মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নে অন্যতম উপায়ঃ পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও উপযুক্ত ভালোবাসা

ম্যাকি ওয়াদুদ

আদিকাল থেকেই আমরা মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করে আসছি। তাই মানুষকে সামাজিক জীব বলতে কোন দ্বিধা নেই। মানুষ খুব বেশি সঙ্গীপ্রিয়ও বটে। সঙ্গী ছাড়া মানুষ বেশি দিন সুখ-শান্তি ও সুন্দরভাবে জীবন-ধারণ করতে পারেনা। মানবপ্রেমে এই সঙ্গী শুধু কোন ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়, ব্যক্তির সাথে-সাথে কোন বিশেষ বস্তু-ও মানুষের আবেগ, প্রেম, ভালোলাগা, অপছন্দ-হতাশাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।

একজন মানুষের মস্তিষ্কের প্রধানত দুইটি দিক যেমন গুরু ও লঘু মস্তিষ্কই জীবনের সফলতা ও ব্যর্থতার জন্য দায়ী। গুরু মস্তিষ্ক মানুষের আবেগ-বিবেকের অনুভূতি গ্রহণ ও বিশ্লেষণ এবং তার ভিতরের সৃষ্টিশীল ইচ্ছাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে মানসিক বোধকে নিয়ন্ত্রণ করে। এবং লঘু মস্তিষ্ক মানুষের চলাফেরা, মনোযোগ, ভাষা, রাগ-অভিমান এবং বিভিন্ন শারিরীক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নড়াচড়া এসব কিছুকে নিয়ন্ত্রণ করে। এজন্যেই মানুষের শিশুকাল থেকে পৌড়ত্ব ও বার্ধক্যের আটটি স্তরের প্রতিটি ধাপের সাথেই জড়িয়ে আছে আমাদের শারিরীক ও মানসিক স্বাস্থের উন্নতি ও অবনতি।

ভালোবাসা-প্রেম একজন মানুষকে যেমন করে সুখ-শান্তি দেয় তেমনি করে অবহেলা ও হতাশা জীবনের পরম প্রাপ্তিগুলো থেকে তাড়িত করে। এজন্যেই ইতিবাচক ও নেতিবাচক এই দুই ধরণের মানুষ দ্বারা প্রতিনিয়ত পরিচালিত হচ্ছে আমাদের পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামো।

মানসিক ও শারিরীক সুস্থতাই একজন মানুষকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে সহযোগিতা করে। আমাদের চারপাশের পরিবার-সমাজ–রাষ্ট্রের মানুষগুলোর উপর নির্ভর করে আমাদের মনোজগতের বিকাশ। মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক না থাকলে শারিরীক স্বাস্থ্য ভারসাম্যহীন ও জর্জরিত হয়ে পড়ে। মানুষের জীবনধারণ, আচার-আচরণ, অভ্যাস, কৃষ্টি-কালচার, জীবন-জীবিকাসহ সকল মৌলিক চাহিদাসমুহ সঠিক ও সুস্থ্য-সুন্দরভাবে প্রতিষ্ঠার জন্য সৃষ্টি হয়েছে পরিবার-সমাজ ও রাষ্টের নানা নিয়মকানুন ও বিধি-নিষেধ। এই অপরুপ সুন্দর পৃথিবীর রং-রূপ ও গন্ধ-সৌন্দর্য সবকিছু আহরণের জন্য যেমন করে প্রতিটি মানুষের সমান অধিকার রয়েছে ঠিক তেমনি করে সমাজের এই কঠিন বাস্তবতায় বেঁচে থাকা ও বেড়ে উঠায় এবং প্রতিটি কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ ও অবদানে রয়েছে সমান সুযোগ ও অধিকার।

আমাদের সমাজের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির মানুষগুলোর মধ্যে যারা নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ তারা-ই দেশের পরিবার-সমাজ ও রাষ্ট্রর সমস্ত কিছুর নিয়ামক ও ভিত্তি নিয়ন্ত্রিত বা পরিচালিত করছে। যে পরিবার-সমাজ ও রাষ্ট্র বাবস্থায় সামষ্ঠিক বলতে সকল মানুষকে সমান সুযোগ ও উপযুক্ত মর্যাদা বা মূল্যায়নের মাধ্যমে পরিচালিত করে সেই সমস্ত দেশ ও সমাজের জনগোষ্ঠী সুখ-শান্তিময় জীবন ধারণ করতে পারে। আর যে সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার ধারক বা বাহক ও নেতৃস্থানীয় এবং ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা নিজেদের একক স্বার্থকে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে পরিচালনা করে সে সমাজের মানুষের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাব বেশি কাজ করে। যার কারণে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির উপর আমাদের মানসিক সুরক্ষার বিষয়টি পুরোপুরি নির্ভর করছে।

আমরা যে সমাজে বা পরিবেশে বাস করছি তা নির্দিষ্ট বিধি-নিষেধ ও নিয়ম-কানুন দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। সমাজে বাস করছে নানা শ্রেণি-পেশা ও জাত-গোষ্ঠির মানুষ। এক এক শ্রেণি পেশার ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, চালচলন, আচার-আচরণ ও কর্মকান্ডে ভিন্নতা রয়েছে। শুধুমাত্র বেঁচে থাকাসহ অন্যান্য সকল প্রকার চাহিদা মেটানোর জন্য আমরা সকল মানুষ সমাজের একই ছাতার নীচে সংঘবদ্ধ ও সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করি। আমরা বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ একসাথে থাকি বলে একে অপরের কার্যক্রম, আবেগ-বিবেক, ইচ্ছা-অনিচ্ছা, আগ্রহ ও প্রেম-ভালোলাগাকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন ও মর্যাদা দিতে পারিনা। সেকারণেই সারাক্ষণ সমাজের মধ্যে মানুষ-মানুষে এবং পরস্পর-পরস্পরের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ, হিংসা-বিদ্বেষ, অন্যায়-অত্যাচার লেগেই আছে ।

মানুষ শুধুমাত্র নিজে বা নিজের গোষ্ঠির উন্নতি নিয়ে ভাবলেই নিজেকে খুব মহান মনে করছে। ব্যক্তিগত স্বার্থপরতা বা ভাবনা সামাজিক এই সংঘবদ্ধ মানুষের সামগ্রিক উন্নয়নে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সেই জন্যে মানুষ নিজের স্বার্থের বাইরে গিয়ে সামষ্ঠিকভাবে ভাবতে পারেনা বিধায় মনে এক ধরণের হতাশা, রাগ-অভিমান, হিংসা-বিদ্বেষ কাজ করে। যার জন্যে এক জাত-গোষ্ঠির মানুষ অন্য জাতি-ধর্মের মানুষকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন বা মর্যাদা এবং তাদের কাজের স্বীকৃতি দেয়না। ফলশ্রুতিতে পরিবার-সমাজ ও রাষ্ট্রের একশ্রেণির মানুষ যারা দিনকে দিন শোষণ-বঞ্চনা ও অবহেলার শিকার হয়ে মূল-শ্রোতধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তারা পরিবার বা সমাজের এই অন্যায় অত্যাচার ও বৈষম্য মেনে নিতে পারেনা। তাই তার ভিতরে গুরুমস্তিষ্কের ভাবনা থেকে লঘু মস্তিস্কের ভাবনা বেশি কার্যকর হয়ে প্রকট আকার ধারণ করে। এতে করে মানুষ শারীরিক ও মানসিক অসুস্থ্য হয়ে পড়ে এবং প্রতিবন্ধিতার শিকার হয়ে পরিবার-সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে অবহেলিত ও অযোগ্য হয়ে পড়ে।

আমাদের এই ঘুনেধরা ক্ষুয়িষ্ণু ও কুসংস্কারচ্ছন্ন সমাজ ব্যবস্থায় মানুষ একে অপরকে সহজভাবে গ্রহণ ও মূল্যায়ন করতে পারেনা বলে সমাজে নানান সমস্যা বিদ্যমান রয়েছে। পরিবার ও সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের ব্যক্তিগত আগ্রহ ও স্বার্থ-চরিতার্থ করার লক্ষ্যে নিজের দোষ অন্যের কাঁধে চাপিয়ে দিতেও কুন্ঠাবোধ করেনা। মানুষ নিজেকে সমাজের মধ্যে সবচেয়ে সেরা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য তার চারপাশের জগৎকে নিজের মতো করে সাজিয়ে নেয়। এতে করে সমাজের অন্য জাত-গোষ্ঠি বা ভাষা-সংস্কৃতির জনগোষ্ঠির মর্যাদা, সমতা, অধিকার , সম্মান লঙ্ঘিত হলেও তাদের কিছু যায় আসেনা।

তাছাড়া দীর্ঘকাল ধরে মানুষ নিজেকে বা চারপাশের জগৎ-কে নিজের নিয়ন্ত্রানাধীন করার জন্যে কিছু যুক্তিহীন ধ্যান-ধারণা, ধর্মীয় বিধি-নিষেধ, অবৈজ্ঞানিক ও অপ্রামাণ্য যুক্তি এবং কুসংস্কার লালন করে আসছে। মানুষ বংশ পরস্পরায় ও যুগযুগ ধরে যা বিশ্বাস করে আসছে তা অধীনস্থদের মধ্যে প্রযোগ করে নিজে সুখ-শান্তির জগতে আরোহন করতে বড়ই উচ্চাকাঙ্খী। মানুষ দৈনন্দিন বিভিন্ন ব্যক্তিগত কর্মকান্ডসহ সমাজ-সংসার ও সামাজিক বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানে তাদের মনগড়া রীতি-নীতি ও ভ্রান্ত ধারণা, বিশ্বাস এবং প্রথাগুলো প্রযোগ করতে খুব স্বাচ্ছন্দবোধ করে। এই সামাজিক কুসংস্কার বা ভ্রান্ত রীতি-নীতিসমুহ আমাদের পরিবারিক ও সামাজিক জীবনের সর্বক্ষেত্রে আষ্টেপিষ্ঠে জড়িয়ে আছে। আমাদের গ্রামিণ সমাজে এই সামাজিক কুসংস্কার বা সোস্যাল স্টিগমা বেশি পরিলক্ষিত হলেও ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ভালো-মন্দ ও জ্ঞানী-মূর্খ মানুষের মধ্যেও তা কমবেশি প্রভাবিত হয়। মানুষের মধ্যে এই কুসংস্কার ও ভ্রান্ত বিশ্বাস থাকার ফলে তারা নিজেকে সময় ও যুগের সাথে হালনাগাদ করে নিতে পারেনা এবং নতুন-নতুন কলাকৌশল ও বৈজ্ঞানিক প্রামান্যক যুক্তি বিশ্বাসে নিজেকে বদলাতে পারেনা।

সামাজিক ও সংঘবদ্ধ এই পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা জীব মানুষের মানসিক প্রতিবন্ধিতার অন্যতম প্রধান দুইটি কারণের মধ্যে প্রথমটি হলো পরিবার ও সমাজের রন্ধ্রেরন্দ্রে ছড়িয়ে থাকা কুসংস্কারসহ কুপ্রথা ও কুবিশ্বাস এবং দ্বিতীয়টি হলো – পারিবারিক ও সামাজিক অবজ্ঞা-অবহেলা, পারস্পরিক দ্বন্দ-সংঘাত, শোষণ-বঞ্চনা এবং হিংসা-বিদ্বেষ ও বৈষম্য-অবমূল্যায়নসহ ব্যক্তিগত বিশেষ কোন বস্তু বা আগ্রহের প্রতি আসক্তি। যার ফলে মানুষ পরিবার ও সমাজ-সভ্যতা এবং নিজের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে নিজেকে তার স্বপ্নের জাগরণের বিমূর্ত প্রতীক মনে করে সমাজ-সংস্কৃতি থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে রাখে। তখন তাদের খুব স্বাভাবিক কোন কার্যক্রমও তার পারিপাশ্বিক জগৎ-সংসারের মানুষরা সহজভাবে মেনে নিতে পারেনা।

এমনকি ওই মানুষগুলোকে পরিবার ও সমাজর কাছে পাগল, উম্মাদ, সাইকো বা মানসিক রোগী হিসেবে কটুক্তি বা আখ্যায়িত করে থাকে। এমনকি তাদেরকে ভিন্ন গ্রহ বা অন্য জগতের মানুষ মনে করে পরিবার-সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে এবং সংস্পর্শ ত্যাগ করে। ফলশ্রুতিতে কিছু প্রতিভাবান বা প্রগতিশীল ধ্যান ধারণার ভালো মানুষরা সমাজের এসব অসামাজিক ও রীতিবিরুদ্ধ কার্যক্রম এবং সামাজিক নিগ্রহের জ্বালা-যন্ত্রণা মেনে নিতে পারেনা। তাই তারা মানসিক অসুস্থ হয়ে ওই পরিবার বা সমাজে মানসিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি হিসেবে পরিগনিত হয়। আমরা সমাজের সভ্য মানুষগুলোই এই মানসিক প্রতিবন্ধিতার জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দায়ী।

মানসিক সমস্যা একটি সাধারণ ও স্বাভাবিক ব্যাপার। একজন মানুষ নানা অনাকাঙ্খিত বিষয় সঠিকভাবে বুঝতে একটু অসুবিধা হতেই পারে এবং সমাজের অন্য সকলের সাথে তার মতের মিল নাও থাকতে পারে। এই জন্য সে পাগল হয়ে যেতে পারেনা। আমরা সমাজের মানুষগুলো একটি পিছিয়েপড়া বা দূর্বল প্রকৃতির মানুষদের খুব সহজে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারিনা। আবার আমরা সুস্থ্য স্বামর্থবান মানুষগুলো হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ-লালোসার কারণে অন্য মেধাবী ও সহজ-সরল মানুষগুলোকে বিভিন্ন ফাঁদে ফেলে কলঙ্কিত করার চেষ্টা করি এবং ক্রমান্বয়ে চাপ প্রয়োগ করি। যাতে করে কিছু ভালো মানুষ সমাজের কুচক্রি মানুষগুলোর এহেন অবমাননা ও অপমান সহ্য করতে না পেরে সে সমাজ থেকে নিজের জগতে চলে যায় বা হতাশ হয়ে পড়ে।

সাধারণত মানুষ দীর্ঘমেয়াদী মানসিক সমস্যার কারণে শারীরিকভাবেও অসুস্থ্য হয়ে পড়ে। ধীরে-ধীরে ঐ মানুষগুলো সমাজের মূল জায়গা থেকে ছিঁটকে পড়ে এবং হতাশ হয়ে পড়ে ও ডিপ্রেশনে ভুগে। এই কারণে বেশির ভাগ মানুষ নিজের উপর আত্ম-অভিমানে ভূগে এবং কিছু কিছু হতাশাগ্রস্থ মানুষ আত্মহত্যার মতো মহাপাপমূলক অপরাধ করতেও দ্বিধা করেনা। আত্মহত্যা মহাপাপ হিসেবে আমরা জানি এবং এটিকে আমরা নিতান্তই ব্যক্তিগত সমস্যা হিসেবে মনে করি। কিন্তু এটির জন্য সম্পূর্ণভাবে দায়ী আমাদের সমাজ ব্যবস্থা। মানুষ সামাজিক জীব হিসেবে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় শাসন-অনুশাসন ও নিয়ম-নীতির আলোকেই পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। তাই আত্মহত্যা একটি সামাজিক অপরাধ ও সামাজিক সমস্যা। ডিপ্রেশন বর্তমান সময়ের একটি নিভৃতের আত্মঘাতী সমস্যা। সমস্যাটির দিকে বিশেষ গুরুত্ব না দিলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বংশানুক্রমে নানা জটিলতার সমস্যা নিয়ে পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হবে।

বর্তমান সময়ে মানুষের নিভৃতে চলছে হতাশার মহামারী। দায়িত্বের খাতিরে দায়িত্ব পালনে ছুটে চলছে মানুষ নামের শ্রেষ্ঠ জীব। ডিপ্রেশনের কারণে মানুষের মাঝে বেড়েছে নিঃসঙ্গতা,। কমেছে মায়া মমতা। এ বিষয়ে দেশের নীতি নির্ধারণী পর্যায়সহ সকলের যেন কোন গুরুত্ব নেই। আমরা নিভৃতে অবস্থান করছি অসহায়ত্ব।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ”মরিতে চাহিনা আমি এই সুন্দর ধরণীতে”। মানুষ সবচেয়ে ভালোবাসে নিজেকে। স্বাভাবিকভাবে অল্প দূঃখ-কষ্ট ও বিরহ-যাতনায় মানুষ দগ্ধ হয়ে আত্মহত্যায় প্ররোচিত হয়না। আমরা যখন দেখি এই সুন্দর পৃথিবীতে নিজের অবদান বা স্বীকৃতি অগ্রাহ্য অথবা অযোগ্য এবং পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র আমাদের অকার্যকর মনে করে তখনই নিজের সবচেয়ে প্রিয় প্রাণও বিসর্জণ দিতে কুন্ঠা বোধ করিনা। এবং মানুষ যখন দেখে তাঁর বেঁচে থাকার আর কোন ন্যুনতম কারণ থাকতে পারেনা তখনই আমরা এই নীলগ্রহটির ভালোবাসা বা মায়া ত্যাগ করে অসীমের সুখশুধা পানে বিভোর হই। বিভিন্ন কারণে সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের কাছে শান্তির এই ধরণী বিষাদ এবং ভালোবাসাহীন হয়ে উঠে। এছাড়া নানা কারণে মানুষ আত্মহত্যা করে, মানসিক চাপ, হতাশা অবসাদ, আত্মবিশ্বাসের অভাব। সব মিলিয়ে ডিপ্রেশন।

বিশেষ করে এই ডিপ্রেশনটি আসে মানসিক নির্যাতন থেকে। শারিরীক নির্যাতন থেকে মানুষের মনে আঘাতকারী বা নির্যাতনকারীর প্রতি প্রতিশোধ স্পৃহা দেখা দিলেও মানুষ নিজেকে দমন করতে পারে। এবং বিশেষ করে মানসিক নির্যাতন ও অপমানে মানুষ অবসাদগ্রস্থ হয়ে অভিমানে নিজের জীবন নাশ করতেও দ্বিধাবোধ করেনা। পৃথিবী তখন বিষাদ হয়ে উঠে, প্রচন্ড বুকে দহন জ্বালা, যা কাউকে বলা যায়না, এ কারণেই মানুষ বেশি আত্মহত্যা করে। মানুষের জীবন ও জীবিকার মান উন্নয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত সকল অনুসঙ্গ তথা পরিবার-সমাজ ও রাষ্ট্রের নীতি-রীতিকে মনুষ্যবান্ধব একটি শান্তিপ্রিয় সমাজ বিনির্মাণ করতে পারলে সমাজ থেকে আত্মহত্যার ঝুঁকি কমে যেতে পারে। পৃথিবীতে আগে মানুষ সৃষ্টি হয়েছে তারপর খুব ধীরে-ধীরে মানুষ নিজেদের প্রয়োজনে পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছে। তাই সমাজ থেকে আত্মহত্যা নামক ভয়ানক ব্যাধি চিরতরে নির্মূল করতে হলে মানুষের আত্মাকে চিরস্থায়ী তৃপ্তিদান আবশ্যক। মানুষ প্রকৃতির সন্তান। আমাদের চারপাশের প্রকৃতিকে সবুজ ও সজীব এবং মনুষ্য বসবাসের যোগ্য ও নিরাপদ করতে পারলে এই সুন্দর পৃথিবীর প্রতি মানুষের আকর্ষণ বাড়বে।

সাম্প্রতিককালের ভয়াবহ নোভেল-করোনা – কোভিড-১৯ এর মতো বিধ্বংসী সর্বনাশী ভাইরাসটিও আত্মহত্যার কারণ হতে পারবেনা। আমরা মনুষ্য সমাজ যেমন করে নিজের জীবনকে ভালোবাসি ঠিক তেমনি পরিবার-সমাজ ও রাষ্ট্র-বিশ্ব এবং পৃথিবীকেও সমানভাবে ভালোবাসি। আত্মহত্যা প্রতিরোধ করতে আগে চাই আমাদের শান্তিপ্রিয় সহজ-সরল মানুষগুলোকে মানসিক প্রতিবন্ধিতার প্রকোপ থেকে রক্ষা করা। আমরা আমাদের সমাজ ও চা্রপাশের মানুষগুলো সকলকে একই মনোজতের মধ্যে প্রবেশ করার জন্য বদলাতে হবে আমাদের সামাজিক রীতিনীতি এবং দৃষ্টিভঙ্গি। নিজেকে ও পরিবার এবং সমাজ ব্যবস্থাকে সাবধান সচেতননতার মাধ্যমে সময় ও যুগোপযোগী করতে পারলে মানুষগুলো ক্ষমতায়িত হবে এবং সমাজের সর্বস্তরের মানুষ সুখী সমৃদ্ধিশালী জীবন গড়ে তুলতে পারবে।

আমাদের দেশে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নের লক্ষ্যে তেমন কোন ভূমিকা নেই বললেই চলে। সরকারি জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনষ্টিটিউট এবং পাবনা মানসিক হাসপাতাল থাকলেও সেখানে মানসিক প্রতিবন্ধী বা সমস্যাযুক্ত রোগীদের কোন চিকিৎসা ও সেবা নেই। যে সেবা ও পরামর্শ প্রদান করে তাও বাংলাদেশের প্রান্তিক সুবিধাবঞ্চিত দরিদ্র মানুষগুলোর কাছে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকে। বেসরকারি পর্যায়ে সরকার অননুমোদিত ১৫টি মানসিক হাসপাতাল থাকলেও সেখানে সত্যিকার মানসিক রোগীদের জন্য প্রকৃত কোন সেবা নেই, এমনকি বিশেষজ্ঞ ডাক্তার কবিরাজরাও প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। বেসরকারি মানসিক হাসপাতালসমুহ মানসিক সমস্যাকে কোন গুরুত্ব না দিয়ে মাদকাসক্তি নিরাময়ের চিকিৎসা-সেবা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আর গরীব মানুষদের মানসিক ও শারিরীক সমস্যা সুস্থতার বিষয়ে কারো কোন মনোযোগ নেই বললেই চলে। মানসিক প্রতিবন্ধকতার কারণে মানুষ সবার আগে হারিয়ে ফেলে তার মানসিক শক্তি। যেখানে লুকিয়ে থাকে বেঁচে থাকার অপূর্ব প্রাণশক্তি। নিজের প্রতি হারিয়ে ফেলে আত্মবিশ্বাস। নিজের মতো করে তৈরি করে নেয় নিজস্ব মেঘাচ্ছন্ন মলিন পৃথিবী। নিভৃতে তিল তিল করে হারিয়ে যেতে থাকে বিষন্নতার গভীরে।

মানসিক প্রতিবন্ধকতার কারণে মানুষ তার আশেপাশের মানুষগুলোর সাথে বিরূপ তিক্ত সম্পর্ক তৈরি হয়, সবার কাছে অপ্রিয় হতে শুরু করে। তার মানসিক অস্থিরতা বুঝতে না পেরে তাকে নানাভাবে বিরক্তি অবস্থানের দিকে ধাবিত করে। একসময় সে নিজেকে গুরুত্বহীন ভাবতে শুরু করে এবং বেছে নেয় আত্মঘাতির পথ। যে কোন মানুষ হতাশাগ্রস্থ বা অসুস্থ মানুষের প্রতি বিরক্ত, খারাপ আচরণ না করে আন্তরিক ভাবে পাশে থাকা উচিত। সুস্থ্য ও স্বাভাবিক মানুষদের দক্ষতা অভিজ্ঞতাসমুহ এবং অবদান বা উৎপাদন অস্বীকার করে তাদেরকে পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন রাখার একটি কৌশল মাত্র।

আমাদের পারিপাশ্বিক চারপাশের জগৎ তথা পরিবার-সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে চিরতরে মানসিক প্রতিবন্ধিতা নির্মূল করতে গেলে সমাজের যুগযুগ ধরে বংশ পরাস্পরায় লালিত প্রথা রীতি-নীতি ও বিশ্বাসের আধুনিকায়ন ও ভাবধারাসহ সকল নিয়মনীতি এবং দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। মানুষ মানুষের সাথে যদি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সম্মান এবং ভালো কাজের মূল্যায়নের স্বীকৃতিসহ সকলকে সমান সুযোগ ও অধিকার দিতে পারলে মানসিক প্রতিবন্ধিতা দূর করা আমাদের জন্যে শুধু সময়ের ব্যাপার। আমাদেরকে নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থ ও বিশ্বাস-ভালোবাসা এবং আগ্রহের উর্ধ্বে চিন্তা করে সকলের স্বার্থে সমানভাবে ভাবা উচিত।

আমাদের চারপাশে যে সব পিছিয়ে পড়া প্রতিবন্ধী মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তি রয়েছে তাদের প্রতি আমাদের স্বাভাবিক ও সভ্য মানুষদের আরো বেশি পরিমান সংবেদনশীল ও মানবিক হতে হবে। তাদের প্রতিটি কার্যক্রমে সচেতন ও স্বীকৃতি এবং কার্যক্রম-অবদানের প্রতি সম্মান-মর্যাদা দিয়ে সমাজের সকল স্তরের সাথে অংশগ্রহণ ও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। মানসিক প্রতিবন্ধিতা কিন্তু কোন রোগ নয়। আমরা তাদেরকে রোগী মনে করে আর্থ-সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক পরিমন্ডল থেকে তাদের আলাদা করে রেখে বঞ্চিত করছি মাত্র। তাদেরকে অন্য সকলের মতো উপযুক্ত ভালোবাসা দিয়ে এবং সকলের সাথে মিলেমিশে কাজ করার সুযোগ করে দিয়ে তাদের অধিকারের সুরক্ষা করতে হবে। তবেই বোধ হয় আমরা এ সমাজ থেকে চিরতরে এমন ভয়াবহ প্রতিবন্ধিতা নির্মূল করে একটি আধুনিক ও যুগোপযোগী সমাজ বিনির্মাণ করতে পারব।

ম্যাকি ওয়াদুদ: প্রাবন্ধিক, লেখক ও সমাজকর্মী

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts