এম. এ. কাদের
দেশে প্রায় ১৫ থেকে ২০ হাজার, কারো মতে এর থেকে অনেক বেশি হিজড়া অনিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপন করছে। তারা জীবনযাপনের জন্য ভিক্ষাবৃত্তি, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অসামাজিক কাজকর্মে জড়িয়ে পড়ছে। এ সমস্ত হিজড়াদেরকে প্রশিক্ষণ ও লেখাপড়ার মাধ্যমে বিভিন্ন কর্মের জন্য উপযুক্ত করে গড়ে তুললেই তারা সমাজের বোঝা নয়, বরং দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারবে।
২০১৪ সালে বর্তমান সরকার হিজড়াদের সাংবিধানিক এবং আইনগতভাবে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তাদের ভোটাধিকারসহ সকল নাগরিক অধিকারও দেওয়া হয়। কিন্তু হিজড়াদের প্রতি এখনো সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়নি। তাদের কাগজে-কলমে কিছু অধিকার আছে বটে, কিন্তু বাস্তবে স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় তারা অবহেলিত। অর্থাৎ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আমাদের সম্মিলিত অন-উদারতাই তাদের জীবনকে অভিশপ্ত করে রেখেছে।
হিজড়াদের প্রতি পদে পদে বিড়ম্বনার স্বীকার হতে হয়। বাড়িওয়ালা বাড়ি ভাড়া দিতে চায় না, দিলেও বাড়তি ভাড়া আদায় করে। তাছাড়া চলাফেরার সময় অনেকে তাদের প্রতি কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য ছুঁড়ে দেয়। তাই, হিজড়াদের দোষ ধরা নয়, এখন আমাদেরই তাদের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। তাদের জন্য প্রস্তুত করতে হবে একটি মানবিক সমাজ, যে সমাজ লৈঙ্গিক পরিচয়ের কারণে কাউকে অচ্ছুৎ করে রাখবে না। যে সমাজ হিজড়াদেরকেও নারী ও পুরুষের মতই সমান মর্যাদায় বুকে টেনে নেবে। শুধু ভিক্ষাবৃত্তি নয়, হিজড়াদের কর্মের সুযোগ সৃষ্টি করে কর্মে নিয়োগ দিতে হবে।
সকল ছেলে-মেয়েই উত্তরাধিকার সূত্রে বাবা-মার সম্পত্তির ভাগ পেয়ে থাকলেও বাংলাদেশে উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী পরিবারিক সম্পত্তি ভাগের ক্ষেত্রে হিজড়াদের ভাগ পাওয়ার সুনির্দিষ্ট কোন নিয়ম নেই। এছাড়া পরিবারের সদস্য এবং সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিও এ বিষয়ে ইতিবাচক নয়।
বাংলাদেশে বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের পারিবারিক সম্পত্তি ভাগাভাগির ক্ষেত্রে প্রেক্ষাপট মিলিয়ে স্ব স্ব ধর্মের আইন ব্যবহার হয়ে থাকে। ইসলাম ধর্মের মানুষের সম্পত্তি ভাগাভাগি হয় মুসলিম উত্তরাধিকার আইনের আওতায়। ১৯৬১ সালের মুসলিম উত্তরাধিকার আইন বাংলাদেশে কার্যকর রয়েছে। সেই আইনে হিজড়াদের সম্পত্তির ব্যাপারে সুস্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘পিতা-মাতা এবং আত্মীয়স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে পুরুষের অংশ আছে এবং পিতা-মাতাও আত্মীয়স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে নারীরও অংশ আছে, উহা অল্পই হোক অথবা বেশিই হোক, এক নির্ধারিত অংশ’ (সূরা নিসা, আয়াত ১৭৬ পারা-৪)। হিন্দু ধর্মাবলম্বী, খ্রীস্টান এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের উত্তরাধিকারের প্রশ্নে কিছু বিধি বাংলাদেশে কার্যকর রয়েছে। কিন্তু সে সব ধর্মেও হিজড়াদের সম্পত্তির অধিকারের ব্যাপারে স্পষ্ট করে কিছু বলা নাই। বাবা-মার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হয়ে সমাজে ঠাঁই না হওয়ায় তারা বাড়ি ছাড়া হয়ে ১৫ থেকে ২০ জনের গোষ্ঠী গড়ে তোলে।
হিজড়া সন্তান সমাজে উচু, নিচু, ধনী, গরীব, অভিজাত, বনেদী যেকোন পরিবারেই জন্মগ্রহণ করতে পারে। কাজেই এদেরকে অবহেলা করার কোন সুযোগ নেই। সমাজে তাদের মর্যাদা না থাকায় পরিবারও তাদেরকে কাছে রাখতে অনীহা প্রকাশ করে। আর এই অবহেলার কারণেই শিক্ষা-দীক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়ে জীবন বাঁচানোর তাগিদে তারা অন্ধকার পরিবেশে দলবদ্ধ হিজড়া দলে যোগ দেয়। আমাদেরই সন্তান, তাদের চাওয়া পাওয়া তেমন কিছু না থাকলেও শুধু খাদ্য সংগ্রহের জন্য তারা হাট-বাজারে, বাস টার্মিনালে, রেলস্টেশনে, ফেরিঘাটে, পার্কে ভিক্ষাবৃত্তি, এমনকি অশ্লীল বাক্য ব্যবহার করে চাঁদাবাজি করে থাকে।
তৃতীয় লিঙ্গের এ মানুষগুলোকে অবহেলার চোখে না দেখে প্রতিযোগীতার মাধ্যমে নয়, নিশ্চিত কর্ম নির্ধারণ করে দিলেই তাদের পরিবার এবং সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না। রাষ্ট্রীয় আইন সংশোধনের মাধ্যমে বাবা-মার সম্পত্তিতে অন্যান্য সন্তানদের মত হিজড়াদের সমান অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষাগত যোগ্যতার উপর ভিত্তি করে ৮ম শ্রেণি থেকে এসএসসি পাশ করলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আয়া, পিয়ন থেকে শুরু করে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সেবামূলক প্রতিষ্ঠান যেমন- হাসপাতালে নিয়োগের সুযোগ নিশ্চিত করলে তাদেরকে পরিবার তথা সমাজ মূল্যায়ণ করবে। ভিক্ষাবৃত্তি, চাঁদাবাজিসহ অন্যান্য অসামাজিক কার্যকলাপ বন্ধ হবে, ফলে মানুষও হিজড়াদের দ্বারা বিড়ম্বনার হাত থেকে রক্ষা পাবে এবং দেশের উন্নয়নেও তারা ভূমিকা রাখতে পারবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
ইমেইল: makader958@gmail.com