দয়াময়ের দুলাল মহর্ষি মনোমোহন

অধ্যাপক শ্যামা প্রসাদ ভট্টাচার্য্য

 

‘মহর্ষি মনোমোহন জ্ঞানযোগী, তাঁর সাধনা হলো-to establish his identity with god’

মহর্ষি মনোমোহন দত্ত বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলাধীন সাতমোড়া গ্রামে ১৮৭৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা পদ্মনাথ দত্ত। ১৯০৯ সালে মাত্র ৩২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন মনোমোহন।

তিনি ছিলেন সাধক, ভাবুক, চিন্তক ও ভাব সংগীত রচয়িতা। তার সৃষ্ট অন্যতম ভাব সংগীত মূলক রচনা ‘মলয়া’ তাঁকে ভাব সংগীত জগতে পর্বতকল্প সমূন্নতা এনে দিয়েছে। ১৩০৩ বঙ্গাব্দে মহর্ষি মনোমোহন সর্বধর্মসমন্বয়বাদী সাধক আনন্দ স্বামীর নিকট দয়াময় নাম মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে দয়াময় নাম প্রচারে মনোনিবেশ করেন। তাাঁর গুরু প্রদত্ত দীক্ষা লাভের পর মনোমোহনের ধর্ম সম্পর্কে উপলব্ধি হল, ‘ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়’- দয়াময় নামেই মানুষের ব্যক্তিগত জীবনকে ধরিয়া আছে। যাহা বিশ্ব ব্রহ্মান্ডকে ধরিয়া আছে, তাহাই ধর্ম।’ আর এই ধর্মের মূলাধার ‘মহা মানব দয়াময়’ যা সর্ব ধর্মসমন্বয়ের প্রতীক এবং প্রত্যয়।

গুরুর আদেশে মনোমোহন তাঁর ৩২ বৎসর জীবনে ভগীরথের ন্যায় শঙ্খ ধ্বনি পূর্বক অভিনব উপায়ে দয়াময়ের মাহাত্ম্য প্রচারের প্রতিটি নিঃশ্বাস নিঃশেষ করে মানব চিত্তে এক অভিনব চেতনার স্রোত প্রবাহিত করে গেছেন। তিনি আলোকিত মানুষ ছিলেন, ছিলেন অমৃতের সন্তান। এই মহা পুরুষ সম্পর্কে নিঃসন্দেহে বলা যায় তিনি মানুষের অন্তরের গণীভূত কলো মেঘ থেকে নির্গত বিদ্যুৎপ্রভা। তাই এই মহাজনের নাম কীর্তনে যদি কিছু পূণ্য হয়, তার সৃষ্টিশীল প্রতিভা। এই আলোক সামান্য দয়াময়ের মানস সন্তান সম্পর্কে বলা যায়,

‘মহাজনো যেন গতঃ’ আমরা সত্য-নিষ্ঠ মহাপুরুষের জীবনাদর্শে উদ্দীপ্ত হয়ে বলবো- ‘তোমার সত্যেও জীবনাদর্শে হয়ে যাবো নীল।’

সাতমোড়া গ্রাম সাধন সহায়ক গ্রাম। এই গ্রামের আকাশে-বাতাসে অসাম্প্রদায়িক চেতনার স্রোত গ্রামটিকে নন্দিত সুষমায় উজ্জীবিত করেছে। এই গ্রামের প্রখ্যাত কালী সাধক ধরনী ধর পালের অঞ্জলি গ্রন্থের ভ‚মিকা লিখতে গিয়ে কুমিল্লা জেলার প্রখ্যাত আইনজীবি উচ্চজ্ঞানাধিকারী, সংগীত বিদ্যায় পারদর্শী চান্দেরচর নিবাসী শ্রী মহেন্দ্র চন্দ্র দেব চৌধূরী বি.এ, বি.এল মহাশয়ের মন্তব্য- ‘‘সাতমোড়া গ্রামে ইতিপূর্বে (ধরনী পালের আগে) লোকপূজ্য মনোমোহন দত্ত সাধন বলে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়া গিয়াছেন। তাই সাতমোড়ার তরুলতা বায়ুতাড়িত আনতশিরে ঈশ্বরের আশীর্বাদ ঘোষণা করিতেছে; ঈশ্বরের আশরীরি আকাশবানী নিয়ত প্রতিধ্বনিত হইতেছে।’’

মহর্ষি মনোমোহন বাংলার সাধনাকাশে অকলনেয় বৃহষ্পতি। তাঁর রচিত খনি গ্রন্থের একটি উক্তি- ‘আত্মানুসন্ধানই সাধনা’ অন্যত্র বলেছেন, ‘ ধর্মেও আড়ম্বর নেই।’ কর্ম সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘সত্য, জ্ঞান, প্রেম, পবিত্রতা একযোগে হইলেই কর্ম পূর্ণ হয়।’ আত্মশাসন সম্পর্কে বলেন, বাহিরের সহিত মিলাইয়া আত্ম শাসন কর।’ আমিত্ব থাকিতে তত্ত্ব জ্ঞান হয় না।’

আর সমাহিত ভাব সম্পর্কে বলেন, ‘তন্ময়তা গাঢ় আইলে সমাধি। এই মহাপুরষ আশ্চর্যরকম সুন্দর করে জীবনের করণীয় সম্পর্কে তাঁর বিশ্বজনীন ধর্ম ধারণার কথা সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করে মানুষকে মানুষ রূপে চিত্রিত করেছেন এবং বলেছেন- ‘‘আমরা সকলে মিলিয়া একটি মানুষ।’’ -তাঁর সাধনার প্রধান লক্ষ্য সত্যের অনুসন্ধান। তাই তিনি বলেন, ‘ সর্বসম্মত ভাবেই সত্য।’ তিনি জানতেন সত্য যেখানে অনুপস্থিত, শিব সেখানে শব।’

তিনি বলেন, সকল জীবেরই দাতা একজন, আর এই একজনই আমাদের উপাস্য। তিনি ‘দয়াময়’।
ভাবো সেই একে!
জলে স্থলে শূন্যে যে সমান ভাবে মিশে
যে রচিল এসংসার আদি অন্ত নাহিতার
সে জানে সকল
কেহনাহি জানে তাকে।’-

মনোমোহন ‘এই তাকে’ জানতেই তাঁর সাধনা স্থল বিল্বতলায় চোখের জল আর প্রাণের টানে তাকে অন্তরে বেঁধে রাখতে চেয়েছেন। এই চেতনা মনোমোহনকে আত্মদর্শী অমৃতের সন্তান রূপে বাংলার সাধনাকাশে অনন্য মহিমায় চির ভাস্বর করে রেখেছে। তাঁর আদর্শ, মানুষ অন্তর দিয়ে গ্রহণ করে তাঁকে মনের মন্দিরে নিত্য সেবা করে যাচ্ছে। তাঁর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে সুরগুরু ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা যন্ত্রগুরু আপ্তাব উদ্দিন খাঁ (সুরকার), ওস্তাদ গুল মোহাম্মদ, নিশিকান্ত সেন, লবচন্দ্র পাল শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। পাথেয়, ময়না, পথিক, যোগপ্রণালী, খনি তাঁর উল্লেখযোগ্য সৃষ্টিকর্ম।

মলয়া সংগীতে মনোমোহন:

মনোমোহন দত্তের অসামান্য কীর্তি ‘মলয়া’ নমাক সংগীত গ্রন্থ। দুই খন্ডে বিভক্ত ‘মলয়া’ সন্নিবেশিত গানের সংখ্যা যথাক্রমে ২৮৭ এবং ১৩৯টি। বাংলার সংস্কৃতি ও ললিতকলায় সংগীত এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সমালোচকের ভাষায় ‘Music is the highest art those understand it is the highest worship’।

মনোমোহনের মলয়ার গান বাংলার ললিতকলার উদ্যানে সুরভিকুসুমের মতো বর্ণে ও সৌরভে অসাধারণ। বঙ্গজননীর ভান্ডারে সংগীত তাই মানব চিত্তে শিহরণ জাগানো এক অসামান্য শিল্পকর্ম।

সংগীত সম্পর্কে প্রাচীন শাস্ত্রীয় গ্রন্থে উল্লেখ আছে-
জপ কোটিগানং ধ্যানং ধ্যানকোটি গুনংলয়ঃ।
লয় কোটি গুনং গানং গানাৎ পরতর নহি।।

এই উক্তির আলোকে আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি মলয়ার গান মানুষেরে হৃদয়ে যে অনাস্বাদিত পুলক সৃষ্টি করেছে তার কোনো বিকল্প নেই। এই আত্মতত্ত্বজ্ঞ সাধক বহু আঙ্গিকে সংগীত রচনার মাধ্যমে মানুষের অন্তরের চিরন্তন আবেগের বাণীরূপ দান করেছেন। এখনও তাঁর গান শুনে শ্রোতা ক্ষুধায় অন্ন, তৃষ্ণায় জল, অন্ধে ষষ্টির এবং পথভ্রান্ত আলোক রশ্মির সন্ধান পায়।

তাঁর শ্যামা সংগীতের অনিন্দ্য সুন্দর ভাবগাম্ভীর্য ভক্তের মর্মস্পর্শী প্রাণের কথা স্বভাব সুলভ সুন্দর বাণী ভক্তিতে শাশ্বত রূপ লাভ করেছে। মনোমোহনের শ্যামা সংগীতের মুর্চ্ছনা সবাইকে দিব্যভাবে উদ্বুদ্ধ করে-

বেলা গেল সন্ধ্যা হল,
আমায় ডেকে নে মা কোলে
এমন সময় বল দেখি মা
কে কার ছেলে মাকে ভুলে
আমি কান্দি মা মা বলে।
অথবা,
মন যাবি যদি মায়ের কোলে
সরল মনের গরল অংশ, বেছে বেছে দে না ফেলে।

মহর্ষির ইসলাম বিষয়ক গান গুলো আপন বৈশিষ্টে সমুজ্জ্বল। আরবি-ফারসি শব্দের এমন সচেতন প্রয়াস সাহিত্য ক্ষেত্রে কমই লক্ষ্য করা যায়-
আদমখোদা মইত কহজি-
নূরছে আদম বানায়া, একদম জোদা নেহি।

সমালোচক, অধ্যাপক শেখ সাদীর ভাষায়- ‘ইসলাম ধর্মের বিধিবিধান রীতি নীতি, ঐশী বাণী প্রভৃতি প্রসঙ্গও নিপুন কুশলতায় ফুটে উটেছে তাঁর সংগীতে;
গায়েবী আওয়াজ কয়, শুনরে মুসলমান,
আখেরে দুনিয়া ফানা, রাখবে ঈমান।
চুরি করা, মিছা কওয়া, বেসরা বেপরদা হওয়া
পরহেজ সবুরে মেওয়া কোরানে ফরমান।

মহর্ষি গুরু বিষয়ক সংগীত, বাউল আঙ্গিকের সংগীত ও ‘মনকে সংযত’ রাখার বিধান এই সংগীতগুলো যেন তৃষিতের বারি-
আমার মন কেনরে ঘুরে
অধম তারণ গুরুর চরণ রাখ হৃদয় মাঝারে।

অথবা, গুরুকল্প তরু মূলে, আশ্রয় নিয়ে বসে থাক মন আমার কৌতুহলে, মনকে নিয়ে সংশয় থেকে মুক্তিপেতে মনোমোহন লেখেন-
আমার মনপাখি মিশিতে চায়, যেয়ে ঐ সব পাখির দলে।
অথবা, ‘পোষ মানে না জংলার পাখি।’
এসব গানতো শুধু গান নয়, এযেন কবি গুরুর শান্তিবর্ষণকারী বারিধারা।

মলয়া গানে অনেক ভাব, অনেক মাধুর্য, অনেক দর্শন প্রতিভাত হয়েছে। মলয়া ভাব জটিল নয়, সরল, চিত্তমনোহারী, আর ভাষা ভঙ্গীও সুন্দর সাবলিল, ছন্দ ঝংকারে, ঝর্ণা ধারার মতো বেগবান, বিষয় বন্ধুর নয়, মধুর। মলয়ার সংগীত যে পরম কারুনিক দয়াময়ের উদ্দেশ্যে উৎসগীকৃত। আশা করব তিনি করুণা করে মলয়ার প্রসাদীপ্রসূণ গ্রহণ করবেন। আমরা শান্তি চাই, মনোমোহনের অন্বিষ্টত্ত শান্তি। তাই শান্তি বচনের মাধ্যমে তাঁর রচিত একটি গানের চরণ উদ্ধৃত করে নিবন্ধ শেষ করছি। কারণ মহর্ষি মনোমোহনের জীবনাদর্শ শান্তি-

“খুলে দাও শান্তির দুয়ার
কাছে বসে থাক তুমি সর্বদা আমার
করাঘাতে হাতে বেদনা প্রচুর, ডেকে ডেকে বুকে
বেজে গেছে সুর
নিশি ভোর ভোর হের চিত্ত চোর
বড়ই কঠোর অন্তর তোমার।”

তথ্য ঋণ: চরিতাভিধান- পশ্চিমবঙ্গ একাডেমী এবং লীলা রহস্য।

অধ্যাপক শ্যামা প্রসাদ ভট্টাচার্য্য: গবেষক, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, শ্রীকাইল সরকারি কলেজ, কুমিল্লা।

Print Friendly

Related Posts