‘সুতরাং’ এবং সুখানপুকুর

নিয়ন মতিয়ুল
সুভাষ দত্তের জীবনের সেরা ছবি যেমন ‘সুতরাং’, তেমনি সেরা আবিষ্কার কবরী। চট্টগ্রামের লজ্জারাঙা ভীতু কিশোরী মিনা পাল-ই তার হাত ধরে হয়ে উঠেছিলেন চিত্রনায়িকা। কেন যেন কখনও আমার মনে হয় ‘সুতরাং’ আর কবরী সমার্থক। তবে ‘সুতরাং’ ছবির নাম শুনলেই আমার মনের পর্দায় ভেসে ওঠে সুখানপুকুর রেলস্টেশনের ছবিটা। সেই সঙ্গে যমুনাপাড়, মেঠোপথ, দিগন্তজোড়া সবুজ মাঠ…।
ছোট বেলায় কল্পনা শক্তি অনেক বেশি থাকে। তাই যে কোনো গল্প বা জনশ্রুতি মানসপটে অবিশ্বাস্য আকর্ষণীয় চিত্ররূপ ধারন করে। আমারও হয়েছে তাই। খুব ছোটবেলায় মামা-খালাদের (নানার বাড়িতে আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা) কাছ থেকে প্রথম ‘সুতরাং’ ছবির গল্প শুনেছি। জেনেছিলাম, ছবির পরিচালক সুভাষ দত্তের বাড়ি আমাদের বগুড়ায়, যমুনাপাড়ের কোনো এক গ্রামে। (পরে অবশ্য জানা যায় তার বাড়ি ধুনট উপজেলার চকরতি গ্রামে)।
মামারা বলতেন, নিজ এলাকায় এসে যমুনাপাড়েই ‘সুতরাং’ ছবির স্যুটিং করেছিলেন সুভাষ দত্ত। পরে বগুড়ার গাবতলী উপজেলার সুখানপুকুর রেলস্টেশনেও কিছু দৃশ্য ধারণ করা হয়। আর কোথায়, কীভাবে স্যুটিং হয়েছিল, কে কে অভিনয় করেছিলেন, তা নিয়েও অনেক গল্প শুনেছি। ভীষণ কৌতুহলী হয়ে কত কত মাইল হেঁটে জেলা শহরে গিয়ে হলে ছবি দেখেও আসতেন তারা। ছবির কাহিনি নিয়ে কত গল্প হতো। তখন আমার ছোট্টমনে ছবি, সিনেমা হল নিয়ে দারুণ কৌতুহল জেগে উঠতো।
এরপর প্রথম যেদিন সুখানপুকুর রেলস্টেশনে আমার পা পড়লো, সেদিন ছোট বেলার সেই স্মৃতির কি যে তোলপাড়। স্টেশনের এদিক সেদিক তাকিয়ে কোথায়, কীভাবে স্যুটিং হয়েছিল তা কল্পনায় সাজাতাম। তখন থেকেই ছবিটি দেখার ইচ্ছে জাগে। তবে সে সময় আজকের মতো পুরোনো ছবি দেখার এত সুযোগ ছিল না। তাই সে ইচ্ছে আর পূরণ হয়নি। যদিও বগুড়ার যমুনা পাড়ের কোনো গ্রামে কিংবা সুখানপুকুর রেলস্টেশনে ‘সুতরাং’ ছবির স্যুটিং সত্যিই হয়েছিল কিনা তা আর যাচাই করতে যাইনি। বাস্তবতা যখন নির্মম তখন তো কল্পনা আর স্মৃতিগুলোই অবলম্বন। থাক না সেই কল্পনাগুলো মিথ্যার আড়ালে মধুর হয়ে।
আজ কয়েক দশক পরে সুভাষ দত্তের আবিষ্কার চিত্রনায়িকা কবরীরূপী মিনা পাল যখন চিরবিদায় নিলেন তখন বেশি বেশি করে ‘সুতরাং’ ছবির কথাই মনে পড়ছে। আজ আমার সেই মামা-খালাদের মধ্যেও অনেকে চিরবিদায় নিয়েছেন। সুতরাং ছবির সেই দৃশ্যগুলোও ঘোলাটে হয়ে গেছে। সুখানপুকুর স্টেশনের সেই চিত্রও আর নেই। হয়তো যে গ্রামের চিত্র ধারন করা হয়েছে সেগুলোও যমুনার গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। শুধু সেই মধুর গল্পগুলো, চিত্রকল্পগুলো মনের পর্দায় সুখানুুভূতির দোলা দেয়।
মনে পড়ছে, কলেজে পড়ার সময় হঠাৎ করেই সিনেমার কাহিনি লেখা শুরু করা আমার চাচাতো ভাই বলে বসলো- সে সিনেমা তৈরি করবে। এলাকাতেই স্যুটিং হবে। প্রথম স্যুটিং হবে সুখানপুকুর স্টেশনে। এ কথা শোনার পর আমার আবারও সেই ‘সুতরাং’ ছবির কথাই মনে পড়লো। যদিও পারিবারিক আর পেশাজীবনের কারণে সেই উদ্যোগ আর বেশি দূর গড়ালো না।
হয়তো শৈশবে শোনা ‘সুতরাং’ ছবির সেই গল্পগুলোর জন্যই হাইস্কুলে পড়ার সময় জেলা শহরের সিনেমা হলে ছুটে যেতাম। রঙিন পর্দায় জীবনের কত রঙ দেখতাম। কত রঙিন স্বপ্ন নিয়ে ঘরে ফিরতাম। স্বপ্ন দেখতাম আগামীর সুন্দর এক পৃথিবীর। হয়তো সে সব সিনেমাই জীবনের বাঁক বদলে দিতো, ঠিক করে দিত সামাজিক, পারিবারিক জীবনের রূপরেখা। শেখাতো প্রেম, ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে ভাবতে, দু’হাত বাড়িয়ে তাকে কাছে টানা কিংবা মুগ্ধ করার কৌশল হয়তো শেখা হতো। কখনও প্রেম নিবেদনের ভাষাগুলোও জানা হতো।
তবে আজ আমাদের সেই সিনেমা আর নেই। পরিবার-সমাজের বন্ধনের গল্পগুলোও এখন উধাও। প্রেম, ভালোবাসা, উদারতা, মহত্বের পরিবর্তে এখন যৌনতা, লোভ, হিংসা, সহিংসতাই সিনেমার উপাদান। আত্মিক প্রেম, ভালোবাসা, মায়া, মমতা নয়, সিনেমা শেখায় এখন ইভটিজিং, ধর্ষণ, যৌনতা। মহত্ব বা সম্মান নয়, সিনেমার আদর্শ এখন অর্থ-বিত্ত, মাফিয়া।
(নিয়ন মতিয়ুল: এলোমেলো ভাবনা: ১৭ এপ্রিল, ২০২১। এলিফেন্ট রোড, ঢাকা)
Print Friendly

Related Posts