যে তিগ্রস্থ হওয়ায় পূনঃনির্মাণে বাজেটের প্রচুর টাকা ব্যয় হয়। রাস্তা তৈরির সময় দু দিকে ঢাল না রেখে তৈরি করায়, পানি বাধার কারনে রাস্তা অল্পদিনে নষ্ট হয়ে যায়, যা দেখার কেউ নাই। গ্রামের রাস্তার সাথে বার বার একইস্থানে গরু বাঁধার কারনে, রাস্তা নষ্ট হয়ে ভাঙ্গনের সৃষ্টি হয়। এ ছাড়াও রাস্তা এজিং থেকে মাটি সরে ভাঙ্গনের সৃষ্টি হলে অল্প দিনে রাস্তা তিগ্রস্থ হয়। অনেক স্থানে রাস্তার দু পাশে ঘন গাছপালা, বাঁশেরঝাড় বা বাগান থাকায় রাস্তায় আলো তাপ না লাগায় বৃষ্টির পানিতে দীর্ঘ সময় ভিজে থাকায় অল্পদিনে রাস্তাটি দূর্বল হয়ে নষ্ট হয়ে যায়। শহর এলাকায় রাস্তার দু পাশে দোকানপাট, ঘরবাড়ি ও মাটি উঁচু রাখার কারনে রাস্তারপানি বের হতে না পারায়, পানি জমার কারনে রাস্তা নষ্ট হয়। রাস্তারপাশে উচু বিল্ডিং থেকে ছাদের পানি পাইপ দিয়ে রাস্তার উপর একইস্থানে পড়ার কারনে রাস্তা তিগ্রস্ত হয়। তাছাড়া রাস্তায় যে কোন স্থানে ত সৃষ্টি হলে মেরামত না করার কারনে আস্তে আস্তে বড় গর্তের সৃষ্টি হয়ে রাস্তাটির বড় ধরনের তি হয়। বিশেষ করে বর্ষাকালে ঘনঘন বর্ষায় কর্তৃপরে তদারকী না থাকায়, ধারণ মতার অধিক বোঝাই ট্রাক চলাচলে রাস্তা বেশী তিগ্রস্থ হয়। সরকারী বিল্ডিং এর েেত্র পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার অভাবে ছাদে এবং সানশেডে দীর্ঘদিন ধরে ময়লা আবর্জনা জমে আগাছা জন্মে বিল্ডিং এর আয়ু কমে যায়।
এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য অফিস আদালতের অনিয়ম বন্ধ করে প্রতিযোগীতা মূলক দরপত্রের মাধ্যমে ঠিকাদার নির্বাচন করতে হবে। এেেত্র টার্নওভার বন্ধ করে প্রতিযোগী বাড়াতে হবে এবং অফিস আদালতের দূর্নীতি বন্ধ করার জন্য গোপন সংস্থার মাধ্যমে তদন্ত অব্যাহত রাখতে হবে। দূর্নীতি নিরুৎসাহিত করার জন্য দূর্নীতিমুক্ত কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের দ্রæত পদোন্নতি দিতে হবে এবং দূর্নীতিবাজদের পদোন্নতি বন্ধসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। রাস্তার পাশে এজিংয়ের মাটি সম্পুর্ন সরে যাওয়ার পূর্বেই মাটি দিয়ে ভরাট করা, রাস্তায় বহন ক্যাপাসিটির চেয়ে অতিরিক্ত বোঝাই ট্রাক চলতে না দেওয়া, ঠিকাদার নির্বাচনের ক্ষেত্রে টেন্ডারবাজি বন্ধ ও অহেতুক শর্তাবলি শিথিল করে প্রতিযোগিতা মূলক দরপত্র আহবান করা এবং প্রয়োজনে কাজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য টেন্ডার জামানতের টাকা দ্বিগুণ করা যেতে পারে। দরপত্র আহবানের সময় ঠিকাদারের কাজ শেষ করার পরেও আগামী ৫ বছরের জন্য রাস্তার রনাবেনের দ্বায়িত্ব নির্মানাধীন ঠিকাদারের কাছে রাখলেই উক্ত রাস্তাটি ভালো রাখা সম্ভব হবে। এতে রনাবেনের জন্য প্রতিবছরে যে বাজেট রাখা হয় সেটা অনেকাংশে কমে যাবে।
এছাড়াও কাজ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা মূলক দরপত্র আহবান করলে অধিক দরপত্র বিক্রয়ের দরুণ সরকারের আয় অনেকাংশে বেড়ে যাবে এবং দেশে ৩০ হাজার বেকার ঠিকাদারের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। অন্যদিকে দরপত্রে দরের প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হওয়ায় প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় অনেক কমে যাবে এবং দ্রুত কাজ বাস্তবায়ন হবে। বাস্তবায়িত প্রকল্প তিগ্রস্থ হওয়ার পূর্বেই সংরন ও দুর্নীতি বন্ধের পদপে অব্যাহত রাখলে উন্নয়ন খাতের টাকা থেকে প্রতি বছর ৫০ হাজার কোটি টাকা বাঁচানো সম্ভব হবে। এর ফলে করোনাকালীন অর্থনৈতিক তির প্রভার অনেকটা কাটিয়ে, দেশ দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার জন্য দূর্গম পথ আরও সুগম হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
ইমেইল: makader958@gmail.com